“রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০০১৮” আমরা যারা প্রত্যক্ষ করছি, তারা কমবেশি অবগত ব্রাজিলের মত পরাশক্তিকে হারিয়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলছে “ডার্ক হর্স” হিসেবে খ্যাত বেলজিয়াম। তাদের এই জয়কে অনেকে দুর্ঘটনা বলতে নারাজ, কারণ এরাই হলো বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্ম। কিন্তু এই প্রজন্মের জন্ম কোথা থেকে, শুরুটা কিভাবে। আসুন জেনে নেই সেই সম্পর্কে।
ইউরোপিয়ান দেশ হিসেবে বেলজিয়াম ফুটবলে খুব একটা প্রতিষ্ঠিত নাম নয়। এদেশের বিশ্বমঞ্চে সাফল্য বলতে, ১৯৮৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিল। এছাড়াও একবার ১৯৮০ সালে ইউরোপীয় রানার্স-আপ হয়েছিল দলটি। স্বাগতিক দল হিসেবে ১৯২০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে বেলজিয়াম দল স্বর্ণপদক লাভ করে। এছাড়া এই দলের অর্জন বলতে তেমন কিছুই চোখে পরে না। কিন্তু বর্তমানে এই দলটিই বিশ্বকাপের মতন শিরোপার অন্যতম দাবিদার। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এই বেলজিয়ামের দলটির উপর চোখ রাখি ২০১৪’র বিশ্বকাপ থেকে। লুকাকু,ফেলাইনি,ভারমালেন,কোর্তয়া এদেরকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে নিয়মিত দেখার কারণে আগ্রহ জন্মায় তাদের ন্যাশনাল টিমের প্রতি। চোখের সামনে তিলে তিলে গড়ে উঠা সেই দল আজ “সোনালি প্রজন্মের” তকমা গায়ে লাগাচ্ছে।
শুরুটা হয় ১৯৯৮’র বিশ্বকাপের পর থেকে। সে বছর ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্রুপ পর্যায়ে বেলজিয়াম বাদ পরে। কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে তৎকালীন টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর মিশেল সাবলোঁ লক্ষ্য করলেন, বেলজিয়ামের ইয়ুথ ফুটবলে বেশ বড় রকমের ঘাটতি রয়েছে। বেলজিয়ামের জনসংখ্যা প্রায় ১১মিলিওনের মতন। দেশটিতে সর্বসাকুল্যে ক্লাব আছে ৩২টি। একটি ইউরোপিয়ান দেশের জন্যে যা একেবারেই অপ্রতুল। আর এসব ক্লাবের বেশিরভাগই সনাতন পদ্ধতি অনুসরণ করে। একজন খেলোয়াড়কে প্রাথমিক অবস্থা থেকেই সেই মান্ধাতার আমলের ডিফেন্সিভ ফুটবলের পাঠ দেওয়া হতো। এর জন্যে সেই প্লেয়ার যখন আন্তর্জাতিক আসরে প্রেসিং ফুটবলের সামনে পরে, স্বভাবতই নুয়ে পড়ে। এজন্যে বেলজিয়াম ফুটবলের সাবেক টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর মিশেল সাবলোঁ দেশের ফুটবলের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের নিয়ে বসলেন। তাদেরকে প্রস্তাব দিলেন নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেটআপে দর্শন এবং ট্রেনিং পদ্ধতিকে অনুসরণ করার। এছাড়া উত্তর ও দক্ষিণে তাদের প্রতিবেশীর দেশের ক্লাব এজ্যাক্স এবং বার্সেলোনার যুব দলের কাঠামোর অনুরূপ একাডেমী প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ দেন তিনি। বেলজিয়াম ফুটবল ক্লাবের কোচ এবং কর্মকর্তারা ফ্রান্স, জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডসের সেরা ট্রেনিং সেন্টারগুলো ঘুরে দেখে সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্কুল থেকে শুরু করে যুব-পর্যায় পর্যন্ত সব স্তরে ৪-৩-৩ পদ্ধতির ফুটবল খেলা চালু করেন। সব পর্যায়ের কোচদেরও শেখানো হয় কিভাবে সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে আধুনিক ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলানো যেতে পারে। বলকে নিজের আয়ত্তে রেখে এটাকিং ফুটবল খেলার মন-মানসিকতা তৈরি করা হয়। আজ জাতীয় দলের দিকে যদি নজর দেই তাহলে তাঁদের খেলা কোচিংয়ে গতির প্রমাণ স্পষ্ট। এডেন হ্যাজার্ডের, বেলজিয়াম ক্যাপ্টেন বল পায়ে দ্রুতগতির মুভমেন্টের জন্যে সুপরিচিত। অপরদিকে রোমেল লুকাকুর পছন্দ আচমকা বাঁক নিয়ে শক্তিশালী শুটিং এর মাধ্যমে গোল আদায় করা। এমনকি এই দলের ডিফেন্ডারও স্পিডি ফুটবল খেলতে দক্ষ। জন ভেরোটোহন, থমাস মেউনিয়ার এবং টোবি অ্যাল্ডারওয়েইয়ার্ড- এই সকল ডিফেন্ডাররা ডিফেন্সিভ পজিশন থেকে দ্রুত হামলা চালাতে বেশ পারদর্শী। যদিও সব খেলোয়াড়ই বেলজিয়ামে থেকে ফুটবলের শিক্ষা গ্রহণ করেন নি, তবে স্কুল অব ন্যাশনাল টিমের জন্য খেলার সময় তাদের উন্নয়নের হার তাদের খেলার ধরনকে অনেকটা প্রভাবিত করে।
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত, সুসময় আর অভিবাসন। এই তিনের মিশেলে আজ এই অবস্থা বেলজিয়াম দলের। মিশেল সাবলোঁ বলেন,
“জাতীয় দলের এক মৌসুম থেকে অন্য মৌসুমে ৪-৩-৩ কাঠামোতে খেলানোর সম্পূর্ণ দায়ভার আমার। আমরা প্রথমদিকে যখন গেমস হারতে থাকি তখন বাকিরা বলেছিল, কেন আমরা সবকিছু এ টু জেট বদলাতে চাচ্ছি? আমি নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলাম, এটা আমার জন্যে এক বিশেষ সুবিধা ছিল – আমি ফেডারেশনের শীর্ষস্থানীয় লোকদের বুঝাতে পারতাম আমি আসলে কি করতে চাচ্ছি। কিভাবে আমরা এর আউটকামটা পাব। কিছু লোক অবশ্যই আমার বিরোধিতা করেছিল,আমাকে তারা বলেছিল: ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ!’ তারা বলেছিল: ‘আমদের ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপের উপর নজর দেওয়া উচিত এবং যোগ্যতা অর্জনের চেয়ে বর্তমান খেলোয়াড়দের প্রতি মনোযোগ দেই।’
সাবলোঁ তার কাজ শুরু করে দেন। তিনি একটা জরীপ করেন-প্রায় দেড় হাজার খেলার চলচ্চিত্রে ধারণ করে তা বিশ্লেষণ করা হইয়। যে কোন উপায়ে জিততে হবে এই মানসিকতা ত্যাগ করে যুব-ফুটবল স্তরে তরুণ খেলোয়াড়দের গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। এবং অবশ্যই খেলার নিয়ন্ত্রণ উপর রাখতে হবে। নিয়ম করা হলও যে অনূর্ধ্ব-৭ এবং অনূর্ধ্ব-৮ দলের লিগে কোন পয়েন্ট তালিকা থাকবে না। এছাড়া আরও নিয়ম করা হলও, তরুণ খেলোয়াড়রা একবার ওপরের স্তরে উঠে গেলে তাদের আর কখনোই নিচের স্তরে এসে খেলতে হবে না। এছাড়া সবথেকে প্রতিভাবান তরুণ খেলোয়াড়দের একসাথে এনে দেশের আটাটি কেন্দ্রীয় ফুটবল ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলও।
