বাংলা বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচনের গল্প

দৈনন্দিন জীবনে কথা বলার সময় বিভিন্ন অর্থে আমরা বিভিন্ন বাগধারা বা প্রবাদ-প্রবচণ ব্যবহার করে থাকি। কখনো কি আপনার মনে এই প্রশ্নটি এসেছে, এসব বাগধারা বা প্রবাদ-প্রবচণের উৎস কী? কিংবা কীভাবে এগুলো আমাদের কথার মধ্যে জায়গা করে নিলো? এসব বিষয়ে আমদের কতটুকুই বা ধারণা রয়েছে, কিংবা আপনিই বা ক’টা প্রবাদের পেছনে থাকা গল্পের কথা জানেন? কিংবা আপনি কী আদৌ জানেন দৈনন্দিন জীবনে আপনার ব্যবহৃত বিভিন্ন বাগধারা বা প্রবাদ-প্রবচণের পেছনে রয়েছে অনেক গল্প।
আমরা আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে যেসব বাগধারা বা প্রবাদ-প্রবচন ব্যবহার করে থাকি, সেগুলো এমনি এমনি আসেনি। এর পেছনে রয়েছে কিছু গল্প। সেই গল্পগুলো কখনো লোককথার, কখনো ঐতিহাসিক আবার কখনো বা পৌরাণিক কাহিনিকে কেন্দ্র করে। সেইসব গল্প নিয়েই এই পর্বটি সাজানো হয়েছে।
১. ত্রিশঙ্কু দশা
বাংলায় ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রবাদের মধ্যে একটি হলো “ত্রিশঙ্কু দশা”। এই প্রবাদটির দ্বারা বোঝানো হয় মাঝামাঝি অবস্থানে আটকে থাকা। অর্থাৎ, অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া। এই প্রবাদটির পেছনে রয়েছে একটি গল্প। আর সেই গল্পটির উৎস হলো হিন্দু পুরাণ।

কথিত আছে, ত্রিশঙ্কু ছিলেন সূর্যবংশীয় রাজা। তার বেশ সুখ্যাতি ছিল। একবার তার ইচ্ছা জাগলো স্বশরীরে স্বর্গে যাবেন। আর এজন্য তাকে যজ্ঞ করতে হবে। তিনি তার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলেন মহর্ষি বশিষ্ঠের কাছে। সেই সাথে মহর্ষি বশিষ্ঠকে অনুরোধ করেন তিনি যেন তার এই যজ্ঞে পৌরোহিত্য করেন। ত্রিশঙ্কুর অনুরোধে ক্রোধান্বিত হলেন বশিষ্ঠ, সেই সাথে পৌরহিত্যের অনুরোধ রক্ষায় অসম্মতি জানালেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বশিষ্ঠের কাছ থেকে ফিরে আসতে হলো ত্রিশঙ্কুকে।

