কোথা থেকে এলো মানুষের ছবি আঁকার প্রবণতা?

প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহা চিত্র

আমরা অনেকেই ছবি আঁকতে ভালবাসি। কেউ কেউ শখের বসে ছবি আঁকি আবার কারো জন্য এটা আবার জীবিকা নির্বাহের উপায়ও। বর্তমানে ছবি আঁকা শিখার কতো কতো মাধ্যম। এই শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে গড়ে ওঠেছে অনেক রকম প্রতিষ্ঠান। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়েছে চারুকলা অনুষদ। রয়েছে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা।

কিন্তু কোথা থেকে এসেছে এই শিল্প? প্রাকৃতিক বিষয়বস্তুগুলোকে রং তুলির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার প্রবণতা মানুষের মাঝে এলো কোথা থেকে?

সবচেয়ে মজার এবং অবাক করার মতো ব্যাপার হল মানুষ প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকেই ছবি আঁকে। এটা সেই সময়কার কথা যখন মানুষ সভ্য ছিল না, তারা যখন গুহায় থাকত এবং ফলমূল ও পশুর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকত। সবে তারা পাথরের ব্যবহার শিখেছিল।

যখন তাদের থাকার মতো নিরাপদ আশ্রয় ছিল না পরিধানের বস্ত্র ছিল না তখনকার দিনে তারা ছবি আঁকত কোথায়?

আরো পড়ুন- দেয়ালের অন্য পাশের গল্প- কান্দাপাড়া যৌনপল্লীর অদেখা কিছু ছবি

তখন মানুষ ছবি আঁকত গুহার প্রাচীরে। যা গুহা চিত্র বা কেইভ আর্ট নামে পরিচিত। রঙ এর বদলে বিভিন্ন রকম মাটির সাথে পশুর চর্বি মিশ্রিত করে ব্যাবহার করত। এছাড়া পশুর রক্ত দিয়েও তারা ছবি আঁকত। তাদের অঙ্কিত ছবিগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পশুর ছবিই প্রাধান্য পেয়েছে। ধারনা করা হয় যে তারা শিকারে যাওয়ার আগে বিভিন্ন পশু বধ করার ছবি আঁকত। তাদের বিশ্বাস ছিল শিকারে যাওয়ার আগে পশু বধ করা ছবি অঙ্কন করলে তারা সহজেই শিকারে সফল হবে। কারো কারো মতে আবার প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ ধর্মীয় কাজে এ ধরনের চিত্র অঙ্কন করেছে। কারো মতে আবার এটা হল তাদের একটা যোগাযোগ এর মাধ্যম।

প্রাচীন কালের এমন অসংখ্য গুহা চিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে বর্তমানে। যার বেশিরভাগই প্রাণীর ছবি। যেমন:  ভালুক, ঘোড়া, নেকড়ে, বাইসন, হরিণ ইত্যাদি। তাদের অঙ্কিত এই প্রাণীগুলো অস্ত্র বিদ্ধ এবং আহত। তবে অনুসন্ধানকৃত প্রাপ্ত ছবি গুলোর মধ্যে মানুষ এর হাতের ছাপও উল্লেখযোগ্য।

blank
গুহায় অঙ্কিত ভিন্ন প্রাণীর ছবি
blank
মানুষের হাতের ছাপ

ইন্দোনেশিয়ার মারকো দ্বীপে পাওয়া আনুমানিক পয়ত্রিশ হাজার বছর আগের গুহাচিত্রটিকে ২০১৪ সালে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন গুহা চিত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া আনুমানিক ত্রিশ হাজার থেকে বত্রিশ হাজার বছর আগের একটি গুহা চিত্র পাওয়া গিয়েছিল ফ্রান্সের চৌবেট গুহায় এবং রোমানিয়ার কোলিবোয়াই গুহায়। ধারণা করা হয় ইউরোপে প্রাপ্ত এই চিত্রকর্মটি অরিগনেশিয়ান যুগে অঙ্কিত।

প্রাচীন কালের এসব চিত্রকর্ম এর মধ্যে বিভিন্ন রকম জ্যামিতিক চিত্র উল্লেখযোগ্য। তাদের এই জ্যামিতিক চিত্র গুলো বিশেষ অর্থ বহন করে বলে পুরাতত্ত্ববিদের ধারনা। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ভিক্টোরিয়ার পিএইচডি শিক্ষার্থী এবং প্যালিএনথ্রোপলজিস্ট জেনেভিনে ভন পেটজিনজার সুন্দর ভাবে এই জ্যামিতিক নকশার ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তিনি তাঁর ‘দ্য ফার্স্ট সাইনস’ বইয়ে লিখেছেন, “বরফ যুগের ইউরোপিয়ানরা ৩২টি বিশেষ অর্থপূর্ণ নকশা ব্যবহার করতেন ভাষার আদান-প্রদানের জন্য। এর ব্যবহার চলে প্রায় ত্রিশ হাজার বছর ধরে”।

blank

এসকল আবিষ্কৃত গুহাচিত্রের অন্যতম বিস্ময় আলতামিরা গুহাচিত্র।  এটি স্পেনের সানতানদার অঞ্চলের আলতামিরা গুহার ছাদে অঙ্কিত। ফ্রেস্কো ধরনের এই গুহাচিত্রটি আবিষ্কৃত হয় ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। মারসেলিনো দ্যা সাওতুলা নামক প্রত্নতাত্ত্বিক তার আট বছরের মেয়েকে নিয়ে স্পেনের সানতানদার অঞ্চলের আলতামিরা গুহার কাছে প্রাচীন মানববসতির সন্ধান খুঁজতে গিয়ে এটি আবিষ্কার করেন। প্রথমে তার মেয়ে চিত্রটি লক্ষ করে ‘ষাঁড় ষাঁড়’ বলে চিৎকার করে ওঠে এবং সাথে সাথেই সাওতুলা আলোর ব্যবস্থা করে দেখেন এটি একটি বাইসন। তিনি এটি পর্যবেক্ষণ করে প্রাগৈতিহাসিক মানুষ এর আঁকা চিত্র হিসেবে চিহ্নিত করেন। ছবিটি অঙ্কন করতে  কয়লা, মেটে হলুদ এবং লাল হেমাটাইট ব্যবহৃত হয়েছে।

blank
আলতামিরা গুহায় অঙ্কিত বাইসন

গুহাটি পূর্বে সর্বসাধারণ এর জন্য উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু ২০০২ সালে প্রায় স্থায়ীভাবেই দর্শকদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় এই আলতামিরা গুহা। কারণ মানুষের শরীর থেকে নির্গত  তাপ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং বাতাসের আর্দ্রতায় প্রায় ২০ হাজার বছরের পুরোনো গুহাচিত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।