এক যে ছিল রাজা- ফিরে এলেন ভাওয়াল রাজকুমার

সাল ১৯২১। ভাওয়াল স্টেটের রাজপ্রাসাদে আগমণ ঘটল জটাধারী, সর্বাঙ্গে ছাই মাখা এক সন্ন্যসীর। দাবি, তিনি এই রাজ্যের রাজা! ভাওয়ালের মেজ কুমার রামেন্দ্র নারায়ন কি তবে মৃত থেকে আবার জীবিত হয়েছেন? এখানেই শুরু হল চাঞ্চল্যকর ঘটনাটির।

ঘটনার সুত্রপাত ১২ বছর আগে। কুমার রামেন্দ্র নারায়ন ছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের ভাওয়াল স্টেটের রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের দ্বিতীয় পুত্র। দেখতে সুদর্শন আর পিতার অগাধ সম্পদ-বখে যেতে এর বেশি কিই বা লাগে? নারীসঙ্গ আর মদ নিয়েই কাটে কুমারের জীবন। এসময় বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এলেন বিভাবতীকে। কিন্তু এতে স্বভাবে কিছু পরিবর্তন আসে নি। এই লাগামহীন চলাফেরায় মেজকুমার আক্রান্ত হয়ে পড়েন সিফিলিসে। দীর্ঘদিন রোগে ভুগেও সুস্থ না হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে শরীর সারাতে দার্জিলিং রওয়ানা হন মেজ কুমার, সাথে রানি বিভাবতী, বিভাবতীর ভাই এবং কিছু পরিচর্যাকারী। সাথে ছিলেন পারিবারিক চিকিৎসকও। কিন্তু হায়! সেখানে গিয়েও কুমারের শরীরের কোন উন্নতি হল না। বরং খারাপ হতে থাকল দিনকে দিন। এবং একদিন সকালে রাজবাড়িতে খবর এল মেজ কুমার আর নেই। তড়িঘড়ি করে মেজ কুমারের সৎকার করে ফিরে এলেন রানী ও বাকিরা।

ভাওয়াল স্টেটের রাজপ্রাসাদে আগমণ ঘটল এক সন্ন্যসীর, দাবি- তিনি এই রাজ্যের রাজা!

এখানে জানিয়ে রাখি, অনেক মতবাদের মধ্য একটি প্রচলিত হল যে, মেজ কুমারের অবহেলায় রানী বিভাবতী নাকি ব্যাক্তিগত চিকিৎসকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাই কুমারের মৃত্যুতে তার হাত থাকা অস্বাভাবিক নয়। আবার অনেকে মনে করেন, সম্পদের লোভে বিভাবতী ও তার ভাই বিষ প্রয়োগে কুমারের মৃত্যু ত্বরান্বিত করেন। পেছনের ষড়যন্ত্র যাই হোক, সবাই জেনে গেল মেজ কুমার আর নেই।

পরে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার দিনে কি ঘটেছিল তা নিয়ে অনেক আলোচনা, অনেক কথা হয়েছিল, কিন্তু তার তল কেউ পায়নি। কেউ কেউ সাক্ষ্য দিয়েছিল সংস্কার করার আগেই শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে সবাই মৃতদেহ রেখেওই পালিয়েছিল। কারো মতে তাড়াহুড়ায় ঠিকমত সংস্কার করা হয়নি। কিন্তু যাই হোক, এখানে একটি রহস্য থেকেই যায়।

blank
মেঝ রাজকুমার

এর পরের কাহিনি খুব স্বাভাবিক হতে পারত, কিন্তু তা হল না। ১৯০১ সালে রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ মৃত্যুবরণ করেন এবং রেখে যান তিন পুত্র। যারা তাদের পূর্বপুরুষদের তুলনায় হয়ে উঠেছিলেন ভয়ানকভাবে দূর্নীতিগ্রস্থ এবং চারিত্রিকভাবে স্খলিত। এরপর দুই কুমারের মৃত্যুর পর বিধবাদের সম্পত্তি চলে যায় ব্রিটিশদের দখলে। কুমারের আপন বলতে থাকেন শুধু বোন আর কিছু আত্মীয়।
কিন্তু এক সকালে, ১৯২১ সালে, এমন একজন আবির্ভূত হয়, যাকে এগারো বছর আগে সমাধিস্ত করা হয়েছিল। কয়েকজন ব্যক্তি যারা পরবর্তীতে আদালতে সাক্ষী দিয়েছিলেন, তারা জানান, ঢাকার বুড়িগঙ্গার বাকল্যান্ড বাঁধে এমন একজন সাধুকে দেখতে পান যিনি সন্ন্যাসী হলেও ছিলেন গৌড়বর্ণ এবং যার সাথে মেজকুমারের চেহারা এবং শারিরীক গঠনের অবিশ্বাস্য মিল রয়েছে। স্ফুলিঙের মত গুজব ছড়িয়ে পড়ল সারা স্টেটে, মেজ কুমার ফিরে এসেছেন।