শিল্পীর তুলিতে ত্রিশঙ্কু
এদিকে ত্রিশঙ্কু যখন ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি সাক্ষাৎ লাভ করেন মহর্ষি বিশ্বমিত্রের। মহর্ষি বশিষ্ঠের সাথে মহর্ষি বিশ্বমিত্রের সম্পর্কে আগে থেকেই তিক্তভাব বিরাজ করছিল। ত্রিশঙ্কুর কাছ থেকে বিশ্বমিত্র সবটা জানতে পারলেন। তখন তিনি ত্রিশঙ্কুকে স্বশরীরে স্বর্গে পাঠানোর যজ্ঞে পৌরোহিত্য করতে সম্মতি প্রদান করেন।
প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে শুরু হলো যজ্ঞ। বিশ্বমিত্রের পৌরহিত্যের কারণে যজ্ঞ ফল দিতে শুরু করলো। রাজা ত্রিশঙ্কু স্বর্গে পৌঁছলেন। কিন্তু এরপর দেখা দিলো নতুন সঙ্কট। স্বর্গের দেবতারা ত্রিশঙ্কুকে জানালো তাকে মর্ত্যে ফিরে যেতে হবে, কেননা এভাবে কেউ স্বর্গে আসতে পারে না। এতে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ হয়। দেবতারা যখন ত্রিশঙ্কুকে পুনরায় মর্ত্যে প্রেরণ করছিল তখন মহর্ষি বিশ্বমিত্র নিজের যোগবলের দ্বারা তাদেরকে রোধ করলেন। এই অবস্থায় মর্ত্য ও স্বর্গের মাঝামাঝিতে আটকে গেলেন রাজা ত্রিশঙ্কু। পরে গেলেন এক মহা সংকটের মধ্যে। এই সংকট সমাধান করতে পরবর্তীতে স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝিতে আরেকটি স্বর্গ তৈরি করা হলো ত্রিশঙ্কুর জন্য।
স্বর্গ মর্ত্যের মাঝামাঝিতে আটকে থাকায় সেখান থেকে “ত্রিশঙ্কু দশা” প্রবাদের জন্ম হলো।
২. গোঁয়ার-গোবিন্দ
“গোঁয়ার-গোবিন্দ” প্রবাদটিও আমরা হরহামেশাই ব্যবহার করে থাকি। প্রবাদটি আমরা ব্যবহার করে থাকি হঠকারী অর্থে। এই প্রবাদটির পেছনেও রয়েছে একটি গল্পে। তবে সেই গল্পটি কোনো পৌরাণিক গাঁথা বা কাহিনির সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং এটির সাথে সম্পর্ক রয়েছে ইতিহাসের।
রাজা গৌড় গোবিন্দের নাম শুনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। তারপরেও আরেকবার মনে করিয়ে দেই। রাজা গোবিন্দ ছিলেন তৎকালীন গৌড় তথা সিলেট অঞ্চলের রাজা। অত্যাচারী শাসক হিসাবে ঐ অঞ্চলের তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। বিশেষ করে তার রাজ্যে বসবাসরত মুসলমান প্রজাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ছিল নানা আইন। আর সেই আইন ভাঙলে পেতে হতো কঠিন শাস্তি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখিত ঘটনা হলো বুরহানুদ্দিনকে কেন্দ্র করে। গোহত্যার দায়ে রাজা যার হাত দুটো কেটে নিয়েছিলেন এবং শিশুপুত্রকে হত্যা করেছিলেন। পরবর্তীতে হযরত শাহ জালালের কাছে পরাজিত হয়ে গৌড় গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি পরবর্তীতে।
উল্লেখ্য রাজা গোবিন্দ গৌড়ের শাসক ছিলেন বলে তাকে সবাই গৌড় গোবিন্দ বলে সম্বোধন করতো। এই গৌড় গোবিন্দ থেকেই “গোঁয়ার গোবিন্দ” প্রবাদটি এসেছে বলে কথিত রয়েছে। বলা হয়, হঠকারী ব্যক্তি হিসাবে রাজা ছিল সর্বজন জ্ঞাত। এজন্য হঠকারী ব্যক্তিকে “গৌড় গোবিন্দ” বলে সম্বোধন করা হতো। তার নামের সাথে থাকা গৌড় শব্দটি কালের পরিক্রমায় পরিণত হয়েছে “গোঁয়ার” শব্দে। বলা হয়ে থাকে এভাবেই আমরা পেয়েছি “গোঁয়ার গোবিন্দ” প্রবাদটি।
