বুক রিভিউঃ কল্পিত রোমাঞ্চের জগৎ, ফ্যান্টাসি বই

বাংলাদেশে মৌলিক ফ্যান্টাসির চর্চা একদম নেই বললেই চলে। বিচ্ছিন্নভাবে অল্প কয়েকজন লেখালেখি করলেও, বই প্রকাশ পাচ্ছে আজ ২-৩ বছর ধরেই। তাও বেশ অল্প বই’ই। এই অল্প কয়েকটির মাঝেও বেশ সাড়া জাগানো বই প্রকাশ পেয়েছে গত দু’বছরে। আজ আলোচনা করবো সেরকম কয়েকটি মৌলিক ফ্যান্টাসি নিয়ে।

বই : অক্টারিন
লেখক : তানজীম রহমান
জনরা : আরবান ফ্যান্টাসি

দেশের প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে আয়েশার এক ব্যতিক্রমী অসুখ হলো, অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখানো হলেও কোনো সুরাহা করতে পারেনি তারা। কোন অশুভ শক্তির ছায়া পড়েছে মেয়ের ওপর। সে অশুভ শক্তির ছায়ার সমাধান খুঁজতে নিয়োগ করা হলো মুমিনকে। অদ্ভুত একজন মানুষকে, অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার সাথে যার আছে নিবিড় ও তিক্ত অভিজ্ঞতা। তদন্তে নামার পরই বুঝতে পারলো চোরাবালি আসলে কতোটা গভীর। তার জানাশোনা সব পদ্ধতি প্রয়োগ করেও কিছুই বুঝতে পারেনি। এটুকু বুঝতে পেরেছে, একা একা এই রহস্যের জট খোলা সম্ভব নয়, অন্য এক ধরনের বিশেষজ্ঞের সাহায্যের দরকার। দরকার একজন রিচ্যুয়াল ম্যাজিশিয়ানের। অ্যানিমা একজন ম্যাজিশিয়ান। দু’জন মিলে নেমে পড়লো এক অদ্ভুত, অসীম ক্ষমতার অধিকারী ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, যার কাছে মানুষের ক্ষমতা নিতান্তই তুচ্ছ। আড়ালে বসে বিশাল ভয়ঙ্কর আয়োজন করছে কেউ একজন, কিন্তু কী তার পরিচয়? তার চাইতেও বড় কথা, কী তার উদ্দেশ্য? ওরা দু-জন মিলে কি এই মারাত্মক রহস্যের জাল ভেদ করতে পারবে? প্রতি পদে পদে অপেক্ষা করছে বিপদ আর বিপদ। ছায়ার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে আছে অকল্পনীয় ক্ষমতাধর এক আততায়ী।

দারুণ এক আরবান ফ্যান্টাসি। এক কথায় বৈচিত্র্যময় কাহিনী। সাসপেন্স, মিস্ট্রি, হরর, থ্রিলার সবই আছে বইয়ে। বেশ টানটান উত্তেজনাময় পুরো বইটি। লেখক বেশ সুন্দরভাবেই ক্যারেক্টার ডেভেলপ করতে পারেন। ভালো লেগেছে পড়ার টাইম চার্টের ব্যাপারটা। লেখক বলেছিলেন, “গল্প উপভোগ করা উচিৎ খাবারের মতো। পেটভরা থাকলে দুনিয়ার সবচেয়ে সুস্বাধু বিরিয়ানি যেমন মুখে রুচবে না, ঠিক তেমনি কাঠফাটা রোদে বসেও অ্যান্টার্কটিকাকে কেন্দ্র করে গল্প পড়লে মজা পাওয়া যাবে না। তেমনি হরর পড়ার জন্য সঠিক সময় রাত”। সবকিছু দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক সাহেব তার দারুণ লেখনী দিয়ে।

তানজীম রহমানের “অক্টারিন”এর পাতায় লুকিয়ে আছে খুন, জাদু, কিংবদন্তি আর চক্রান্তের আশ্চর্য এক উপন্যাস যা চুম্বকের মতো আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে বাধ্য করবে।