সেই গুজব রাজবাড়ির সদস্যদের কানে গেলে কুমারের দিদি জ্যোতির্ময়ী আর স্থির থাকতে পারলেন না। ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। কিন্তু কেউই তাকে কুমার বলে সরাসরি স্বীকৃতি দিতে পারল না। বোনের দাবিতে সন্ন্যাসীকে নিয়ে আসা হল প্রাসাদে। বোন এসে দাবী করলেন এটিই তার ভাই।

blank
ভাওয়াল রাজার রাজপ্রাসাদ

বোনের জন্য কয়েকটি জন্মদাগই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু তিনি যখন তার দাইয়ের নাম আর কিছু কথা বলেন যা অন্য কারো জানার কথা না, তখন গোটা রাজ্য স্বীকার করে নেয় যে, মেজকুমার ফিরে এসেছে। যদিও তিনি বলতে পারেননি তিনি কিভাবে সাধুসঙ্গ নিয়েছিলেন। সন্ন্যাসী বলেন, তাকে অসুস্থ অবস্থায় সন্ন্যাসীরা খুজে পান এবং সুস্থ করে তোলেন। তার আগের কথা তার পুরোপুরি মনে পড়ে না।

কিন্তু তাকে স্বামী বলে স্বীকার করেন না রানি বিভাবতী। তিনি দাবি করেন মেজকুমার মৃত। তবে কি কুমার পুনরায় জীবিত হয়েছেন?
এর প্রেক্ষিতে ১৯৩০ সালে সন্ন্যাসীর পক্ষে মামলা হয় স্টেট ফিরে পাবার। এটিই সেই বিখ্যাত “ভাওয়াল কেস” যা পুরো পৃথিবীতে অনন্য হিসেবে গৃহীত।

১৯৩০ সালের নভেম্বরে ঢাকা জেলা আদালতে শুরু হয় এই ঐতিহাসিক মামলা এবং জুলাই, ১৯৪৬ সালে মামলার চূড়ান্ত রায় হয়।
প্রায় ১৫০০ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল, সেখানে ৬০০ দিন শুনানির সময় ছিল এবং উভয় পক্ষের আইনজীবী তাদের আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করতে মোট ১২ সপ্তাহ নিয়েছিলেন। কুমারের বোন জ্যোতির্ময়ী দেবী পুরোটা সময় সন্ন্যাসীর পক্ষে বলে গেছেন। অপরদিকে বিভাবতী আদালতকে জানান মেজ কুমারের সাথে সন্ন্যাসীর কোন মিলই নেই। তার উপর মেজকুমার শিক্ষিত ছিলেন, বাংলা ও ইংরেজিতে দক্ষ ছিলেন। কিন্তু সন্ন্যাসী শুধু পাঞ্জাবি আর ভাঙা হিন্দিতে কথা বলেন। বিবাদী পক্ষ আরো দাবি করেন যে সিফিলিস হওয়া সত্বেও সন্ন্যাসীর শরীরে তার কোন দাগ নেই।

যখন মামলাটি কলকাতায় হাইকোর্টে আপিল করা হয়, সেখানে নিম্ন আদালতের রায়কে সমর্থন করে রায় দেয়া হয় যে সাধু প্রকৃতপক্ষে ভাওয়ালের কুমার। ১৯৪৬ সালে প্রিভি কাউন্সিলে মামলাটি শেষ হয়ে যায়। যদিও মামলার রায় হিবার ২ দিন পর সন্ন্যাসী স্ট্রোক করে মারা যান। এটি কি ঐশ্বরিক শাস্তি? নাকি নিজের অধিকার ফিরিয়ে নিয়ে স্বেচ্ছায় শান্তিতে চলে যাওয়া?

কারণ সত্যি কখনো কখনো গল্পের চেয়েও রহস্যময় হয়!

blank
নন্দিত পরিচালক সৃজিত মুখার্জী এই বিখ্যাত ভাওয়াল কেসের উপর নির্মিত ছবি ‘এক যে ছিল রাজা’ মুক্তি দিতে যাচ্ছেন

পরবর্তী তে এই কাহিনী নিয়ে প্রচুর বই, সিনেমা, নাটক তৈরি হয়েছে।  আসছে পূজোয় নন্দিত পরিচালক সৃজিত মুখার্জী এই বিখ্যাত ভাওয়াল কেসের উপর নির্মিত ছবি ‘এক যে ছিল রাজা’ মুক্তি দিতে যাচ্ছেন। দেখা যাক কেমন হয়!