রেনেসাঁ যুগের স্থাপত্যকলার নিদর্শন- বালিয়াটি জমিদার বাড়ি

প্রাচীন স্থাপনাগুলো কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে জন্ম থেকে জন্মান্তরের পথে। প্রতিটি ইটের ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে রাখা ইতিহাস উঁকি দেয় সময়ের খোঁজে। কতশত মানুষের বেড়ে ওঠা থেকে চলে যাওয়ার অম্লান স্মৃতি বুকে নিয়ে পাড়ি দেয় মহাকালের স্রোত৷ বালিয়াটি জমিদার বাড়ির প্রতিটি স্থাপনাও বয়ে বেড়াচ্ছে কয়েক পুরুষের ইতিহাস।

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় ১৯ শতকে তৈরি করা হয়েছিল বালিয়াটি জমিদার বাড়ি। এটি বালিয়াটি প্রাসাদ নামেও বেশ সুপরিচিত। গোবিন্দ রাম সাহা নামক একজন লবন ব্যাবসায়ী বালিয়াটি জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর ছিল চার পুত্র। দধী রাম, পন্ডিত রাম, আনন্দ রাম ও গোপাল রাম। শুরুতে বর্তমানে দাঁড়িয়ে থাকা সবগুলো স্থাপনা ছিলো না। জমিদার বংশের একেক বংশধর প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন সময়ে বাড়ির স্থাপনাগুলো তৈরি করেছেন। এরমধ্যে গোবিন্দ সাহার চার পুত্রের অবদানই বেশি বলে ধারণা করা হয়। বাড়ির বংশধরেরা শুধু বালিয়াটি জমিদার বাড়িতেই স্থাপনা তৈরি করেননি। তাদের স্থাপনার নিদর্শন মেলে অন্যত্রও। এই বংশের অন্যতম পরিচিত জমিদার ছিলেন, কিশোরিলাল রায় চৌধুরী ও রায়বাহাদুর হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী- যারা তৎকালীন সময়ে বেশ বিখ্যাত ছিলেন শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অবদানের জন্য। বর্তমানে ঢাকার অন্যতম সুপরিচিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কিশোরিলাল রায় চৌধুরীর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরী।

 

২নং প্রাসাদ, বর্তমানে যেখানে জাদুঘর; Image Source: তাসমিয়া তাবাসসুম

বালিয়াটি জমিদার বাড়িতে সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে মোট আটটি স্থাপনা। পাঁচটি ব্লকে ভাগ করে তৈরি করা হয়েছে যেগুলো। ভবনগুলো নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে রেনেসাঁ যুগের স্থাপত্যকলা। প্রতিটি ভবন তাই সগৌরবে জানাচ্ছে রেনেসাঁ যুগের সুনিপুণ স্থাপত্যকলার প্রত্যক্ষ ইতিহাস। শুরুর বালিয়াটি প্রাসাদটি ৫.৮৮ একরের ওপর নির্মাণ করা হলেও বিভিন্ন সময়ে নির্মিত স্থাপনা নিয়ে ২০ একরের বেশি জায়গা ঘিরে পূর্নতা পেয়েছে বাড়িটি। ২০০টি ছোট বড়ো কক্ষের সমাবেশে ঘটেছে প্রাসাদগুলোর অভ্যন্তরে। বাড়ির চারপাশ সুউচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত। দক্ষিণ প্রাচীরে বাড়ির প্রধান ফটক। এই প্রাচীরেই পাশাপাশি একই কারুকাজে নির্মিত হয়েছে চারটি সিংহের মূর্তি খচিত খিলান দরজা। বর্তমানে দুই নাম্বার দরজাটি দর্শনার্থীদের প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাকি তিনটি বন্ধ রাখা হয়েছে৷ ভেতরে প্রবেশ করতেই শিরদাঁড়ায় বয়ে যায় একধরনের শান্তির শীতল পরশ। একই সারিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে চোখ ধাঁধানো চারটি ভবন। যা ব্যবহৃত হতো জমিদারির ব্যবসায়িক কাজে৷ প্রথম চাহুনিতেই বোঝা যাবে এই বাড়ির বিশেষত্ব হচ্ছে বিশাল আকৃতির আকর্ষণীয় করিনথিয়াম থাম। যা এক নজরে সৌন্দর্য পিপাসুদের মন কেড়ে নিতে সক্ষম।