৩. ঘরের শত্রু বিভীষণ
এই প্রবাদটির উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে ভারতীয় উপমাদেশের অন্যতম আলোচিত ও দীর্ঘ মহাকাব্য রামায়ণের দিকে।
রামায়ণের সেই সময়কে বলা হতো ত্রেতাযুগ। ত্রেতাযুগে অযোধ্যার সম্রাট ছিলেন দশরথ। তার ছিল তিন রানী। তিন রানীর গর্ভে দশরথের চার পুত্রের জন্ম হয়। এই পুত্ররা ছিল যজ্ঞের ফসল। যদিও দশরথের একটি কন্যাসন্তানও ছিল। যা হোক, দশরথের চার পুত্রের মধ্যে রামচন্দ্র ছিল জেষ্ঠ্যপুত্র। সৎমা কৈকেয়ীর চক্রান্তে তাকে বারো বৎসর পঞ্চবটী বনে নির্বাসন গ্রহণ করতে হয়েছিল। সেই সময় তার সঙ্গী হয়েছিল স্ত্রী সীতা ও বৈমাত্রেয় ভাই লক্ষ্মণ।
পঞ্চবটীতে থাকাকালে রাবণের বোন শূর্পণখা লক্ষ্মণকে প্রেম নিবেদন করলে সময় তার নাক কেটে দেয়। প্রতিশোধ নিতে রাবণ পঞ্চবটী থেকে রামের স্ত্রী সীতাকে অপহরণ করে রাক্ষসরাজ্য লঙ্কাপুরীতে নিয়ে যায়। শুরু হয় রাম-রাবণের যুদ্ধ।
blank
শিল্পীর তুলিতে রামচন্দ্রের কাছে নিজেকে সপে দিচ্ছে বিভীষণ
বিভীষণ ছিল রাবণের ছোটো ভাই। রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ ছিল ঋষি বিশ্রবা ও সুমালি রাক্ষস নিকষার সন্তান। ভাইয়ের পক্ষ ত্যাগ করে সেই যুদ্ধে রামের পক্ষে যোগ দেয় বিভীষণ। তার সহায়তায় ভ্রাতুষ্পুত্র মেঘনাদকে হত্যায় করে লক্ষ্মণ। এছাড়া রাক্ষস রাজ্যের গোপন খবর রামকে বলে দিয়ে যুদ্ধে সাহায্য করে বিভীষণ।
যদিও বিভীষণ ধর্মে পথে থেকেছে, কিন্তু “আপনজন হয়ে যারা আপনজনদের ক্ষতি করে” বা “নিজ লোকেদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে” তাদেরকে “ঘরের শত্রু বিভীষণ” হিসাবে সম্বোধন করা হয়।
৪. অগস্ত্য যাত্রা
“অগস্ত্য যাত্রা” শব্দটির দ্বারা আমরা চিরকালের মতো প্রস্থান বা বিদায় নেওয়াকে বুঝিয়ে থাকি। শেষ যাত্রা বা মৃত্যু। এই প্রবাদটির উৎপত্তির সাথে হিন্দু পুরাণের সম্পর্ক রয়েছে। এই প্রবাদটির পেছনে প্রচলিত রয়েছে একটি পৌরাণিক কাহিনি।
অগস্ত্য ছিলেন বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। ঋক্‌বেদে অগস্ত্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি সূর্য ও বরুণের পুত্র। উর্বশীকে দেখে সূর্য ও বরুণ যজ্ঞকুম্ভের ভেতর শুক্রপাত করেন। কুম্ভে পতিত শুক্র থেকে জন্ম হয় বশিষ্ঠ ও অগস্ত্যের। ভাগবতে অবশ্য অগস্ত্যকে পুলস্তের পুত্র বলা হয়েছে। অন্য জায়গায় বশিষ্ঠকে ব্রহ্মার সাত মানসপুত্রের একজন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই অগস্ত্য মুণীর শিষ্যদের একজন ছিল বিন্ধ্যপর্বত। দেবর্ষি নারদ একবার বিন্ধ্যের কাছে গিয়ে জানালো যে, বিন্ধ্যের চেয়ে সুমেরু বেশি সমৃদ্ধ, কেননা সমগ্র দেবতা সুমেরুতে দিন যাপন করেন। শুধু তাই নয়, সূর্য প্রতিদিন সুমেরু পর্বতকে প্রদক্ষিণ করে। তাই বিন্ধ্যের চেয়ে সুমেরু অধিক মর্যাদাবান।

