মাইটি পাঞ্চ স্টুডিও ও বাংলাদেশের অ্যানিমেশন

captain kathan mighty punch studio

বাংলাদেশের অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে গড়ে তুলতে যে গুটি কয়েক অ্যানিমেশন স্টুডিও অবদান রেখে চলেছে, তাদের মধ্যে মাইটি পাঞ্চ স্টুডিও অন্যতম। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রোডাকশন হাউজটি গত ছয় বছরে তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক মানের অ্যানিমেশন, দেশি ক্যারেক্টার নিয়ে পাঁচটি কমিক সিরিজ যার মধ্যে শাবাস, মিস শাবাস  ও লাঠিয়াল উল্লেখযোগ্য।

তাদের কমিক্স এবং অ্যানিমেশনে  ফুটে ওঠে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ও শিল্প। ইংরেজি এবং বাংলা দুটো ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও শিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা এবং সেই সাথে বাংলা ছড়াগান ও বাংলায় অনুবাদিত কমিক্স দ্বারা দেশের মানুষের কাছে বাংলাদেশের অ্যানিমেশনকে জনপ্রিয় করে তোলা, মাইটি পাঞ্চ স্টুডিওর একটি অন্যতম লক্ষ।

এসব কিছু মাথায় রেখে মাইটি পাঞ্চ স্টুডিও গত বছর ঢাকা লিট ফেস্টে এ আয়োজন করেছিল এক ঘন্টা ব্যাপী ‘অ্যানিমেশন ইনভেশন’ প্যানেল এর। এই প্যানেলের পুরোটা জুড়েই ছিল একের পর এক মন ভোলানো সব অ্যানিমেশন যা উপস্থিত ছোট বড় সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।দুপুর ২:৪৫ থেকে ৩:৪৫ পর্যন্ত বাংলা একাডেমির কসমিকটেন্ট এ আয়োজিত হয় এই প্যানেলটি। পুরো টেন্ট জুড়ে ছিল দর্শকের সমাগম।

অ্যানিমেশন ইনভেশন শুরু হয় ‘টেপাতুলি’র উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। টেপাতুলি হল বাংলা ছড়াগানের অ্যানিমেশন সিরিজ, যা তৈরি হয়েছে চিরায়ত বাংলার টেপা পুতুল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। টেপাতুলি সিরিজের মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী মোট ১০ টা ছড়াগান নিয়ে অ্যানিমেশন তৈরির চিন্তাভাবনা রয়েছে। তার ভেতরে প্রথম চারটি ছড়াগানের উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয় এই প্যানেলে। উদ্বোধন এর জন্য উপস্থিত ছিলেন মিনা ট্রাস্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আমিনা আহমেদ। উল্লেখ্য যে মিনা ট্রাস্ট টেপাতুলি প্রজেক্টটির স্পন্সর।আমিনা আহমেদ এর সুন্দর এবং সাবলীল বর্ণনায় ফুটে ওঠে শৈশবের সেই মিষ্টি মধুর ছড়াগান গুলোর প্রেক্ষাপট। এর সাথে একে একে পর্দায় চলতে থাকে তাই তাই তাই, ঝড় এলো এলো ঝড়, কবিগুরুর আমদের ছোট নদী, এবংকাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি ছড়াগান গুলোর অসাধারণ অ্যানিমেশন।

আরো পড়ুন- বিটিভির ৭টি কার্টুন- যা আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেই ছোট্টবেলায়!