বই : শোণিত উপাখ্যান – বর্তমান
লেখক : সৈয়দ অনির্বাণ
জনরা : আরবান ফ্যান্টাসি থ্রিলার

ইন্টারোগেশনে তুখোঁড় ও প্রায় অসামাজিক একজন পুলিশ অফিসার কায়েস হায়দার। তার কাঁধে এসে পড়লো এক অদ্ভুদ কেস। পরিস্থিতি এমন যে, আমাদের চেনা জগতের কোনো যুক্তি কাজ করছে না সেখানে। ক্রাইমসিনে গিয়েই অনুভুত হল এক অদ্ভুদ অনুভুতি। বুঝতে পেরেছেন, এটা একটা অতিপ্রাকৃত ঘটনার কেস। সেজন্য রহস্যমানব অবলালের কাছে সাহায্য চাইল কায়েস। দু’জনে মিলে নেমে পড়ল তদন্তে। কিন্তু কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যে সাপের বাসা বেড়িয়ে আসছে! তাও ছোটখাটো সাপ না, একেকটা যেন অ্যানাকন্ডা!

একের পর এক অতিপ্রাকৃত প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে কায়েস আর অবলালকে। আধুনিক এই ঢাকা শহরে এক নতুন নাটক জমে উঠেছে, এক অতিপ্রাকৃত নাটক! শুধু পিশাচ, স্কন্ধকাটা, চুড়েল, ডাকিনী, বৈতাল আর শক্তিশেলধারী যাদুকরই নয়, এর পেছনে রয়েছে আরও গুঢ় কোন রহস্য।

ঘটনায় জড়িয়ে পড়লো প্রতিরাতে একই স্বপ্নদর্শী সুদর্শনা মীরানা মোরেস, চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে দিয়ন্ত, শখের অকালটিস্ট নাজিম আর ক্যাপ্টেন অ্যান্ড্রিয়াস। কিন্তু কারা এরা?

ধীরে ধীরে রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে, দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ ও ভয়ঙ্কর এক চক্রান্তের জাল। রয়েছে শৈলেন ভট্টাচার্যের ভয়ঙ্কর দলবল, ডমিনিক বায়রান, তান্ত্রিক তীরন্দীদেবসহ আরো অনেকে। কিন্তু আড়ালে বসে কলকাঠি নাড়ছে অসীম শক্তিধর কেউ, কী তার পরিচয়? দেড় হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া এক প্রলয়ঙ্কর ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চায় সে। নিষ্ফল বসে প্রহর গোণা ছাড়া কি কিছুই করার নেই?
সব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে রক্তের মাঝে। শোণিতের উপাখ্যানে।

মার্ডার মিস্ট্রির মত এক ঘটনা দিয়েই বইটি শুরু। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাসপেন্স ধরে রেখছিল লেখকের দারুণ লেখনী। ঝড়ের বেগে উত্তেজনাপূর্ণভাবে চলেছে এই উপন্যাসটি। কায়েস আর অবলালের চরিত্রও খুব ভালো লেগেছে। দুজনেই অস্ত্র চালনায় দারুণ এক্সপার্ট। রহস্যমানব অবলালের চরিত্র ধোঁয়াশাতেই রেখে দিলেন লেখক। বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দারুণ দারুণ অ্যাকশন ছিল, এর মাঝেই ধীরে ধীরে ক্যারেকটার ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। বইয়ে দৃশ্যায়ন, খুঁটিনাটি বর্ণনা করা হয়েছে খুব সুন্দরভাবে। গল্পের কাহিনীর মাঝে ঢুকে গেলে শেষ করেই উঠতে হবে। আসলে শেষ করে উঠা যাবে না, বসে ‘হা’ করে থাকা লাগবে এন্ডিং দেখে।

বই : শোণিত উপাখ্যান – অতীত
লেখক : সৈয়দ অনির্বাণ
জনরা : হিস্টোরিক্যাল আরবান ফ্যান্টাসিblank

ইতিহাস কথা বলে বিজয়ীদের কথা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় অতীত গৌরবের। কিন্তু কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ঘটনাবলির কতটুকু তাতে অটুট থাকে?

