কথায় বলে, পৃথিবীতে ঘটা প্রত্যেক ঘটনার পেছনেই একটা কারণ থাকে। আসলেই কি তাই? সত্যিই কি বাস্তবে ঘটা সবকিছুর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব? কো-ইন্সিডেন্স বা কাকতালীয় বলতে আসলেই কি কিছু নেই? কে জানে! হয়ত আছে, হয়ত নেই! বাংলাহাবের পাঠকদের জন্য সাধারণের দৃষ্টিতে কাকতালীয় হিসাবে স্বীকৃত কিছু ঘটনা নিয়ে তিন পর্বের একটা ফিচার সাজিয়েছি আমরা। প্রথম পর্বের আজকের লেখায় চলুন জেনে আসা যাক কিছু কাকতালীয় ঘটনা সম্পর্কে।

আব্রাহাম লিংকন ও জন এফ কেনেডি
কাকতালীয় ঘটনার জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত হল মার্কিন দুই সাবেক প্রেসিডেন্ট- আব্রাহাম লিংকন ও জন এফ কেনেডি। চলুন দেখা যাক তাদের মাঝে কি কি মিল পাওয়া যায়! দুজনেরই নামের শেষ অংশ লিংকন (Lincoln) এবং কেনেডি (Kennedy) লিখতে ইংরেজি সাতটি বর্ণের দরকার হয়। লিংকন কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৮৪৬ সালে। আর জন এফ কেনেডিও কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন ঠিক একশ’ বছর পর- ১৯৪৬ সালে। দুই প্রেসিডেন্টই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন এবং ঘটনা ঘটে একই দিনে- শুক্রবারে। দুজনই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। দুজনের মৃত্যুর সাথেই ফোর্ড কোম্পানী জড়িত- একজনের মৃত্যু হয় ফোর্ড কোম্পানীর থিয়েটারে, অন্যজনের গাড়িতে। দুজনের আততায়ীই ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকান এবং দুই প্রেসিডেন্টের উত্তরসূরীও ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার বাসিন্দা। মজার ব্যাপার হলো, সেই দুই প্রেসিডেন্টেরই নামের শেষে ছিল ‘জনসন’। লিংকনের উত্তরসূরী হন অ্যান্ড্রু জনসন আর কেনেডির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হন লিন্ডন জনসন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো তাদের দুজনের জন্মই হয়েছিল ১০০ বছরের ব্যবধানে। অ্যান্ড্রুর জন্ম ১৮০৮ সালে এবং লিন্ডন জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৮ সালে। লিংকন ও কেনেডির হত্যাকারী বুথ এবং অসওয়াল্ড দুজনকেই বিচারের আগে মেরে ফেলা হয়। এতটা মিল থাকা কি কাকতালীয় নয়?

রাসপুতিনের ভবিষ্যতবাণী
রাশিয়ান দার্শনিক গ্রিগরি রাসপুতিনের দুয়েকটি ঘটনার কথা হয়ত সবাই শুনেছেন। কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া রাসপুতিন তার অদ্ভুত রোগ সারানোর ক্ষমতার কারণে একসময় রাশিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসের সভায় জায়গা করে নেন। তার চমৎকার ভবিষ্যতবাণী করার গুণের কারণে খুব দ্রুতই সম্রাজ্ঞী আলেকজান্দ্রা ফিওদোরোভ্‌নার সাথে তার খুব ভাল খাতির হয়ে যায়। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে রাজ পরিবারের সাথে এমন দহরম-মহরম সম্পর্ক তখনকার সেন্ট পিটার্সবার্গের অভিজাত সমাজ সহজ ভাবে নিতে পারেনি। শুরু হয় তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র। বিষ খাইয়ে, অমানুষিকভাবে পিটিয়ে, এমনকি বেশ কয়েকবার গুলি করেও তাকে হত্যা করা যায় নি, কিন্তু তার শেষ রক্ষাও হয়নি। হাত-পা বেঁধে তাকে নদীতে ফেলে দেয়া হয়, পানিতে ডুবেই মারা যান তিনি। মৃত্যুর আগে তিনি সম্রাটকে এক চিঠি লিখেন। তাতে লেখা ছিল- তাকে যদি কখনো হত্যা করা হয় তাহলে তার মৃত্যুর বছরখানের মাঝে সম্রাটও স্বপরিবারে নিহত হবেন। এবং সত্যি সত্যিই তা-ই ঘটেছিলো। রাসপুতিন মারা যাবার মাত্র দেড় বছরের মাথায় সম্রাট, সম্রাজ্ঞী এবং তাদের পাঁচ সন্তান নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন। এই ঘটনাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

