মিশন পসিবল সোনাদিয়া!

রাত বারোটা পর্যন্ত জেগে থাকা হল, দুই বোনের সাথে অনেক কথা। সাত  বছর পর খালাতো ভাই বোনদের সাথে অনেক কথা, কিন্তু ঘরে তো আরও মানুষজন আছে। ঘরের একপাশের বিছানায় খালু ঘুমিয়েছেন, লম্বা ঘরের আরেক প্রান্তে আমরা তিনজন। অনেকখন এটা সেটা নিয়ে কথা বার্তা চলল। শেষ পর্যন্ত বড় আপু ভেটকি (আসল নাম রেশমি)বলল তুই এখনও বোকা-সোকা রয়ে গেছ, তোর দুলা ভাই বলে এখন নাকি আর বোকা মানুষ নাই। এবার কুরবানির ঈদের আসলে তোকে দেখামু।  আমি হাসি…।

অত:পর ঘুমের রাজ্যে হারাতে আমারও সময় লাগল না, শোয়া মাত্র না হলেও কয়েক মিনিট পর গভীর ঘুম। সে ঘুম খুব সঙ্গোপনে ভেঙ্গে গেল, আচমকা ঘুম ভাঙ্গা মানে জাস্ট চোখের পাতা খুলে যাওয়া। এ অবস্থায় আঁতকে বা নড়ে ওঠা আমার স্বভাবে নেই। কী কারণে ঘুম ভাঙ্গল, সেটা বোঝার জন্য নিজেকে কয়েক সেকেন্ড সময় দেই। তারপর প্রয়োজনীয় নড়াচড়া। ঘুম ভেঙ্গেছিল এক ঝাঁক পাখির চেঁচামেচি আর টিনের চালে ধুপধাপ করে বসার শব্দে। অনেক পাখি। একবার আমাদের ঘরের চালে, সেখান থেকে আরেক ঘরের চাল ও গাছ। এভাবে ছুটোছুটি করছিল, যেন একদল মিলে কাউকে ধাওয়া করেছে। বুঝলাম, রাত বিরেতে এক বা একাধিক পাখি কোন অপরাধ করেছে, তার জন্যই ধাওয়া ও বকাবকি। গভীর ঘুম নিঃশব্দে যেমন ভাঙ্গল, তেমনি চুপিচুপি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। এরপর ঘুম টুটে গেল শীত শীত ভাব আর বৃষ্টির শব্দে।

টিনের চালে ঝুম বৃষ্টির শব্দ, এ অভিজ্ঞতা বলে বোঝানো কঠিন। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা চরাচর, যাকে বলে সগর্জনে ‘ঠাডা’ পড়ছিল। টেবিল ফ্যান বেশ শীত ছড়াচ্ছিল, বিছানা ছেড়ে উঠতেই হল। সব আলো নেভানো, তবে ঘরে আলোর অভাব ছিল না। আমি খালুকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার দিকে ফিরেই শুয়ে আছেন। খাবার ঘর থেকে আসা আলোয় দেখলাম, তিনি ‘কুঁতকুঁতে’ চোখে আমার দিকে চেয়ে আছেন। ‘কুঁতকুঁতে’ মানেই একটু অস্বাভাবিক আর উদ্দেশ্যপূর্ণ যাকে বলে আরকি। নিজের সম্মানিত খালুর ক্ষেত্রে এই শব্দটা প্রয়োগ স্বাভাবিক সেন্সেই শোভন নয় কিন্তু সেটাই ছিল সঠিক ভাবের সঠিক বহিঃপ্রকাশ। খালুর তাকানোতে আসলেই একটা উদ্দেশ্য ছিল। উনি আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, রাতেই টের পেয়েছিলাম। প্রায় ১৫ বছরের কম নয়, তার সাথে আমার এই সাক্ষাত পর্ব। খুব পছন্দ করতাম ছোট বেলা থেকেই, আবার ভয়ে বিনা কাজে কাছে ঘেঁষতাম না। ঢাকাতে কর্মজীবন কেটেছে তার, বাসা ছিল বুড়ি গঙ্গারতীরে বাবু বাজারের আশে পাশে। অনেক রাগী মানুষ বলে জানতাম, তবে বাচ্চাদের সামনে রাগতে দেখা যেত না। ১৫ বছর পর দেখা, সালাম দিয়ে হাত মেলাতেই তিনি বিব্রত হয়ে ছিলেন। এ ঘটনা সন্ধ্যায়, আমি সে বাড়িতে পৌঁছেছিলাম আসর নামাজের পর পর। মিলাদশেষে পুত্রহারা খালুর সাথে দেখা করার সময়টা আমার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। তিনি আমাকে চিনতে পারছেন, অনেককেই চিনতে পারেন না আজকাল। সব কিছুই ভুলে যান কিছুক্ষণ পর পর।

আমাকে সামান্য নড়তে দেখে খালুর চোখ আরেকটু কুঞ্চিত হল। নিভৃত মধ্য সোনদিয়া  গ্রামে বৃষ্টিঝরা রাতে আমি অবাক হলাম খালুর দিকে তাকিয়ে।খালু আমার দিকে চেয়ে আছেন, এই চেয়ে থাকায় বড়সড় অস্বস্তি আছে। আমি যে বিছানায় শুয়ে, সে বিছানায় থাকার কথা সায়মনের। খালুর ছোট ছেলে, যিনি সদ্যপ্রয়াত, সায়মন এই বিছানায় নেই, এটা খালুর জন্য অস্বস্তি। নিরাপত্তার বিষয় আছে, অসুস্থ মানুষটির মধ্যে বয়সের ভয় জেঁকে বসেছে। রাতে অনেকবার উঠে সব দরজা জানালা চেক করেন।

