টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের বর্ষপূর্তি, আসবে এবার থেকে পরিবর্তন?

২০০০ সালের ১০ নভেম্বর।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম।
ক্রিকেটের অভিযাত সাদা জার্সি এবং চিরাচরিত টাইগার লোগো সম্বলিত ব্লেজার পরে পিচের ওপর নাইমুর রহমান দুর্জয়ের মুদ্রা নিক্ষেপের মাধ্যমে টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এরপর এক এক করে কেটে গেছে ১৯টি বছর। আইসিসির পূর্ণ সদস্যা হিসেবে ক্রিকেটে আমাদের বেশ কিছু সাফল্যই রয়েছে। তবে সাদা পোশাক এবং লাল বলের অভিজাত সংস্করণে সেই সাফল্যটা একেবারেই বিবর্ণ। অন্তত পরিসংখ্যান সেটাই বলে৷ ১৯ বছরে খেলা ১১৫ টেস্টের মধ্যে জয় যে মাত্র ১৩টি৷ এর বিপরীতে হারের সংখ্যা ৮৬, ড্র ১৬টি৷ এই ড্র-গুলোর অধিকাংশই আবার এসেছে প্রকৃতির সহায়তায়। হারা ম্যাচগুলো নিয়েও বিশ্লেষণ করলে পরিসংখ্যান লজ্জাটা আরো বেশিই দিবে। থাক, ওদিকে আর না যাই।

প্রথম টেস্ট শুরুর প্রাক্কালে; Source: daily star

 

পরিসংখ্যান যাই বলুক, বিগত কয়েক বছরে এই সংস্করণে কিন্তু আমরা খুব একটা ব্যর্থও না। ২০১৬ এবং ‘১৭ সালে টেস্ট ক্রিকেটের গোড়াপত্তন করা ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াও আমাদের কাছে হারতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের ক্রিকেটে যেটা সত্যিকার অর্থেই অনেক বড়ো অর্জন। কারণ টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের সবচেয়ে বেশি অবজ্ঞা ওরাই করে৷ এছাড়াও আমরা শ্রীলঙ্কাকে আমাদের শততম ম্যাচে হারিয়েছি ওদেরই মাটিতে, যেখানে লঙ্কা জয়টা অনেক শক্তিশালী দলের কাছেও মাঝেমধ্যে ধাঁধা হয়ে যায়। ক্যারিবিয়ানদেরও হারিয়েছি, সেটাও তাদের ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে গিয়েও। তবে এই অর্জনের উল্টোপিঠে লজ্জাও কম নেই। তবে সবচেয়ে বড়ো লজ্জাটা মনে হয় মাস দুইয়েক আগে নবাগত আফগানিস্তানের বিপক্ষে হারটাই।

blank
অস্ট্রেলিয়া বধের পর; Source: cricket.com.au
blank
শততম ম্যাচে; Soruce: AFP

 

অতীত নাহয় তুলে রাখা যাক কিছুক্ষণের জন্য। তাকাই আসন্ন ভবিষ্যতের দিকে। টেস্ট ক্রিকেটে বর্ষপূর্তির ঠিক চারদিনের মাথায় লাল বল নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে হবে। সেটাও আবার আমাদের এই সংস্করণে সর্বপ্রথম প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষেই। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে লড়ার জন্য আমরা ভালোমতো প্রস্তুত তো? অবশ্যই না! হয়তো প্রস্তুত আমরা, তবে সেটাকে কোনোভাবেই ভালো বলা যাবে না। অতীতের সাফল্যগুলোর দিকে তাকালে দেখা টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের বড়ো সব সাফল্যের সাথেই একটা নাম ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে। হ্যাঁ, সাকিবের কথাই বলা হচ্ছে। হয়তো সাকিবের সাথে সহযোদ্ধা আরো ছিলো, প্রতিবারই প্রতিপক্ষের মূল মেরুদন্ড তো ও-ই ভেঙেছে। সেঞ্চুরি করেছে, নিয়েছে ইনিংসে পাঁচ উইকেট, ঘায়েল করেছে প্রতিপক্ষের মূল স্তম্ভগুলোকে, দিয়েছে সামনে থেকে নেতৃত্বও। এই আসন্ন সিরিজটাতেও নেতা হওয়ার কথা ছিলো তার। কিন্তু অনাকাঙখিত এক ঘটনায় নেতা হওয়া তো দূরের কথা, দলের অংশই হতে পারছে না ও। তার সাথে নেই আরেক স্তম্ভ তামিম ইকবালও। আমাদের প্রাণভোমরা পঞ্চপান্ডবের মাত্র দুইজনকে নিয়েই প্রায় তরুণ একটা দলের নেতৃত্বের ভার পড়েছে মমিনুল হকের কাঁধে। মমিনুল কি পারবে এই তরুণ দলের নেতৃত্বের চাপ মাথায় নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে কাঙখিত সাফল্য এনে দিতে?