রেনেসাঁ যুগের কারুকাজ খচিত ৪নং প্রাসাদ; Image Source: তাসমিয়া তাবাসসুম

ভবন চারটির ঠিক পেছনেই ছিল বাড়ির অন্দরমহল। অন্দরমহলের পাশ ঘেষে পেছনের সারির সর্ববামের শেষের ভবনটিতে ঠাই হত বাড়ির চাকর বাকর ও গাড়ি বা যন্ত্রপাতির। শোনা যায় এখানে ছিল ঘোড়াশালও। ভবনটির বেশিরভাগ অংশেই কাঠের সুনিপুণ কারুকাজে মোড়ানো। অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে, মিইয়ে যাচ্ছে ভবনে বসবাসকারীদের স্মৃতির মতোই। কয়েক পা পিছিয়ে একটু ডানে চোখ দিতেই দেখা যাবে অন্দরমহলের নিরবে দাঁড়িয়ে থাকা। একটা সময় এখানেই বয়ে গেছে শত সহস্র হাসির কলকাকলি, কত নবজাতকের কান্নার সুখময় সুর, জমেছে অন্দরমহলের রমনীদের গল্পের আসর। ভবনগুলো যেন হারিয়েছে তাদের যৌবন, নুয়ে পড়েছে বার্ধক্যের ভারে। দুটি জোড়া অন্দরমহলের দুই পাশে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে আছে সুন্দর রাস্তা। সবুজের বুক চিরে সে রাস্তা চলে গেছে দীঘির পাড়ে।
রাজবাড়ি মানেই তো বিশাল বাড়ির সাথে থাকা চাই সুন্দর সজ্জিত শান বাঁধানো ঘাটের স্বচ্ছ পানির টলমলে দীঘি! যেখানে রাজকুমারী সখীদের সাথে খেলবে জলকেলি। গোসলের ফাঁকে হাসি ঠাট্টায় মাতোয়ারা হবে চারপাশ। বালিয়াটি জমিদার বাড়ির দীঘিও তার বাইরে নয়৷ বরং একটু বেশিই শান শওকত নিয়ে সম্পর্ক গড়েছিল বাড়িতে বসবাসকারীদের সাথে। একটা দুটো নয় সাত সাতটা ঘাটের দেখা মিলবে এই দীঘিতে। দুটো জোড়া ঘাট ও তিনটে একক ঘাট নেমে গেছে দীঘির তলদেশে। পাড় ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে সুবিশাল স্নানাগার। শেষপ্রান্তে দেখা যাবে সারিবদ্ধ শৌচাগারও।

২ নং ও ৩ নং প্রাসাদের অন্দরমহল; Image Source: তাসমিয়া তাবাসসুম

শুরুর চারটি প্রাসাদের বাম থেকে দুই নাম্বার প্রাসাদটি এখন জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে৷ এই ভবনটিই রংমহল নামে খ্যাত ছিল। জাদুঘরে ঢুকতেই হলঘরের চারপাশ ঘিরে দেখা যাবে লোহার সিন্দুক। ভাঙা, নষ্ট অকেজো এইসব সিন্দুক একসময় ছিল অন্দরমহলের আরাধ্যের বস্তু। হলরুম থেকে সবগুলো কক্ষ বন্ধ করে রাখা হয়েছে৷ বছর দুই আগে একবার এসে তিনটা কক্ষ খোলা পেয়েছিলাম। অভিভূত হয়ে দেখেছিলাম পর্বতসম লোহার কারুকাজ খচিত দেয়াল সিন্দুক ও লকার। একটি সুবিশাল সিন্দুকে ছিল ৯১ টি বর্গাকৃতির লকার। এর পাশের আরেকটি কক্ষে ছিল বংশের নামকরা জমিদারদের ছবি। বুকে আক্ষেপ চেপেই দোতলার সিড়ি মাড়ালাম। কাঠের সিড়িতে কারুকাজ মণ্ডিত ঢালাই লোহার রেলিং।

