মেডিকেল মিরাকল : যে মানুষটি ৪৫ বছর ধরে ঘুমাননি

আরবান পুয়ের্তো রিকোয় একটি কথা আছে, “ঘুমন্ত চিংড়ি স্রোতের সাথে হারিয়ে যায়”। তারপরেও সব প্রাণীরই বিশ্রামের জন্য একটি মুহূর্ত প্রয়োজন। সব প্রাণীই, শুধু ভিয়েতনামের কৃষক নক থাই (Ngoc Thai) বাদে।

ছবিঃ Ngoc Thai (Source: Rockntech)

মানুষের জন্য একটি প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য জিনিস হচ্ছে ঘুম। যদিও ঘুম বলতে যে শুধু অচেতন হয়ে পড়ে থাকতে হবে সেটা না হলেও, অধিকাংশ প্রাণীকূলের বাসিন্দাদের জন্য এটি কোন ঐচ্ছিক অবস্থা নয়। এমনকি পানির নিচের মাছ, তারও ঘুম দরকার। যদিও তাদের নিদ্রার সময় অর্ধেক মস্তিষ্ক জেগে থাকে এবং অন্য অংশ অচেতন অবস্থায় থাকে। একইভাবে উটপাখিরাও এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করে শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা এবং বিশ্রাম উভয়ই করে থাকে।

অনিদ্রা অসংখ্য মেডিসিন বইয়ের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়, আর এটি যার আছে কষ্ট ভোগ শুধু সে’ই করে, অন্যরা বুঝে না। আবার, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনও আছে যেখানে মাত্র কয়েক ঘন্টার ঘুমও যথেষ্ট হতে পারে। যেমনঃ আমাজনের পিরহা গোত্রের উপজাতিরা। এরা দীর্ঘ সময় শিকারে থাকাকালীন হালকা একটু ঘুমিয়ে নেয় যাতে করে পুর্ণউদ্যোমে কাজ করে যেতে পারে। এমনকি সেনাবাহিনীতেও একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘যুদ্ধের ময়দানে যে যতটুকু পারো ঘুমিয়ে নাও। কে জানে পরবর্তি ঘুমের সময় কখন পাবে।’ সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে কেউ ঘুম ছাড়া দীর্ঘ সময় টিকে থাকা কারো পক্ষেই সম্ভব না।

আবার একটি কথাও সত্য, যখনই কোন নিয়ম আছে, কেউ তো অবশ্যই আছে সেটি ভাঙ্গার জন্য।

একজন ব্যক্তি ঘুম ছাড়া কতক্ষণ টিকে থাকতে পারেন? বেশ কিছুদিন আগে, টনি রাইট নামের একজন ব্যক্তি একটানা ২৬৪ ঘন্টা (১১ দিন) না ঘুমিয়ে পুর্বের গিনেজ রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। ইতিপুর্বে এই রেকর্ডের মালিক ছিলেন র‍্যান্ডি গার্ডনার নামের ১৭ বছর বয়সী এক তরুণ। সেটিও ১৯৬৪ সালে। দুর্ভাগ্য রাইটের, স্বাস্থ্যগত ঝুকির কারনে তার ২৬৬ ঘন্টার স্যক্রিফাইস গিনেজ আমলে নেয় নি। যাইহোক, জাদুকর এবং ধৈর্য্যের শিল্পী ডেভিড ব্লেইন সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, রাইট নয় বরং তিনিই এই টাইটেলের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যাক্তি।

যদিও এইসকল ব্যক্তিরা তাদের নির্ঘুম স্টান্টগুলি দিয়ে ইতিহাস গড়তে চেয়েছিল, তবে যারা অনিদ্রায় ভুগছেন তারা অনেকেই বিশ্বাস করেন বহু আগেই তারা এইসব রেকর্ডের ছাড়িয়ে চলে গেছেন। তবে এই নিয়ে তাদের মনে কোন গর্ব করার আগ্রহ নেই। ১৯৪২ সালে ভিয়েতনামে জন্মগ্রহণ করা কৃষক নক থাই তাদের মধ্যে একজন।

blank
ছবিঃ খামার দেখাচ্ছেন Ngoc Thai (Source: pastebin.com)

১৯৭৩ সালে একদিন এই কৃষকের মারাত্মক হঠাৎ মারাত্মক জ্বর হয়েছিল। আর তারপর থেকে তিনি একটি আর কখনও দু চোখের পাতা এক করতে পারেন নি। এরপর ২০০৭ সালে থাই যখন বিশ্বের কাছে বললেন যে, প্রায় ৩৫ বছর ধরে তার না ঘুমানোর কারনে তিনি “মাতাল মাতাল” অনুভব করছেন; আর নগদে এটি হয়ে দাঁড়ায় একটি ঐতিহাসিক মেডিকেল মিরাকল।

নির্ঘুমতার লক্ষণ

মানব শরীরে সাধারণত কি হয়, যখন অনেক বেশি সময় ধরে নির্ঘুম থাকে? যার সারারাত ঘুম হয় নি, সেই সবথেকে ভাল বলতে পারবেন। এই যেমন- অস্থিরতা, কগনিটিভ ফাংশন হ্রাস, মনোযোগের অভাব, অতিরিক্ত ক্লান্তি, ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। আর যাদের বেশ কয়েক রাত নির্ঘুম থাকতে হয়, তাদের এই উপসর্গগুলো গুরুতর হয়ে ওঠে।