blank
যে দুইজনকে মিস করবে বাংলাদেশ; Source: Internet

 

হ্যাঁ, আমি তা আশা করি। মমিনুল হক টেস্টে অধিনায়কত্বের জন্য ভালো একটি চয়েস। খুশি হতাম যদি দলের ভার হুট করে না তার কাঁধে না এসে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আসলে। মমিনুলকে মূলত টেস্টেই খেলানো হয়৷ বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটি আসলে বেশ বিরল। কারণ এখানে এক ফরম্যাটে কেউ ভালো খেললে তাকে নামিয়ে দেওয়া হয় সব ফরম্যাটেই। একমাত্র শুধু মমিনুলকেই এক ফরম্যাটে আটকে রাখা হয়েছে। তবে এরপরও তার মধ্যে দল থেকে বাদ পড়ার শঙ্কা ছিলো, এমনকি কিছুদিন ধরে তার স্বাচ্ছন্দ্যের পজিশনে ব্যাটিংয়েরও সুযোগ পাচ্ছে না। এটা তার পারফর্ম্যান্সেও প্রভাব ফেলেছে। অধিনায়ক হওয়ায় তার এই ভয়গুলো আপাতত আর নেই। পারফর্ম করায় পূর্ণ মনোযোগী হতে পারবে এখন। কিন্তু অধিনায়কত্বের চাপ নিয়ে কি সে আসলেই পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবে? আমার মনে হয় পারবে। আমাদের ক্রিকেটে ওর আগে শুধু একজনই একটা নির্দিষ্ট ফরম্যাটে খেলেছে এবং নেতৃত্বও দিয়েছে। ভালো করে বললে, শুধু সাদা বলের সংস্করণগুলোতে খেলেছে। মাশরাফির কথাই বলছি৷ ওয়ানডেতে মাশরাফির সময়ে সাফল্য কিন্তু চোখে পড়ার মতো। মমিনুল কি পারবে ম্যাশের মতো টেস্টেও সাফল্য এনে দিতে? তাকে ম্যাশ হতে হবে না। ম্যাশ তার জন্য একটি উদাহরণ। উত্তরটা সময়ই বলে দিবে। ম্যাশের মতো তাকেও এখন শুধু একটা নির্দিষ্ট সংস্করণের জন্য দল গোছানো এবং পরিকল্পনা করা নিয়ে ফোকাসড হতে হবে৷ বলাই বাহুল্য যে মমিনুলের নেতৃত্বেই কিন্তু টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের খেলা শুরু করতে যাচ্ছি আমরা। এই চ্যাম্পিয়নশীপের গুরুত্ব ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে কম নয় বৈকি!

blank
টেস্ট অধিনায়ক মমিনুল হক; Source: Open

 