বেলজিয়ামের অন্যতম ক্লাব আন্ডারলেখটও এর অংশ নিয়ে নিজের ক্লাবে, ২০০৭ সালে চালু করে “পার্পাল ট্যালেন্ট”-প্রকল্প। যেখানে সপ্তাহে প্রতিদিন তিন স্তরে এক-ঘণ্টার প্রশিক্ষণ সেশন চালু করা হয়, যা একচেটিয়াভাবে কারিগরি দক্ষতার বিকাশে সাহায্য করে। খেলোয়াড়দের ফিজিক্যাল স্ট্রেন্থ এর পাশাপাশি, টেকনিক্যাল দিকেও নজর দেওয়া হয়। এই প্রজেক্টের অন্যতম ফসল রোমেল লুকাকু। আন্ডারলেখট এর টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের মতে, “লুকাকুকে যখন আমরা আমাদের ইয়ুথ প্রোগ্রামের আন্ডারে নিয়ে আসি তখন ওর বয়স মাত্র ১৩ বছরের নিচে। সে একটি ভাল প্লেয়ার ছিল, দ্রুতগামী। কিন্তু টেকনিক্যালি খুব একটা সাউন্ড না। সে দ্রুত এবং পরিশ্রমী ছিল কিন্তু আমরা তাকে আরেকটু ঘষা-মাজা করে আরও পরিণত করে গড়ে তুলি।”
বেলজিয়ামের ফুটবল কর্মকর্তারা কয়েক বছরের মধ্যেই লক্ষ্য করলেন যে এর ফলে নতুন প্রতিভাবান ফুটবলারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এখন বর্তমানে ইংল্যান্ড,জার্মানি,ইতালি,নেদারল্যান্ডসহ ইউরোপের বড় বড় লীগে বেলজিয়ামের অভিবাসী মা-বাবার সন্তানরা খেলছে। ইউরোপের বড় বড় ক্লাব গুলোয় এখন বেলজিয়াম তারকার সংখ্যা অনেক। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের চেলসির কিপার থিবো কুর্তোয়া বা টটেনহাম এর ডিফেন্ডার টোবি অল্ডারভাইরেল্ড, দুজনেই জেলজিয়ান। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটির ভিনসেন্ট কোম্পানি, চেলসির এডিন হাজার্ড, ম্যান ইউর রোমেল লুকাকু, বার্সেলোনার টমাস ভারমালেন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যারুয়ান ফেলাইনি, আর কিশোর সেনসেশন আদনান ইয়ানাজাই– এরা সবাই ক্লাবের দায়িত্বের পাশাপাশি আছেন বেলজিয়ামের জাতীয় দলে। জার্মানির বুন্দেসলিগা জয়ী বায়ার্ন মিউনিখে আছেন বেলজিয়াম ড্যানিয়েল ভ্যান বুইটেন। একসঙ্গে এত তারকার আবির্ভাবের জন্যে সঙ্গত কারণেই বলা হচ্ছে এরাই হচ্ছেন বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্ম।
এক মিশেল সাবলোঁ’র হাত ধরে শুরু। সেই পথ ধরে আজ বেলজিয়াম “রাশিয়া বিশ্বকাপঃ২০১৮”র সেমিফাইনালে।অনেকের মতে এবারের শিরোপার যোগ্যতম দাবিদার তারাই। বেলজিয়ামের ফুটবলাররা যে সর্বোচ্চ স্তরে ভালো করতে পারেন তা এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে। ইউরোপের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে তাঁরা। সামনের দিনগুলিতে আমরা হয়তো আরও সাফল্যের সাক্ষী হবো।
বেলজিয়ামের সাফ্যলের পিছনের গল্প নিয়ে ফিফার তৈরি ডকুমেন্ট্রি দেখতে ক্লিক করুন এখানে
চলছে রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮। এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে আমার বাকি লেখাগুলো চাইলে পড়তে পারেন এখান থেকে-
রাশিয়া বিশ্বকাপ : ফুটবল এখন তুযারশুভ্র দেশ “রাশিয়ার” পথে (পর্ব :১)
টিম রিভিউ : আর্জেন্টিনা (পর্ব : ২)
টিম রিভিউ (পর্ব : ৩) : ব্রাজিল- হৃদয়ে যাদের ফুটবল, পারবে কি এবার হেক্সা জয় করতে?
বিশ্বকাপের মঞ্চে জাপানীদের পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং আমাদের অবস্থা
কানের পাশ দিয়ে গুলি ছুঁয়ে যাওয়া বুঝি একেই বলে!!
বিশ্বকাপের আসরে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনাগুলো