দ্যা বার্নিং মংক

তখন রাত্রির দ্বিপ্রহর, যখন তারা পর্বতের চূড়ায় কিছু শুনতে পেল। প্রথমে যা এক সুরে গাওয়া গানের মত ছিল, ধীরে ধীরে তা মন্ত্রোচ্চারণের মত শোনাতে লাগল। আরো কিছু পরে তা জ্বলন্ত কাঠের শব্দে পরিণত হল। কৌতূহলীদের কৌতূহল বাড়তে থাকল। দলে দলে তারা চলল পাহাড়ের চূড়ায়।

সেখানে বসে ছিল তাদের বন্ধু, হাত দুটো একখানে করে কোলের উপর রাখা, মুখটা পশ্চিম দিকে রাখা। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড তাঁকে ঘিরে ছিল, এই শান্তিপ্রিয় মানুষটিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছিল। যেমন টি তিনি চেয়েছিলেন।

সময়টা সাল ৫২৭।

গল্পটি দাওদু নামের একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর। এই গল্পটি জেমস ব্রেন এর “”Burning for the Buddha: Self-Immolation in Chinese Buddhism.” বইয়ে উল্লেখ আছে। জেমস ব্রেন, যিনি ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি ইন ওন্টারিও, কানাডার ধর্ম বিষয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক, বলেন, নিজেকে আগুন ধরিয়ে নিজের সত্ত্বাকে বিসর্জন দেয়ার এই প্রথা চলে আসছে ১৪শ শতাব্দী থেকে, যার বেশির ভাগই চাইনিজ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।

যদিও এই নিজেকে উৎসর্গ করার এই প্রথা ১৫০০ বছর পুরোনো, পশ্চিমা বিশ্ব এই ব্যাপারটিতে সচেতন হয় ষাটের দশকে। যখন ১৯৬৩ সালে থিক কোয়াং ডাক (Thich Quang Duc), একজন ভিয়েতনামিজ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর একটি ঐতিহাসিক ছবি ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। ছবিটিতে দেখা যায়, সন্ন্যাসীর সারা শরীরে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, কিন্তু তিনি বসে আছেন নিশ্চুপ, অবিচল- যেন পাথরের মূর্তি।

১০ জুন, ১৯৬৩। মার্কিন প্রতিবেদকদের কানে এসেছে কিছু গুজব। সায়গন এর কম্বোডিয়ান দূতাবাসের সামনে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটতে চলেছে। কিন্তু বেশিরভাগ সাংবাদিকই ব্যাপারটা আমলে নিলেন না। কারন বৌদ্ধ দের এই সমস্যা প্রায় একমাসেরও বেশি সময় ধরে চলছিল। কারণ জানতে হলে যেতে হবে আরেকটু পেছনে।

ম্যালকম ব্রাউনের তোলা সে বিখ্যাত ছবি- দ্যা বার্নিং মংক

ভিয়েতনাম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, দক্ষিণ ভিয়েতনাম ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। যদিও মোট জনসংখ্যার প্রায় 80 শতাংশই বৌদ্ধ, দক্ষিণ ভিয়েতনামের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি নো দিম জিয়েম ছিলেন একজন ক্যাথলিক যিনি বৌদ্ধদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নির্বিচারে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। বৌদ্ধদের তাদের ধর্মীয় পতাকা উড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি, এবং খোলাখুলিভাবে ক্যাথলিকদের সাথে বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। যদিও অনেক কম সংখ্যক ক্যাথলিক ছিল, তবুও তারা প্রায়শই ক্ষমতার উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নির্বিচারে ভাঙা হচ্ছিল বৌদ্ধদের উপাসনালয়-প্যাগোডা। এর কারণে বৌদ্ধদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। শুরু হয় প্রতিবাদ প্রতিরোধ।

তাই যখন সাংবাদিকদের জানানো হয়, ‘কিছু’ ঘটতে চলেছে, কেউই কান দেয়নি। অল্প কিছু সংখ্যক সাংবাদিকই সেদিন উপস্থিত ছিলেন। যাদের মদ্ধ্যে ছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসের ডেভিড হ্যালবারস্টোম এবং এপি’র ম্যালকম ব্রাউন।