“শোণিত উপাখ্যান – বর্তমান”এ বর্ণিত ঘটনার ব্যাখ্যা পেতে হলে, যেতে হবে অতীতে, জানতে হবে মহাকালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া সেসব ঘটনাবলি, যার লেজ ধরেই আজ জমে উঠেছে এক বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ।

যেতে হবে এমন অতীতগুলোতে, যেসব অতীতের ইতিহাসে রয়ে গেছে বিশাল বিশাল ফাঁক-ফোকর। আলেক্সান্ডার, অ্যাটিলা দ্য হান, চেঙ্গিস খান, বাবরের দরবারে। জানতে হবে বীরযোদ্ধা বাঘাতুর ও পুরোহিত অবলোহিতের গল্প।

জানতে হবে, তরঙ্গের বেড়ে ওঠার গল্প, রুমী ও ঝুমুরের হঠাৎ ভালোবাসার গল্প। দেখতে হবে ভয়ঙ্কর পিশাচের গ্রামে কী ঘটেছিল?

কী করেই বা অ্যান্ড্রিয়াস ক্যাপ্টেন হলো, কেনই বা সে অর্ধ জীবন্মৃত? কী’ই বা অ্যান্ড্রিয়াস, তরঙ্গ, সাদা হাত, গ্রে ব্রাদারহুড এসবের সম্পর্ক?

বারো বছর আগে মীরানার সাথে’ই বা অবলালের কী ঘটেছিল? কী অসমপ্ত কাহিনী’ই লুকিয়ে ছিল অতীতে?

সব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে রক্তের ধারাতে।

“শোণিত উপখ্যান – বর্তমান” এর শেষে এসে লেখক যেভাবে ক্লিপহ্যাঙ্গিং করে রেখেছিলেন, সেটার জন্য “শোণিত উপাখ্যান – অতীত” পড়া শুরু করি। বইটি তিন অধ্যায়ে বিভক্ত। ‘সুদূর অতীত’, ‘পিশাচের গ্রাম’, ‘জীবন্মৃত’। প্রতি অধ্যায় আবার অনেকগুলো ভাগে বিভক্ত।

সম্রাট বাবর, আটিলা দ্য হান, আলেকজ্যান্ডার দ্য গ্রেট এর ঘটনাগুলো ভালো লেগেছে। অশিনের, রুমীর, ঝুমুরের চরিত্রগুলোও ভালো লেগেছে। পিশাচের গ্রামের ঘটনা এবং তরঙ্গের ও অ্যান্ড্রিয়াসের অরিজিন স্টোরি, তাদের এক হবার কাহিনীগুলোও ভালো লেগেছে।

লেখনী বরাবরের মত ভালো লেগেছে। সংলাপও আগের বইয়ের তুলনায় ভালো লেগেছে। সব মিলিয়ে অসাধারণ একটি হিস্টোরিক্যাল আরবান ফ্যান্টাসি।

বই : ডানায় আগুন
লেখক :আরিয়ান শুভ
জনরা : সুপারহিরো ফ্যান্টাসি থ্রিলারblank

গল্পটা কবে, কিভাবে শুরু হয়েছে কেউই বলতে পারবে না। কে বা কারা, কেন শুরু করেছিলো, তাও জানা নেই কারো। তবে শুরু যে হয়েছে, সেটার আলামত টের পাওয়া গেছে অনেক আগেই।