হুমায়ূন স্যারের হিমু টাইপ চরিত্র এই সময়ে যা করত, আমিও তাই করার সিদ্ধান্ত নিলাম। খালুকে একটু ভড়কে দিতে হবে, তা না হলে আমার দিক থেকে মনোযোগ সরানো যাবে না। আর আমাকে নিয়ে ভাবতে গেলে তিনি বিস্মৃতির আড়ালে অস্বস্তি বোধ করবেন। ভয় বাড়বে। সেটা কমানোর জন্যই খালুকে ভড়কে দিতে হবে। তাঁর কাছে যাওয়া যাবে না, কথা বললে পাশের রুমে আপা-ভাবী-বাচ্চাদের ঘুম ভেঙ্গে যাবে। বিকল্প হাতের কাছেই ছিল। পায়ের কাছে বিছানার পাশে থাকা স্ট্যান্ড ফ্যানটার স্পিড কমানোর সুইচ বিকল, নেমে সেটার মুখ ঘুরিয়ে দিলাম। এতে করে যে নড়াচড়া আর শব্দ হল, তাতেই খালুর চোখ থেকে সন্দেহ আর প্রশ্নের রেখা মিলিয়ে গেল। তিনি বিছানা থেকে নেমে একে একে সব ঘরের দরজার খিল পরীক্ষার কাজে লেগে গেলেন। বেশ খানিক সময় ব্যস্ত থাকার পর তিনি আমার কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। বিছানায় গিয়ে এবার আর আমার দিকে ফিরে শুলেন না। অন্যদিক ফিরে শুয়ে পড়লেন, দেখতে দেখতে আমিও ঘুমের রাজ্যে। ঘুম ভাঙল পাখির সুতীব্র কলরবে, খুব ভোরে।

দুপুর নাগাদ রওয়ানা করব বাড়ির উদ্দেশে, সকালের আলস্যভরা বিছানায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে পেরে নিজেকে বেশ উৎফুল্ল মনে হচ্ছিল। উঠি উঠছি করতে করতে দশটা পার। কেউ ডাকে না, আমিও নড়ি না। মটকা মেরে পড়ে আছি, ফাঁকে ফাঁকে চোখ মেলে দেখে নিচ্ছি এদিক ওদিক।শেষ পর্যন্ত ছোট বোনটা নাক ধরে একটা হেঁচকি টান দিলেন সাথে একটা হি:হি: হাসি। নাস্তা খেতে বসে ভাগ্নে ভাস্তে আর ছোট ছোট বোনের দাওয়াত পেলাম। বিকেলে ঘুরতে যাবে।

দুপুরের খাবার খেয়ে কিছু বিশ্রাম নিলাম। তারপর বের হলাম ঘুরতে। এখানে ছোটকালে অনেক এসেছি এবং বড় আপুর সাথে এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি ত’ অনেক করেছি। সব কিছু আমার মুখস্ত। কিন্তু আজ পরিচিত দৃশ্য কে অপরিচিত লাগছে। গ্রামের ছনের ঘরের বদলে উঠেছে টিনের ঘর, টিনের ঘর কনভার্ট হয়েছে দালান। সবকিছু অতি দ্রুত ঘটেছে।

প্রথমে গেলাম কুবিরখালি  যেখানে আমি আর বড় আপু ছেলে বেলায় এখানে আসতাম বাদাম কিনতে। সে সময় মাত্র একটি ছোট টিনের দোকান ছিল। এখন অনেকগুলো বড় বড় দোকান উঠেছে।

তারপর গেলাম মাদ্রাসা মাঠে। মস্ত বড় মাঠ ছিল এক সময় এখন সংকীর্ণ। ছোটকালে খালা বাড়ি আসলে এ জায়গাটা আমাকে বড় টানত। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কোরআন পড়া চলত একটানা। আমার একটা আয়াত এখনও বেশী মনে পড়ে- “ফাবিয়াইয়া লা ইলা রাব্বিকুমা তুকাযজিবান” তোমরা কি তোমার প্রভু অনুগ্রহ অস্বীকার করিবে)। কিন্তু সেখানে এখন আর মাদ্রাসা নেই। মাদ্রাসা ভবনটি জড়াজীর্ণভাবে পড়ে আছে। সেখানে কিছু পোলাপাইনকে দেখলাম টাকা দিয়ে টাস খেলতে। মনে বড় কষ্ট্ পেলাম তাই সেখানে বেশীক্ষন ছিলাম না।

সেখান থেকে গেলাম নদীর পাড়। নদীটি পদ্মার পেট ফেড়ে বের হয়ে ধোপখালি বাজারের পাশ দিয়ে সৈয়দ  পাড়ায় গিয়ে আরো দুটি নদীর সাথে মিশে ত্রি-মোহনা সৃষ্টি করেছে। এই নদী দিয়ে জেলা শহরের সাথে  যোগাযোগ করা যায়। নদীর উপর একটি বড় বেইলি ব্রিজ দেখলাম।ব্রিজে বসে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। অত:পর সেখান থেকে আবার খালু বাড়িতে হাটা ধরলাম। উদ্দেশ্যে রাতের লঞ্চে ঢাকা ফিরব।