পার্শ্ববর্তী প্যাগোডা থেকে আসা প্রতিবাদকারী দলের সাথে ডাক ও আসেন। সাথে আসেন প্রায় ৩৫০ সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী। ঘটনার সূত্রপাত হয় ফান ডি ফুয়াং রাজপথে। ডাক অপর দুজন সন্ন্যাসীর সাথে গাড়ি থেকে নামেন। একজন সন্ন্যাসী রাস্তায় একটি কুশন রাখেন যাতে ডাক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বিখ্যাত আসন পদ্মাসনে বসে পড়েন। অপরজন গাড়ি থেকে বের করে আনেন ৫ গ্যালনের একটি পেট্রোলের জার। ধীরে ধীরে আগত সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা তাঁকে ঘিরে ফেলেন। ডাকের শরীরে যখন ঢালা হচ্ছিল পেট্রোল, এই শান্তিপ্রিয় সৌম্য বৃদ্ধ বের করে আনেন তার কাঠের জপমালা। তিনি জপছিলেন অমিতাভ বুদ্ধের নাম। ঠিক তখনই নিজেই আগুন জ্বেলে দিলেন নিজের শরীরে। নিমেষেই তাঁর পরণের বস্ত্র দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে পুড়িয়ে দিতে থাকে সমস্ত শরীর। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ঠাঁয় বসে ছিলেন। যেন আগুন তাঁর শরীর ছুতেই পারে নি।

সেখানে দাঁড়িয়ে চাক্ষুষ দেখেছেন ডেভিড হ্যালবারস্টোম। তাঁর ভাষায়-

 

“আমি সেই দৃশ্য দেখছিলাম, কিন্তু আমার জন্য একবারই যথেষ্ট ছিল। অগ্নিশিখা গুলো একটি মানুষের দেহ থেকে আসছিল, ধীরে ধীরে তাঁর চামড়া কুঁচকে যাচ্ছিল, মাথার চামড়া পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছিল। বাতাসে মাংসের পোড়া গন্ধ। আমি জানতাম না মানুষের দেহ এত তাড়াতাড়ি পুড়ে যায়। আমার পেছনে জমায়ের ভিয়েতনামিজদের ফোঁপানোর শব্দ পাচ্ছিলাম। আমি এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে কাঁদতে পারিনি, এতটাই বিভ্রান্ত হয়েছিলাম যে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। তিনি পুড়ছিলেন, কিন্তু একটি পেশিও নাড়াননি, একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি। তাঁর ব্যাক্তিত্ব যেন জমায়েত মানুষগুলোর একেবারে বিপরীত”

 

সমবেত জনতা ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হতবুদ্ধি হলেও হুঁশ ফিরতেই মাটিতে মাঠা ঠেকিয়ে সম্মান দেখাতে শুরু করে। এমনকি যেসব পুলিশদের দায়িত্ব ছিল তাদের প্রতিরোধ করার তারাও সসম্মানে মাথা নুইয়ে ফেলেন।

 

প্রায় দশমিনিট জ্বলার পর, যখন পুরো শরীর পুড়ে যায়, ডাকের শরীর পেছন দিকে শুয়ে পড়ে। এরপর যখন আগুন নিভে যায়, সঙ্গী সন্ন্যাসীরা গেরুয়া কাপড়ে ঢেকে দেন ডাককে। তারা ডাকের মৃতদেহ কফিনে পুরতে গেলে শক্ত হয়ে যাওয়া শরীর কিছুতেই বাগে আনতে পারছিল না। এমনকি কফিনে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি হাত রাস্তায় পড়ে যায়।

তাঁর এই বিসর্জনের অভূতপূর্ব ঘটনা চলে আসে সকল খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। কিছুদিন আগেও যে দেশের নাম কেউই শোনেনি, সে ভিয়েতনামের নাম সবার মুখে মুখে ভাসতে শুরু করে।

ডাকের মৃত্যুর পর তাঁর শরীরের সৎকার করা হলেও তাঁর হৃদপিন্ড টিকে সংরক্ষণ করা হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, তাঁর পুরো শরীর পুড়ে গেলেও হৃদপিন্ড ছিল একদম অক্ষত। ভিয়েতনামে বৌদ্ধদের কাছে এই হৃদপিন্ড ভীষণ পবিত্র হিসেবে প্যাগোডায় সংরক্ষিত আছে। পরবর্তীতে ডাক একজন ‘বোধিসত্ত্ব’ হিসেবে পূজিত হন।

তাঁর সেই বিখ্যাত ছবি “বার্নিং মংক” তুলেছিলেন ম্যালকম ব্রাউন, যিনি পরবর্তীতে এই ছবির জন্য পুলিৎজার প্রাইজ পান।

ডাকের মৃত্যুর “বার্নিং মংক” ছবিটি সারা বিশ্বে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চিহ্ন হিসেবে দেখা হয়। আজ যেই ছবিটিকে শুধুই একটি প্রতিকী চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়, খুব কম মানুষই জানে যে এটি আসলে তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটি দূর্নীতির বিরুদ্ধের একটি প্রতিবাদ, একটি বিপ্লব- যা পরবর্তীতে আরো বড় কিছুকে উস্কে দিয়েছিল। তিনি একজন রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন যিনি বৃহত্তর স্বার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন,

যিনি পৃথিবী বদলে দিয়েছিলেন।