এটা আসলে গল্পের শুরু নয়, বরং শেষ পরিনতির শুরুর গল্প। গল্পটা ক্যাপ্টেন শহিদুলের, আর্মি ইন্টেলিজেন্সে একটি ফ্যাসিলিটি সেন্টারের ভেতর আটকে থাকা ক্যাপ্টেন শহীদুলের। প্রায় এগারো মাস চলে অকথ্য নির্যাতন। বলা হয়ে থাকে, এর কারণ হচ্ছে তথ্য সংগ্রহের ব্যর্থতা আর তথ্য গোপন করার চেষ্টা। আসল কারণ কি এটাই ছিলো নাকি অন্য কিছু? ফ্যাসিলিটি সেন্টারে থাকতে থাকতে তিনি একসময় নিজের ভেতর দ্বৈত সত্ত্বার উপস্থিতি বুঝতে পারেন। আসলেই কি তিনি স্প্লিট পার্সোনালিটির মতো কোন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন নাকি অন্য কোন ব্যাখ্যা আছে এর পেছনে? ফ্যাসিলিটির লোকগুলো কি সত্যিই সামরিক বাহিনীর?

গল্পটা ইউনিট চিফ ও তার প্রিয় ডেস্ক এজেন্ট আফসানা মীরাজের, বাংলাদেশ সিক্রেট অপারেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইউনিট দেশের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

গল্পটা রাজধানীর দক্ষিণখানে এক সকালে পাওয়া অজ্ঞান, নগ্ন এক তরুণের। ছেলেটির স্মৃতি বলতে কিছুই নাই। পরে ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় ছেলেটির অদ্ভুত সব ক্ষমতা আর সেই সাথে ছেলেটিকে উদ্ধার করার পর থানা থেকে নিয়ে যায় ইউনিটের চিফ এবং আফসানা। তারপর প্রকাশ পায় নাম পরিচয়বিহীন ছেলেটির অস্বাভাবিক মানসিক ক্ষমতা এবং ডিএনএ গঠন। তাকে দেখার জন্য ডিপার্টমেন্ট অব এক্সট্রা নরমাল অপারেশন থেকে যে ৪ জন লোক আসেন তারা কি আসলেই সিআইএ নাকি এই নামের আড়াল নেয়া অন্য কেউ?

হ্যাঁ, গল্পটা মানুষের ক্ষমতার শিখরে পৌঁছাবার অন্তহীন প্রচেষ্টার। আর গল্পটা অবশ্যই দ্য রেবেলয়নের। তাদের আছে নিজস্ব কিছু ইচ্ছা, পরিকল্পনা, স্বপ্ন। মূলত তাদের এইসবের কারণেই পাল্টে যায় কাহিনীর মূল চরিত্রগুলোর জীবনযাপনের ধরণ। এমনও হতে পারে এই চক্রটি না থাকলে গল্পটিই হতো না!

কান পেতে শুনতে চেষ্টা করুন। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। খুব খারাপ কিছু, যেখানে আমরা সবাই এক একটি চরিত্র।

লেখক সার্থক তার প্রথম বইয়েই। কারণ পড়তে পড়তে আমার সময়টা খুব ভালভাবেই কেটেছে। শুরুর দিকে লেখা খুব ধীরে ধীরে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষের দিকে দৌঁড়েছে। এত ডিটেইলস থাকা থ্রিলার পড়তে একটু অন্যরকম ভাল লাগে।

লেখক বেশ ভালোভাবেই ক্যারেক্টার ডেভেলপ করেছেন। অনেকগুলো টুইস্ট দিয়ে রেখেছেন লেখক। আবার টুইস্টগুলোও এমন সব জায়গা থেকে টেনে দিয়েছে যে, বই পড়ার সময় পাঠক হয়তো ঐ অংশগুলো ভালভাবে খেয়ালও করবে না। পড়তে পড়তে যখন টুইস্ট আসবে সামনে, ঠিক তখনই মনে হবে যে, “এই অংশটা এত সাধারণ ভাবছিলাম!!”

আরিয়ান শুভ’র ডানায় আগুন পাঠককে কল্পিত রোমাঞ্চে ভরপুর আর আগ্রহোদ্দীপক এক উপাখ্যানের ভেতর টেনে নিয়ে যাবে।