এ বছরের অন্যতম হাইপড সিনেমা এভেঞ্জার্স এণ্ডগেম। সমস্ত মুভিটির প্লট সাজানো হয়েছে শতাব্দী পুরনো সাই ফাই ফ্যান্টাসি কনসেপ্ট টাইম ট্রাভেলকে ঘিরে। তবেঁ এর পিছনের বিজ্ঞান কতটা যুক্তিযুক্ত? নাকি সুপ্রাচীন মোড়কে নতুন পণ্য উপস্থাপনের প্রয়াস মাত্র?
আসুন প্রথমেই জেনে নেই এভেঞ্জার্স এণ্ডগেম সায়েন্স এর ভিতরকার কথকতা।
সাম্প্রতিক সায়েন্টিফিক থিয়োরি, সিমুলেশন ও স্পেকুলেশন কে ব্যবহার করে কোয়ান্টাম টাইম ট্রাভেল দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে।
মুভির মূল বিষয়টি হচ্ছে অর্ধেক মহাবিশ্বের মানুষের মৃত্যু যে বস্তু গুলোর কারণে হয়েছে, কেবল সেগুলো দ্বারাই আবার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি রিভার্স করা সম্ভব। বস্তুগুলো হচ্ছে শক্তিশালী ইনফিনিটি স্টোনস। সমস্যার কথা, বর্তমানে থানোস তার কাজ শেষ হবার পর স্টোন গুলো ধ্বংস করে ফেলে। তাই একমাত্র অতীতেই এখন ওগুলো পাওয়া সম্ভব। ওগুলো নিয়ে আসতে হলে অবশিষ্ট এভেঞ্জার্স দের খুবই জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অতীতে বিভিন্ন লোকেশনে বিভিন্ন সময়ে যেতে হবে।
১০০ বছর আগে দেয়া আইনস্টাইনের থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি থেকে আমরা জানি টাইম ট্রাভেলের ক্ষেত্রে অতীতের চাইতে ভবিষ্যতে গমন করা সোজা। তার জন্য কেবল দরকার আলোর গতিতে ছুটতে সক্ষম এমন কোন যন্ত্র বা ডিভাইস। কিন্তু অতীতে গমন করতে গেলে কিছু প্যারাডক্স এসে সামনে ধরা দেয়।
এর মধ্যে বিখ্যাতটি আমরা প্রায় সবাই জানি, গ্র্যাণ্ডফাদার প্যারাডক্স। আপনি যদি অতীতে গিয়ে আপনার তরুণ বয়সী দাদাকে মেরে ফেলেন, তাহলে আপনি কখনোই জন্মাবেন না। কিন্তু যদি আপনি না জন্মান, তাহলে অতীতে গিয়ে তাকে মারতে পারলেনই বা কেমন করে?
মুভিতে আমরা প্রথমে দেখি, চরিত্রদের বেশিরভাগ টাইম ট্রাভেল এর কনসেপ্ট টা নিয়ে মজা করছে। প্রসঙ্গত অন্যান্য প্রসিদ্ধ মুভি যেমন, ব্যাক টু দ্যা ফিউচার বা টারমিনেটর সিরিজের কথা তারা উল্লেখ করে।
এন্ডগেম প্রচলিত আইডিয়ার পরিবর্তে নতুন ভাবে সত্যিকার একটা আইডিয়া উপস্থাপন করে। যেখানে অতীতে ঘটে যাওয়া যে কোন পরিবর্তন সম্পূর্ণ নতুন একটি ইউনিভার্স এর জন্ম দেয়, এবং একই সাথে মাল্টিপল টাইমলাইনের স্প্লিটিং বা ব্রাঞ্চিং সম্পর্কেও বিবেচনা করে। ফিজিক্স এর ভাষ্যমতে, একে বলা যায়, Many World Theory.