blank

গ্রিগরি রাসপুতিন

অপেক্ষামান বুলেট
হেনরী জিগল্যান্ড ১৮৮৩ সালে তার প্রেমিকার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। মেয়েটি সত্যি সত্যিই জিগল্যান্ডকে অনেক ভালোবাসত। বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা তাই সে সহজভাবে নিতে পারেনি, আত্মহত্যা করে বসে। এদিকে একমাত্র বোনকে হারিয়ে প্রতিশোধ পরায়ন ভাই দিশেহারা হয়ে জিগল্যান্ডকে গুলি করে, পরে নিজেও আত্মহত্যা করে। ভাই-বোন দুজন মারা গেলেও অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে যায় জিগল্যান্ড। বুলেটটি তার গায়ে সামান্য আঁচড় কেটে পাশের একটি গাছে গেঁথে যায়। কিন্তু জিগল্যান্ডের ফাঁড়া তখনও কাটেনি। এরমাঝেই কয়েক বছর পেরিয়ে যায়। জিগল্যান্ড সেই বুলেট গেঁথে যাওয়া গাছটি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। গাছটির গুঁড়ি এত বিশাল ছিল যে সেটা কুড়ালে না কেটে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়াটা তার কাছে বেশি সহজতর মনে হয়। কিন্তু এরপরের ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। গাছের গোড়ায় ডিনামাইট ফাটানোর সময় আটকে থাকা সেই বুলেটটি ছিটকে বেরিয়ে আসে এবং সরাসরি তার মাথার খুলিতে ঢুকে যায়! তবে কি বুলেটটি এতদিন সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিল?

রাজা লুইস ও আনলাকি ২১
ফ্রান্সের রাজা ১৬তম লুইস যখন বালক ছিলেন তখন এক জোতিষী তাকে বলেছিল যে ২১ সংখাটি তার জন্য শুভ নয়। তিনি যেন প্রতি মাসের ২১ তারিখে একটু সাবধান থাকেন। এই সতর্কবাণী তার কিশোর মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাই তিনি যখন ফ্রান্সের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন, প্রতি মাসের ২১ তারিখে সমস্ত রাষ্ট্রীয় কাজ বন্ধ রাখতেন, ঘর থেকেই বের হতেন না। কিন্তু কথায় আছে না- কপালের লিখন, না যাবে খন্ডন! শেষ রক্ষা হয়নি তারও। ১৭৯১ সালের ফ্রান্স বিপ্লবের সময় ২১শে জুন রাজা লুইস ও তার রানীকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২১শে সেপ্টেম্বর থেকে ফ্রান্সের রাজতন্ত্র বাতিল করে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়। এরপর ১৭৯৩ সালের ২১শে জানুয়ারীতে রাজা লুইস-এর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। শেষ পর্যন্ত ২১-ই খেলো তাকে, কি বলেন!