একথা শুনে বিন্ধ্যপর্বত সূর্যকে অনুরোধে করলেন সুমেরুর মতো তাকেও প্রদক্ষিণ করতে। কিন্তু সূর্য তাতে অস্বীকৃত জানান এবং বলেন, বিশ্বনিয়ন্তার আদিষ্ট

blank
শিল্পীর তুলিতে ঋষি অগস্ত্য

পথেই তিনি পরিভ্রমণ করেন এবং করবেন। এতে বিন্ধ্যের মনে ভীষণ ক্রোধের জন্ম হয়। ফলে তার দেহ অসম্ভবভাবে বাড়তে থাকে, যা সূর্যের পথ রোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শঙ্কিত হয়ে পড়লেন এতে। তারা স্মরণাপন্ন হলেন ঋষি অগস্ত্যের। দেবতাদের অনুরোধে অগস্ত্য তার শিষ্য বিন্ধ্যের কাছে গেলেন। গুরুর দর্শন পেয়ে বিন্ধ্য তাকে অবনত মস্তকে প্রণাম জানালে, অগস্ত্য তাকে বললেন, সে যতক্ষণ পর্যন্ত ফিরে না আসছে ততক্ষণ যেন বিন্ধ্য ওভাবেই মস্তক অবনত করে রাখে। এই বলে অগস্ত্য যাত্রা করলেন। কিন্তু কখনোই আর ফিরে এলেন না।

অর্থাৎ, ওটাই শেষ যাত্রা। এখান থেকেই “অগস্ত্য-যাত্রা” কথাটার উৎপত্তি, যার অর্থ : শেষ যাত্রা।

৫. লঙ্কাকাণ্ড

লঙ্কাকাণ্ড বাগধারাটির অর্থ হলো “হুলুস্থুলু ব্যাপার” বা “বিরাট ব্যাপার”। মূলত এই বাগধারাটির জন্ম হয়েছে রামায়ন থেকে। রামায়ণের একটি কাণ্ডের নাম “লঙ্কাকাণ্ড”। আর তাতে বর্ণিত হয়েছে রাক্ষসরাজ রাবণের রাজ্য সোনার লঙ্কার বহু কীর্তিকলাপের গল্পও। সেসব কীর্তিকলাপের যেরূপ বর্ণনা আমরা পাই তা খানিকটা বর্ণনা করছি। তাতে আলোচ্য বাগধারাটির উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা জন্মাবে।
blank
শিল্পীর তুলিতে লঙ্কাকাণ্ড
যেমন রামের নেতৃত্বে বানর বাহিনী কর্তৃক লঙ্কা আক্রমণ। লঙ্কায় বানরদের সব কার্যকলাপের যে বর্ণনা আমরা পাই তা এক প্রকার অতিরঞ্জিত বা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। আবার হনুমান কর্তৃক সোনার লঙ্কায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা কিংবা রাবণের ভ্রাতা কুম্ভকর্ণকে ঘুম থেকে জাগানোর ঘটনার যে বর্ণণা আমরা দেখতে পাই তা কোনোভাবেই সাধারণ ব্যাপার বলে মনে হবে না। যেমন, কুম্ভকর্ণকে জাগাতে রাক্ষসেরা নানা বাদ্যযন্ত্রের সাহায্য নেয়। তাতেও তার ঘুম ভাঙে না। তখন তারা বিভিন্ন অস্ত্রের সাহায্য কুম্ভকর্ণের শরীরে আঘাত করতে থাকে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয় না। এদিকে যারা তার ঘুম ভাঙাতে এসেছে তাদেরও যাচ্ছে তাই অবস্থা। শুধু তাই নয়, রামায়ণের এই কান্ডে বর্ণিত হয়েছে হনুমান কর্তৃক বিশল্যকরণী নামক সঞ্জীবনী উদ্ধারের গল্প। তাতে বর্ণিত রয়েছে, রাবণ পুত্র মেঘনাদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে তার ছোঁড়া বাণে হারায় লক্ষ্মন। সেই জ্ঞান ফেরানোর দায়িত্ব গ্রহণ করে হনুমান। জ্ঞান ফেরাতে কোনো সাধারণ সঞ্জীবনী নয় প্রয়োজন বিশল্যকরণী নামক সঞ্জীবনী। আর তা পাওয়া যাবে হিমালয়ের গন্ধমাদন পর্বতে। সেই বটিকা উদ্ধার করতে যাত্রা করে হনুমান। কিন্তু নির্দিষ্ট গাছটি চিনতে না পারায় গোটা গন্ধমাদন পর্বতটাকেই তুলে নিয়ে আসে সে।
তাছাড়া আভিজাত্যের দিক থেকেও লঙ্কার যথেষ্ট সুনাম ছিল। তাই সবকিছু মিলিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাগধারাটি “বিরাট ব্যাপার” বা “হুলুস্থুলু ব্যাপার” দাঁড়িয়েছে।

 

ফিচার ইমেজ : www.christies.com