তাই এই ধরণের সমস্যা এড়ানোর জন্য এভেঞ্জার্স রা অতীতের টাইমলাইন থেকে স্টোন গুলো কিছুক্ষণেএ জন্য ধার এনে, বর্তমানে সেগুলোর পাওয়ার ব্যবহার করে, আবার সেগুলো ফিরিয়ে দিয়ে আসার পরিকল্পনা করে, একদম সেই মুহূর্তে, যে মুহূর্তে তারা স্টোনগুলো সরিয়েছিল।
কোয়ান্টাম মেকানিকস ব্যবহার করে টোনি স্টার্ক বা আমাদের আয়রন ম্যান টাইম ট্রাভেল মেশিনের নকশাটি তৈরী করেন। কোয়ান্টাম মেকানিকস অনুযায়ী এটমের কণাগুলো হচ্ছে প্রবাবিলিটির অসংজ্ঞায়িত তরঙ্গের মতো। মানে হচ্ছে, আপনার দ্বারা কখনোই জানা সম্ভব নয়, এক্সাক্টলি কোথায় এখন পার্টিকেল টি আছে এবং কোন ডিরেকশনে এটি যাচ্ছে। ব্রিটিস ফিজিসিস্ট David Deutsch এই ধারণার সাথে many world theory কে মিলিয়ে দেখেছেন। এবং বলেছেন গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স আসলে থাকে না যদি আমরা সবকিছু প্রবাবিলিস্টিক ভাবে সংজ্ঞায়িত করি। পার্টিকেল এর মতই একজন ব্যক্তির একশন কেও প্রবাবিলিস্টিক উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায়।
তো দেখা যাচ্ছে, এন্ডগেম এর টাইম ট্রাভেল খুব আকাশ পাতাল কোনো ভাবনা নয়। থিয়োরিটিকালি ভিত্তিহীন নয় তো বটেই।
এবার চলুন দেখে নেই আমাদের প্রধান তিনজন চরিত্র ক্যারিয়ারের শেষ এভেঞ্জার্স মুভিতে কী করছে
রোমানফ:
মার্ভেলস এভেঞ্জার্স এ নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, নাতাশা রোমানফ এমনকি পুরো দলটির একটা কেন্দ্রবিন্দুর মতো ভূমিকা পালণ করেছে। এভেঞ্জার্স এর পূর্ববর্তী ছবি গুলোতেও দেখা গিয়েছে আর এন্ডগেম এ স্পষ্টতই নাতাশার হাল ছেড়ে না দেয়া উদ্যমের কারণেই থানোস পতনের সূত্র যাচিত হয়। মুভির প্রথমেই দেখা যায়, থানোসের ফিঙ্গার স্ন্যাপ ও থর কর্তৃক অক্কা পাওয়ার পাঁচ বছর পরেও এজেন্ট রোমানফ নিজের দায়িত্ব পালণ করে যাচ্ছে, বাকি সুপার হিরো দের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছে। ফ্যানদের কাছে তাই ব্ল্যাক উইডো একটি পছন্দনীয় চরিত্র। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এন্ডগেম এ নাতাশার মারা যাবার আসলেই কী কোনো প্রয়োজন ছিল?
মুভি তে যখন নাতাশা ও হক আই খ্যাত ক্লিন্ট বারটন ‘ভরমির’ এ সোল স্টোন উদ্ধার করতে যায়, তখন টানটান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুই বন্ধু পরস্পর কে বাঁচিয়ে দিয়ে নিজ আত্নত্যাগে তৎপর হয়ে উঠে। যেহেতু সোল স্টোন হাসিল করা যাবে কেবল একটি আত্মার বিনিময়ে। এক্ষেত্রে নাতাশার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত হলেও এমনটি হওয়াই যুক্তিযুক্ত। কেননা, থানোসের ফিঙ্গার স্ন্যাপে হক আই এর গোটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সোল স্টোন সহ বাকি স্টোনগুলো উদ্ধার করা গেলে হক আই পুনরায় নিজের পরিবারের সাথে মিলিত হতে পারবে। তাছাড়া নির্মাতারা মনে করেন ব্ল্যাক উইডো বা নাতাশা রোমানফ এর ভূমিকা এভেঞ্জার্স এ এতটুকুই ছিল এবং চরিত্রটির সাথে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করা হয়েছে। নাতাশার আছে একটি ভয়াবহ অতীত, যা এভেঞ্জার্স দলে যোগদানের পর তাকে গৌরবান্বিত করে তুলেছে। কিন্তু সবগুলো স্টোন হাতে আসার পর কী নাতাশা কে ফিরিয়ে আনা যেত না?
মুভির শেষভাগে দেখা যায়, স্টিভ রজার্স বা ক্যাপ্টেন আমেরিকা ইনফিনিটি স্টোনগুলো টাইম ট্রাভেলের সাহায্যে তাদের যথাস্থানে রেখে আসে। ভরমির এ সোল স্টোন সে কোনো উপায়ে হয়ত ফিরিয়ে দিয়ে আসে, কিন্তু তাহলে নাতাশা কী মৃতই থেকে যাবে? শেষের দিকে থর এর যুক্তি হলো, স্টোন ব্যবহার করে নাতাশাকে ফিরিয়ে আনা মানে হচ্ছে সোল স্টোন টিই হারানো। সেক্ষেত্রে কোর্স অফ টাইমলাইন বদলে যেতে পারে। যদি তাই হয়, তাহলে ২০২০ এ মুক্তি পেতে যাওয়া ব্ল্যাক উইডো মুভিটি একটি প্রিকুয়্যাল হতে পারে, বা হয়ত আমাদের জন্য আরো চমৎকার কোনো উত্তর অপেক্ষা করছে।
টোনি স্টার্ক:
ইনফিনিটি ওয়ার এর শেষে আমরা দেখতে পাই টোনি আর নেবুলা বাদে থানোসের সাথে যারা লড়াই করছিল সকলের অস্তিত্ব মিটে যায়। নেবুলা আর টোনি অনন্ত মহাকাশে ভাসতে থাকে। তবেঁ টোনি তার আয়রন ম্যান স্যুটের সাহায্যে পেপার পটস এর কাছে ট্রান্সমিশন বার্তা পাঠাতে থাকে।
এন্ডগেমস এর প্রথমেই দেখা যায় টোনি যখন মৃত্যুর দারপ্রান্তে উপস্থিত তখন ক্যাপ্টেন মার্ভেল এসে স্পেসশীপ সহ টোনি ও নেবুলা কে উদ্ধার করে পৃথিবীতে নিয়ে আসে। অনেকের মনে প্রশ্ন উদয় হয়েছে ক্যাপ্টেন মার্ভেল বা ক্যারল কিভাবে ওদের খুঁজে পেল। এর উত্তর লুকিয়ে আছে ক্যাপ্টেন মার্ভেল মুভিটির মধ্যে, যার শেষ দৃশ্যে দেখা যায় ক্যারল উপস্থিত হয়েছে এভেঞ্জার্সদের হেডকোয়ার্টারে। সেখানে নাতাশা আর স্টিভের সাথে ওর দেখা হয় এবং নিক ফিউরি যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তা ক্যারল জানতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে পেপার পটস ক্যারলকে টোনির অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করে।
স্পেস থেকে ফিরে এসে পাঁচ বছর টোনি এভেঞ্জার্স থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। বস্তুত পিটার পার্কারের মৃত্যু তাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে যায় ও যারা চলে গেছে তাদের ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে।
তারপরই ঘটে এন্ডগেমের সবচেয়ে বড় প্লট টুইস্ট স্কটের আগমন। স্কট বা এন্ট ম্যান এর আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে গিয়ে টোনি আবিষ্কার করে টাইম ট্রাভেল মেশিনের মডেল। উপরোক্ত তথ্যানুযায়ী যা যারপরনাই যুক্তিযুক্ত। যা হোক, ফ্যান রা যা ভাবেনি তা হচ্ছে সবকিছুর সমাপ্তি ঘটবে প্রিয় আয়রন ম্যানের আত্মত্যাগ এর মাধ্যমে। উল্লেখ্য ২০১২ সালের এভেঞ্জার্স মুভিতে স্টিভ টোনিকে বলেছিল, কারো জন্য আত্মবিসর্জন দেয়া ওর মতো মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য তুমি ভুল ছিলে স্টিভ। একমাত্র টোনির আয়রন ম্যান স্যুটেই ধারণ করা সম্ভব ছিল একত্রে পাঁচটি ইনফিনিটি স্টোন, যেগুলো থেকে নিঃসৃত গামা রে পুড়িয়ে দেয় তাকে। কিন্তু শেষ তুড়ী টোনির হাতেই ছিল। আর শেষ বারের মতো টোনির মুখে শোনা গেল, “আই এম আয়রন ম্যান”।
ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা:
চলুন এবার কথা বলি আমাদের প্রিয় স্টিভ রজার্স, প্রকৃত অর্থে গ্রুপ ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা কে নিয়ে। এভেঞ্জার্স এর একদম শুরু থেকে একজন লিডারের মতো দলকে দিকনির্দেশনা দিয়ে আসা স্টিভের ক্ষেত্রে এন্ডগেমেও ব্যতিক্রম হয়নি। টোনি কে ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ করা, থর এর পাগলামি সামলানো বা সামনে থেকে থানোসের সাথে লড়াই করা, আমাদের স্টিভ সব ক্ষেত্রে অল রাউণ্ডার।
চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল শেষ ব্যাটেল এর সময় যখন স্টিভ থানোসের বিরুদ্ধে থর এর হাতুড়ি তুলে নেয়। থর জানতো সে বাদে আর মাত্র স্টিভের ই আছে ওর হাতুড়ি ওঠানোর যোগ্যতা। যুদ্ধের শেষে স্টিভ স্বপ্রণোদিত ভাবে ইনফিনিটি স্টোন গুলো যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে যায়। এটা প্রয়োজন ছিল, কেননা এনসিয়েন্ট ওয়ান হাল্ক রুপী ব্যানার কে টাইম স্টোন দেয়ার সময় বলে, কাজ শেষ হবার পর স্টোনগুলো যেখান থেকে নেয়া হয়েছে ঠিক সেভাবে আবার যথাস্থানে ফেরত দেয়া না হলে তা অনেকগুলো ভয়াবহ ফলাফল দায়ী টাইমলাইনের জন্ম দিবে। স্টিভ তাই এই কঠিন দায়িত্ব নেয় যদিও কিভাবে সে সোল স্টোন ফিরিয়ে দেয়, বা এসগার্ডে ইথার কে জায়গামত কিভাবে রেখে আসে, খুব বড় রহস্যের জন্ম দেয়। তবেঁ শাপে বর, এই সুযোগে স্টিভ ফিরে যায় ১৯৪৬ সালে, যেখানে সে হারিয়েছে পেগি কার্টারকে, সেখান থেকেই বরফে জমে গিয়ে স্টিভ পার করেছে ৭০ বছরের দীর্ঘ লম্বা সময়। সে সময়ে ফেরত গিয়ে পেগির সাথে লম্বা জীবন কাটিয়ে স্টিভ ফিরে আসে বর্তমানে। ততদিনে বুড়িয়ে গেছে স্টিভ। সূচিত হয় এভাবেই প্রথম এভেঞ্জার্স এর মহাবিশ্বকে রক্ষা করার মহাযুদ্ধের সমাপ্তি।
ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা, ব্ল্যাক উইডো আর আয়রন ম্যান ছাড়া মার্ভেলস এর এভেঞ্জার্স দুনিয়া কেমন হবে? ফ্যানদের সেজন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে বৈকি। কিন্তু ভবিষ্যতে আর যেই সিনেমাই আসুক, Endgame will always be a treat to watch…