অনলাইনে এই ছড়াগান গুলোর অনেক অ্যানিমেশনই হয়ত পাওয়া যাবে। তবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ছড়াগান গুলোকে কম্পোজ করে, মন ভোলানো অ্যানিমেশনের দ্বারা টেপাতুলির এই ছড়াগান গুলোকে উপস্থাপন করার মাধ্যমে নিঃসন্দেহে তা দর্শকের মনে আলাদা একটি স্থান করে নিয়েছে।উপস্থিত দর্শকের করতালি যেন সেকথাই বলছিল। আমিনা আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে এত চমৎকার অ্যানিমেশন এর মাধ্যমে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানাই মাইটি পাঞ্চ স্টুডিওকে। এভাবেই নিজেদের শিল্প, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্যকে নিজেদের মাঝে এবং বাইরের বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে।‘

টেপাতুলির উদ্বোধন এর ঠিক পরপরই শুরু হয় ছড়াগান গুলোর লাইভ পারফরমেন্স, সেজন্য স্টেজে উপস্থিত হন জনপ্রিয় ব্যান্ড নেমেসিস এর ভোকালিস্ট যোহাদ চৌধুরী। এই চারটি ছড়াগানের মধ্যে দুটির কম্পোজিশন তিনি করেছেন, সেই সাথে ‘তাতির বাড়ি ব্যাঙের বাসা’ ছড়াগানটিও মাইটি পাঞ্চ স্টুডিওর জন্য তিনি নতুন ভাবে কম্পোজ করেছেন। এই ছড়াগানটি অবশ্য এখনওনির্মাণাধীন আছে। যোহাদ একোস্টিক গীটারেরসাথে মিষ্টি তিনটি ছড়াগান; তাই তাই তাই, ঝড় এলো এলো ঝড়, এবং তাতির বাড়ি ব্যাঙের বাসা গেয়ে শোনান, সেই সাথে দর্শক রাও সুর মেলান। উল্যেখ্য, চারটি ছড়াগানের মধ্যে ‘কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি’এবং ‘আমাদের ছোট নদী’ নতুন ভাবে কম্পোজকরেছেন ওয়ারফেয ব্যান্ডের ভোকালিস্ট পলাশ নূর।

আরো পড়ুনকমিক সুপারহিরো “থর” এর পেছনের গল্প

এর পর অ্যানিমেশন ইনভেশনের দ্বিতীয় পর্যায়ে দর্শকরা উপভোগ করেন ‘ক্যাপ্টেন কাঁঠাল-বাপের রাস্তা’ নামের ৭ মিনিটের একটি কার্টুন। মাইটি পাঞ্চ ইউনিভার্স এর ন্যায় বিচারক এবং কাঁঠাল প্রেমী সুপার হিরো ক্যাপ্টেন কাঁঠাল। এই অ্যানিমেশনটি তারা রিলিজ করেছিল এবছরের শুরুর দিকে। ট্র্যাফিক আইন না মানার সাজা কেমন হওয়া উচিত, ক্যাপ্টেন কাঁঠাল খুব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয় কার্টুনটিতে। দর্শকদের করতালি আর অট্টহাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ‘ক্যাপ্টেন কাঁঠাল-বাপের রাস্তা’ বেশ ভালোই উপভোগ করেছেন তারা। যদি এখনও এই কার্টুনটি দেখে না থাকেন, তবে মাইটি পাঞ্চ স্টুডিওর ইউটিউব চ্যানেলে গিয়ে দেখে আসতে পারেন।

ক্যাপ্টেন কাঁঠালের পর শেষ আকর্ষণ হিসেবে মাইটি পাঞ্চ স্টুডিও হাজির হয় তাদের নতুন একটি প্রজেক্টের কিছু অংশ বিশেষ নিয়ে। একদম শুরুতে টেপাতুলি প্রজেক্টটিতে যেমন তারা বাংলার লোক সংস্কৃতি টেপা পুতুল থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিল, তেমনি নতুন এই প্রজেক্টটিতে তারা অনুপ্রেরণা হিসেবে বেছে নিয়েছে বাংলাদেশের গৌরব সুন্দরবনকে। বাংলাদেশের শিশুদের সুন্দরবন সম্পর্কে, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বৈচিত্র, প্রাণী জগত সম্পর্কে জানাতে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে তাদের সচেতন করে গড়ে তুলতে এই প্রজেক্টটি নিয়ে তারা কাজ করছে। এ ব্যাপারে মাইটি পাঞ্চ স্টুডিওর সিইও এবং ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর সামির আসরান রহমান বলেন, ‘সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে একটি অ্যানিমেশন সিরিজ তৈরি করার ইচ্ছেটা আমার সবসময়ই ছিল। সুন্দরবনের বন্ধুরা সিরিজটির মাধ্যমে আমরা ছোট বাচ্চাদের জন্য মজার এবং শিক্ষনীয় গল্প তৈরি করতে চাই। এই গল্পগুলো শিশুদের পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি আরও মনযোগী হতে এবং সঠিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে বলে আশা করছি।‘