স্লিপ সার্ভিস অস্ট্রেলিয়ার রেসপিরেটরি স্লিপ ফিজিশিয়ান ডাঃ ভিকাশ ওয়াধা বলেন, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় এমন রোগ থাকলে তা মানসিক ও মোটর ফাংশন হ্রাস এবং ক্রমে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। একটি ইমেইল সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি বলেছিলেন –

অতিরিক্ত দুর্বলতা ঝুকিপুর্ণ স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত, এবং অতিরিক্ত নির্ঘুমতা প্রাণীর জন্য মৃত্যুর কারনও হতে পারে। ফ্যাটাল ফ্যামিলিয়াল ইনসোমনিয়া নামের একটি অসুখ রয়েছে। এই ডিসর্ডারের অগ্রগতির সাথে সাথে আক্রান্ত ব্যক্তিটি মোটেও ঘুমুতে পারে না আর এভাবে চলতে থাকলে কয়েক মাস বা বছরখানেকের মধ্যেই মৃত্যু মুখে পতিত হয়।

কিন্তু ঘুমের এই অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনীয়তা কি কোনভাবে পরিবর্তিত হতে পারে? টনি রাইট কিন্তু শুধু রেকর্ড ভাঙতে আগ্রহী ছিলেন না, বরং দীর্ঘ নির্ঘুমতা নিয়ে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে চলমান গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে মস্তিষ্কের উভয় দিকের জন্য বিভিন্ন পরিমাণে ঘুম দরকার। ১১ দিনের এই ম্যারাথন নির্ঘুমতার আগে তিনি খুব সতর্কভাবে নিজেকে তৈরী করে নিয়েছিলেন। এমনকি বিশেষ এক ধরনের ডায়েটও ফলো করেছিলেন। এদিকে বর্তমানে ব্লেইনও রাইটের রেকর্ড ভাঙ্গার জন্য অনুরূপ ডায়েট নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মেডিকেল মিরাকেল

blank
ছবিঃ ড. ভিকাশ ওয়াধা (Source: Akolade)

 

প্রায় ষাট বছর বয়সী নক থাই অবশ্য নিশ্চিত করেই বলেছেন যে ঘুমের অভাব তাকে শারীরিকভাবে প্রভাবিত করে না। প্রতিদিন সে বাড়ি থেকে দুই মাইলেরও বেশী রাস্তা ১১০ পাউন্ড চালের বস্তা বহন করতে সক্ষম। যদিও, থাই নিদ্রা থেকে বিরত থাকার শো অফ কিংবা রেকর্ড ভাঙ্গার জন্য অথবা গবেষণা প্রকল্পকে অগ্রসর করার জন্য কিছুই করেন নি। বরং, তিনি প্রতি রাতেই চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে সবকিছু চেষ্টা করেছেন। এর জন্য ঔষধ থেকে শুরু করে এমনকি কবিরাজী গাছড়া কোন কিছুই চেষ্টা করতে বাকি নেই। অ্যালকোহলও তার উপরে কাজ করে না। যেসব ডাক্তাররা তাকে পরীক্ষা করে দেখেছেন তাদের মতে, থাই এখনও নিখুঁত স্বাস্থ্যের অধিকারী, শুধু সামান্য লিভারের সমস্যা ছাড়া।

২০০৬ সালে নক থাই থান নিয়েন নিউজ (Thanh Nien News) এর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,

আমি জানি না যে অনিদ্রা আমার স্বাস্থ্যের উপর কোন প্রভাব ফেলেছে কিনা, তবে আমি এখনও সুস্থ ছি অন্য সাধারণ কৃষকের মতই খামারের কাজ করতে পারি।”

সত্যই, ঘুম ছাড়াও থাই ত্রিশ বছরে বেশ কর্মক্ষমই আছেন। এই অলৌকিক অনিদ্রার পিছনে কি ঘটনা থাকতে পারে? ডাঃ ওয়াধা একটি ব্যাখ্যা দাড় করাতে চেষ্টা করেছেন। তার মতে কিছু অনিদ্রার ক্ষেত্রে, স্পষ্টভাবে ঘুম ও জাগ্রততার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করাটা বেশ কঠিন পারে।

তিনি বলেন,

রোগীরা মনে হতে পারে যে তারা নিছক বিশ্রাম নিচ্ছে যখন প্রকৃতপক্ষে তারা ঘুমাচ্ছে এটাকে বলে মাইক্রোন্যাপ (Micro-nap), যেটা কয়েক মিনিটও হতে পারে।

যখন নক থাই মিডিয়ার চোখে পড়েছে, তার বিষয়ে এখনও বিজ্ঞানীদের জানার অনেক কিছু

বাকি আছে। আর এদিকে, থাই তার এই অতিরিক্ত এগার ঘন্টা সময় ব্যয় করেন খামারের অতিরিক্ত কাজ করার মাধ্যমে। যেমনঃ খামারে রাতে গার্ড দেওয়া যাতে চুরি না হয়, মাছের জন্য বড় পুকুর খনন করা এবং কাজের জন্য সহকর্মীদের রাত থাকতেই ডেকে দেওয়ার মাধ্যমে। হিসাব মতে নক থাই এখন পর্যন্ত ১৬০০০ এর ও বেশি নির্ঘুম রাত পার করেছেন।

 

নিচে অবশ্যই কমেন্টে আপনার গুরুত্বপুর্ণ মতামত জানাতে ভুলবেন না। আর ভবিষ্যতে আরো এমন কন্টেন্ট দেখতে চান কি না সেটিও আমাকে জানাতে পারেন।

ধৈর্য্য ধরে পুরো আর্টিকেলটি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।