অবধারিতভাবেই প্রশ্ন আসে যে একাদশ নির্বাচনে মমিনুলকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হবে কিনা। আগের অধিনায়কদেরও এই ক্ষমতা ছিলো কিনা, সেটাও প্রশ্ন। দল জিতলে আমাদের এখানে বাহবা পাওয়ার লোকের অভাব নেই। আবার দল হারলেও দোষ দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই৷ বোঝার উপায় নেই আসলেই অধিনায়কের পূর্ণ ক্ষমতা আছে কিনা। অন্যান্য দেশের ক্যাপ্টেনদের এই ক্ষমতাটা রয়েছে, তবে কি শুধু বাংলাদেশেই এই রীতি নেই? ধাঁধায় ফেলে দেওয়ার মতো ব্যাপার। গাঠনিক দিক দিয়ে ভেবে দেখি উত্তর পাওয়া যায় কিনা! ক্রিকেট বিজ্ঞদের মতে, আদর্শ একটি একাদশে ৭ জন ব্যাটসম্যান এবং ৫ জন বোলার থাকা উচিত৷ এদের একজন অলরাউন্ডার। অন্যান্য দলকে এও অলরাউন্ডারের জায়গাটা নিয়েই দুঃশ্চিন্তায় পড়তে হয়। কিন্তু আমরা সাকিবের মতো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারকে সাথে নিয়েই খেলেছি ৯ ব্যাটসম্যান এবং ৪ বোলার নিয়ে। ব্যাটসম্যান সংখ্যা মাঝেমধ্যে ৮ হলেও বোলার থাকে চারজনই। যেখানে টেস্ট খেলাটাই হলো বোলারদের এবং ম্যাচ জেতার সবচেয়ে সহজ উপায় প্রতিপক্ষের বিশ উইকেট তুলে নেওয়া। সাকিব, মুশফিকের মতো এতো রক্ষণাত্মক মনোভাব নিয়ে দল সাজাতো? বিশ্বাস হয় না ঠিক। আবার কয়েকদিন আগের এগারো দফা (পরবর্তিতে তেরো) দাবীতেও এটা নিয়ে কিছু ছিলো না৷ যাই হোক, ধরে নিচ্ছি আংশিক ক্ষমতা থাকবে অধিনায়কের হাতে।

তো, সাফল্য পেতে দল নির্বাচনে অধিনায়ক মমিনুলকে কোন দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে? অবশ্যই বোলিংয়ে! যেহেতু সাকিব নেই, নেই আসন্ন সিরিজে কোনো জেনুইন অলরাউন্ডারও, তাই পাঁচ বোলার নিয়ে নামাই শ্রেয়। সাথে ভাবা উচিত পেসারদের নিয়েও। বোলিং শক্ত হলে প্রতিপক্ষ রান বাড়ানোর সুযোগ পাবে কম। এতে আমাদের ব্যাটসম্যানদের ওপর বিশাল রানের পাহাড়সম বোঝাটা থাকবে না। এতোদিন আমাদের মেন্টালিটি ছিলো ব্যাটিং দিয়ে ড্রয়ের জন্য খেলার বা কন্ডিশনের ফায়দা দিয়ে স্পিন আক্রমণ দিয়ে ঘায়েল করার। এতে ড্র’র বদলে পরাজয়ই বেশি আসতো, স্পিনও মাঝেমধ্যে বুমেরাং হয়ে যেতো। মমিনুলের উচিত এটা পাল্টানো৷ তৈরি করতে হবে বোলিংয়ের ওপর জোর দিয়ে ড্রয়ের জন্য খেলা৷ এতে ম্যাচ জয়ের সম্ভাবনাও তৈরি হয়। বাংলাদেশ এতোদিন যতো টেস্ট জিতেছে সবই কিন্তু জিতেছে বোলিংয়ের কারণে৷ মাশরাফির সময়ে ওয়ানডেতে উত্থানটাও শুরু হয়েছিলো বোলারদের হাত ধরে৷ ভালো ভাবে বললে পেস বোলারদের হাত ধরে৷ স্পিন আমাদের মূল শক্তি, তবে পেসারদের একেবারেই অবজ্ঞা করলে চলবে না।

আগেই বলেছি, মমিনুল হক অন্যরকম খেলোয়াড়। একটা নির্দিষ্ট ফরম্যাটে আটকে থাকা ছাড়াও, সে কিন্তু অন্যান্য খেলোয়াড়দের মতো না। ভালো পারফর্ম করলেও এসব নিয়ে তার তেমন তৃপ্তি নেই, উচ্ছ্বাস নেই। সব সময়ই আরো সাফল্য পেতে চায়। মাঠে ব্যাট হাতে খেলে আলোচনায় আসা ছাড়াও তেমন একটা আলোচনায়ও আসে না। দল থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা না তৈরি হলে হয়তো তার ফর্মও পড়ে যেতো না।

তাই আশা করছি তার ওপর। তার হাত ধরেই আসবে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পরিবর্তন। পরিবর্তন বলতে এতোটাও আশা করছি না যে ২০তম বর্ষপূর্তি আসতে আসতে আমাদের টেস্ট জয়ের সংখ্যা ২০ হয়ে যাবে, তবে আশা করছি হারের সংখ্যাটা ৯০ বা ৯১ এর বেশি হবে না।

 

Feature Image: ICC