অন্দরমহলের পাশের প্রসস্ত রাস্তা ও সবুজের সমারোহ; Image Source: তাসমিয়া তাবাসসুম

ছোটবেলায় কত মানুষকে বলতে শুনেছি কিংবা নিজেও বলেছি, “তোকে তো হ্যাজাক লাইট দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না!” খুব দেখার শখ ছিল রূপকথায় শোনা ময়ূরপঙ্খীর মতো এই বিরল বস্তুটিকে। ব্যস্ততার কষাঘাতে পিষ্ট হওয়া শখটি আচমকাই পূরণ হয়ে গেল বালিয়াটি জমিদার বাড়িতে এসে। বাড়ির সংরক্ষণশালার দোতলার প্রথম কক্ষে প্রবেশ করেই দেখা মিলবে প্রাসাদে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করা নানান রঙে-ঢংয়ের বাতি- হারিকেন। বাম পাশের একটা কাচঘেরা সংরক্ষণ শো-কেসে অনেকগুলো হারিকেন-বাতির সাথে জায়গা ভাগাভাগি নিয়েছে একটি হ্যাজাক লাইট। বাতি-হারিকেনের কক্ষ ছেড়ে সামনের কক্ষে ঢুকতেই খুঁজে পাওয়া গেল অনেকগুলো আমিকে! আয়না ঘর! বাড়ির অধিকারীদের অন্দরমহলে ব্যবহৃত বিভিন্ন আকারের ও নকশার আয়না দিয়ে সাজানো হয়েছে কক্ষটিকে। আয়নাগুলো অপূর্ব কারুকাজ খচিত বেলজিয়াম আয়না। বের হতে হতে দেখা যাবে দরজার দুপাশে দুটি শ্বেতপাথরের নন্দী। এরপরের কক্ষটিতে তৎকালীন সময়ের কিছু কাঠের আসবাব। যার কারুকাজ দেখে মিলবে চোখের শান্তি। দেখা যাবে আমাদের বর্তমান সময়ের টয়লেট কমোডের প্রাচীন ভার্সন, কাঠের কমোড! পাশেই আছে অপূর্ব কারুকাজ খচিত কাঠের খাট ও পাদস্তম্ভ। সামনে তাকাতেই দেখা যাবে “বাহির” নির্দেশিত দরজা। বের হতে হতে মনে মধ্যে অনেক কল্পনা উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে। কেমন ছিল সেই সময়টা! বাড়ির বসবাসকারীরা কী ভেবেছিল কতশত অপরিচিত মানুষ এসে ছুঁয়ে দিবে তাদের শ্যাওলা ধরা স্মৃতিগুলোকে!

আঠারো শতকের বালিয়াটি প্রাসাদ; Image Source: তাসমিয়া তাবাসসুম

জাদুঘর থেকে বের হয়ে বাম পাশে সীমানা প্রাচীর ঘিরে একটা নাট্যমঞ্চ রয়েছে। এখানেই জমিদারদের মিলত বিনোদনের খোরাক। এখন পুরোপুরি তালাবদ্ধ আছে নাট্যমঞ্চটি।
জমিদার বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু সামনে হেঁটে গেলেই দেখা যাবে ১৭ একর জমির ওপর প্রসস্থ মাঠসহ সুবিশাল “ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়”। ১৯১৯ সালে হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী কতৃক স্থাপিত হয়েছে এটি।
বর্তমানে জমিদার বাড়িটির সংরক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ।

আশেপাশে একটু ঘুরলে দেখা যাবে বেশ কয়েকটি পুকুর। আর তৎকালীন সময়ের তৈরিকৃত বর্তমানে প্রায় মিলিয়ে যাওয়া অস্তিত্বের রাজকীয় শান বাঁধানো ঘাট। জানা যায় এগুলো জমিদার রায় চাঁন রায় চৌধুরীর ২য় পক্ষের স্ত্রীর ছেলে মেয়েদের অংশ ছিল। জমিদারের মোট সম্পত্তির দশ আনা পেয়েছিল ১ম পক্ষের ছেলে মেয়েরা। আর ছয় আনা সম্পত্তি পেয়েছিল ২য় পক্ষের স্ত্রীর ছেলেমেয়েরা। ছউ আনা সম্পত্তির সবটাই হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। আর দশ আনা সম্পত্তির ওপরে তৈরি করা স্থাপনাগুলোই প্রদর্শিত হচ্ছে দর্শনার্থীদের জ্ঞান পিপাসা মেটাতে।

বিশাল দিঘী ও প্রসস্ত ঘাট; Image Source: তাসমিয়া তাবাসসুম

পরিদর্শনের সময়

এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর- সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
অক্টোবর থেকে মার্চ- সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত

সাময়িক বিরতি

শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার- দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত।
শুক্রবার দুপুর- ১২ টা ৩০ মিনিট থেকে ২ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত।

প্রবেশ ফি

জনপ্রতি ২০টাকা প্রবেশ ফি দিয়ে টিকিট কাটতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য জনপ্রতি ২০০ টাকা।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে পাটুরিয়াগামী যেকোনো বাসেই যেতে পারবেন বালিয়াটি জমিদার বাড়ি। গাবতলী থেকে এস বি লিংকে সাটুরিয়া বাস স্ট্যান্ডে নেমে অটো বা সিএনজিতে করে সহজেই চলে যেতে পারেন। ধামরাই থেকে কালামপুর হয়েও সাটুরিয়া যাওয়া যায় সহজেই। এছাড়াও মানিকগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে পাবেন সাটুরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিবহন।

Feature Image Source: তাসমিয়া তাবাসসুম