animation of bangladesh
সুন্দরবনের বন্ধুরা

সুন্দরবন কে মাথায় রেখে করা এই প্রজেক্টটির নাম ‘সুন্দরবনের বন্ধুরা’। কারা এই বন্ধুরা? তার জবাবেই একে একে সেই বন্ধুদের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেন তারা। বাঘ বন্ধুটির নাম হল বাঘা, যেকিনা খুব শরগোল করতে পছন্দ করে। সেই সাথে সে আবার খুব রূপ সচেতন ও বটে! বানর বন্ধুটির নাম তারা রেখেছে লালু, লালু খুব দুষ্টুমি করে বেড়ায়। আর কি করে আরও লম্বা হওয়া যায় সেই উপায় খুঁজতে থাকে!এরপরে আছে চিতু, হরিণ বন্ধুটি। সে বাগান করতে, পাখিদের আশ্রয় দিতে খুব ভালবাসে। সেই সাথে সে খুব গোছাল, তবে মাঝে মাঝে এ ব্যাপারটা নিয়ে সে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলে! কুমু হল কুমির বন্ধুটির নাম। সে খুব বন্ধুসুলভ এবং পরিবেশবাদী। তবে মাঝে মাঝে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করতে যেয়ে একটু ঝামেলায় পড়ে যায়! শিয়াল বন্ধুটির নাম তিতলি। সে বই পড়তে এবং পাতার বাঁশি বাজাতে খুব ভালোবাসে। উপরন্তু সে কিন্তু একজন স্বঘোষিত কবিও বটে! সর্বশেষ তারা পরিচয় করিয়ে দেয় কচ্ছপ বন্ধুটির সাথে, যার নাম ধীরু। সে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক কিন্তু বাকীদের খেলার সাথী এবং শিক্ষক। সে বাচ্চাদের অত্যন্ত স্নেহ করে। তবে মাঝে মাঝে তার স্মার্ট ফোন এবং সোশাল মিডিয়ার প্রতি আকর্ষণটা বেড়ে গেলে বাচ্চাদেরই সেটা সামাল দিতে হয়!

blank
মাইটি পাঞ্চ স্টুডিও টিম

এমনিভাবে মজার কিছু বৈশিষ্ঠ্যের  সংমিশ্রণে তারা তৈরি করেছে ‘সুন্দরবনের বন্ধুরা’ প্রজেক্টটির চরিত্রগুলোকে। তাদের ছবিসহ বর্ণনার পর সম্ভাব্য কিছু গল্পের পোস্টার দেখানো হল এবং পরিশেষে দেখানো হল সুন্দরবনের সেই বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করা এক মিনিটের একটি অ্যানিমেটেড ইন্ট্রো। ইন্ট্রোটিতে সুন্দরবনের বন্ধুদের সাথে আর একবার পরিচয় হয় দর্শকদের।

এরই মধ্য দিয়ে শেষ হয় এবারের ঢাকা লিট ফেস্টে, মাইটি পাঞ্চ স্টুডিও আয়োজিত এক ঘন্টার অ্যানিমেশন ইনভেশন প্যানেলটির। সামনে আরো বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হবে বাংলাদেশের এই অ্যানিমেশন স্টুডিওটি।

লেখকঃ আসমা উল হুসনা সঞ্চিতা। কার্টুন এবং অ্যানিমেশন ভক্ত। কর্মরত আছেন মাইটি পাঞ্চ স্টুডিও তে স্ট্রাটেজিস্ট এবং হেড অফ অপারেশন্স হিসেবে।