এগারোময় ১১
কেপটাউন, সাউথ আফ্রিকা বনাম অস্ট্রেলিয়ার প্রথম টেস্টের ৩য় দিনের খেলা চলছে। ঘড়ির কাটায় তখন ঠিক ১১টা বেজে ১১ মিনিট, হঠাৎ করেই সবকিছু যেন এগারো ময় হয়ে গেল! সাউথ আফ্রিকার জয়ের জন্য তখন প্রয়োজন ছিল আর ১১১ রান। দিনটি ছিলো ১১ই নভেম্বর, ২০১১ অর্থাৎ ১১/১১/১১! সেই সময়টায় সাউথ আফ্রিকা দলের কারেন্ট রান রেট ছিলো ৩.৮ যা যোগ করলে যোগফল দাঁড়ায় ১১। অস্ট্রেলিয়া তাদের সামনে টার্গেট দিয়েছিল ২৩৬ রানের, এটিও যোগ করলে হয় ১১। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, তখনও দিনের খেলার আরো ৮৩ ওভার বাকি ছিলো, সেটিরও যোগফল ও ১১! কাকতাল? অবশ্যই! তা নয়ত আর কি বলবেন?

blank

স্কোর বোর্ডে সেই এগারোময় মূহুর্ত

মার্ক টোয়েন ও হ্যালির ধুমকেতু
বাচ্চাকালে হ্যালির ধুমকেতুর কথা স্কুলে পড়েছিলেন না, যেটি প্রতি ৭৫ বছর পরপর পৃথিবির সাথে দেখা করতে আসে? এই ধুমকেতুর সাথে বিখ্যাত আমেরিকান উপন্যাসিক মার্ক টোয়াইনের অনেকটাই মিল আছে। মার্ক টোয়াইন জন্মগ্রহন করেন ১৮৩৫ সালে। সেই বছর আকাশে হ্যালির ধমকেতু দেখা গিয়েছিল। এর ৭৫ বছর পরে ধমকেতুটি আবার দেখা যায় ১৯১০ সালে। এই বছরই মার্ক টোয়াইন মারা যান। মৃত্যুর এক বছর আগে তিনি একবার এক সেমিনারে বলেছিলেন – ‘আমি এসেছিলাম হ্যালির ধুমকেতুর সাথে। আগামী বছর সেই ধুমকেতু আবার আসছে, হয়ত আমাকে নিয়ে যেতে’। আদতে হয়েছিলও কিন্তু তা-ই।

 

অভিশপ্ত পোর্শে
১৯৫৫ সালে সেপ্টেম্বরে জেমস ডীন তার পোর্শে কারটি চালানোর সময় এক্সিডেন্টে মারা যান। ঘটনা কিন্তু এখানেই শেষ নয়, শুরু হল মাত্র! গাড়িটি গ্যারেজে নিয়ে আসার পরে নিজে থেকেই এর ইঞ্জিন খুলে পড়ে! নিচে কাজ করতে থাকা এক মেকানিকের পা পিষ্ট হয়ে যায় এতে। পরে দুজন আলাদা ব্যক্তি এই গাড়ির ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ কেনে নিজেদের রেসিং কারে লাগানোর জন্য। দুজনই একই কার রেসে অংশ নিয়ে দূর্ঘটনায় পড়েন, দুজনেই মারা যান! গাড়িটিকে একসময় সম্পূর্ণ ঠিক করে গ্যারেজে রাখা হয়, পরদিনই আগুন লেগে গ্যারেজ পুড়ে যায়! কুফা পিছু ছাড়ছে না দেখে গাড়িটি একটি প্রদর্শনীতে পাঠানো হয়। সেখানে গাড়িটি ঝুলিয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে গাড়িটি পড়ে পাশে দাঁড়ানো এক কিশোরের কোমর ভেঙ্গে দেয়! এরপর গাড়িটি ট্রাকে করে অন্য এক শহরে নিয়ে যাবার সময় ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের এক দোকান ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়ে! সর্বশেষ ব্যাখ্যাতীত ঘটনাটি ঘটে ১৯৫৯ সালে। গাড়িটি কোন কারণ ছাড়াই ভেঙ্গে ১১ টুকরাহয়ে পড়ে! কি ভয়ংকর গাড়িরে বাবা!

blank

জেমস ডিন ও তার পোর্শে

To be continued...