ডার্ক চকলেটের মিষ্টতার পেছনের সেই তেতো গল্প

 

 

“তোমরা যখন চকলেট খাচ্ছ, তখন তারা আমাদের মাংস খুবলে খাচ্ছে”

 

একবিংশ শতাব্দির কোন এক বিশেষ দিন! হতে পারে সেটা ভালোবাসা দিবস, হতে ফ্রেন্ডশিপডে কিংবা হতে পারে আপনার প্রিয়জনের জন্মদিন। উপহার হিসেবে হয়তো আপনি তাঁদের হাতে তুলে দিলেন চকোলেটের গিফট প্যাক। আর এর মাধ্যমেই আপনি কানেক্টেড হয়ে গেলেন শত শত মাইল দূরে ঘানার কোন কোকফার্মে কাজ করা ‘দান্সো’র দুঃখ-কষ্টের সাথে। কিভাবে? আসুন জেনে নেই এর পিছনের গল্প।

পশ্চিম আফ্রিকার এক ছোট্ট দেশ ঘানা। কালো মাটি, কালো মানুষের এই দেশ থেকেই পৃথিবীর মোট ৪০শতাংশ কোকো উৎপাদন হয়। এই কোকোর চাহিদা সারা বিশবেই রয়েছে। আর এর পেছনে রয়েছে কাড়ি-কাড়ি অর্থের হাতছানি। দান্সো সেই দেশের এক পাঁচ বছর বয়সী শিশু। নেই কোন শিক্ষার আলো, নেই কোন বিনোদনের মাধ্যম। তবুও ভালোই কাটছিল দান্সোর জীবন তার পরিবারের সাথে। জীবনের হিসেবে-নিকেশের পাঠ পড়ে উঠার আগেই দান্সো’র ঠাই হয় নিজের ঘর থেকে অনেক দূরে এক গহিন জঙ্গলে। মাত্র ৭০ডলারের বিনিময়ে মানব দাসে পরিণত হলো দান্সো। চমকাবেন না! প্রতিদিন এমন হাজার হাজার দান্সো পাচার হয়ে যায় মালি,  ফাসো এইসব প্রতিবেশী দেশ থেকে ঘানা, আইভরির এসব কোকো ফার্মগুলোতে। সেখানে তাঁদের প্রধান এবং একমাত্র কাজ হলো কোক সংগ্রহ করা। পশ্চিম আফ্রিকার শিশুরা তীব্র দারিদ্র্য দ্বারা বেষ্টিত তাদের পরিবারকে সহায়তা করার জন্য অল্প বয়সে কাজ শুরু করে। এদের মধ্যে কিছু শিশু কোকো ফার্মে ঠাই পায় কারন তাদের আত্মীয়স্বজন, যাদের কাছে কোকো ফার্মের বিপজ্জনক কর্ম পরিবেশে একদম অজানা এবং তারাই এই শিশুদের ট্রাফিকারদের বা খামার মালিকদের “বিক্রি” করে দেয়। ট্রফিকারদের নজর থাকে এমনসব অঞ্চলের দিকে যেখানের মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছে। সেসব মানুষদের সামান্য অর্থের লোভ দেখিয়ে এই শ্রম তাঁরা কিনে নেয়।

আসুন এবার দেখি এসব ফার্মে এই শিশুদের দিনকাল। কোকো ফার্মগুলিতে কর্মরত বেশিরভাগ শিশুর বয়স ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে বলা হলেও প্রায়শই ৫ থেকে ৭ বছরের শিশুকে খুঁজে পাওয়া যায়। উপরন্তু এই শিশুদের ৪০শতাংশ হয় মেয়ে, এবং কয়েক মাস থাকার পর এরা এক খামার থেকে অন্য খামারে স্থানান্ত্রিত হয়। সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রম করানো হয় এই শিশুদের। খাদ্য বলতে সস্তার ভুট্টা সেদ্ধ আর কলা। মাঝে মাঝে কপালে তাও জুটে না। রাত্রে জানোয়ারের মতন জানলা দরজা হীন কাঠের আস্তাবলে ফেলে রাখা হয় তাঁদের। কখনো শিকল দিয়ে বেঁধে। এদের মধ্যে যারা পালানোর চেষ্টা করে তাদের ভাগ্যে থাকে বেধরক মার। মার খেয়ে বা ধর্ষণে মরে গেলে হয় নদীতে ফেলে দেওয়া হয় বা কুকুরের মুখে ছুঁড়ে দেওয়া হয় শরীর। কোকো ফার্মের শিশু শ্রমিকদের মধ্যে যে ৪০% মেয়ে রয়েছে তাঁদের অবস্থা আরো করুণ । এই কোকো ফার্মেই তাদের বয়সন্ধি আসে, যৌবন আসে। এদের অধিকাংশই সারা জীবনে তাদের পরিবারের সাথে দেখা করতে পারে না। কারণ এখানে কাজ করতে আসাটা যতটা সহজ, বেরোনো তার থেকে কোটিগুন কঠিন। মালিক, ঠিকাদার, সুপারভাইজার, পুলিশ এমনকি মজুরদের যৌনতৃপ্তি মেটায় মেয়েরা। এমন দেখা গেছে ১১ বছরেও গর্ভবতী হয়ে পড়ে এই সব মেয়ে শ্রমিকরা।blank এক ফার্ম থেকে অন্য ফার্মে হাতবদল হলেও এদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়না। এইসব ফার্মের কাজের ধরনের কাছে এসব অত্যাচার নশ্যি মনে হবে। বাচ্চাদের কে “ম্যাশেটি” নামের এক অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়া হয় যাতে কোকো বিন পেড়ে সেটাকে বস্তায় পুড়ে ঝাড়াই বাছাই করার জন্য নিয়ে আসে। ম্যাশেটি হল এমন একটি ছুরি যা চালালে একটা শিশুকে কিমা বানিয়ে দেওয়া যায় কয়েক মিনিটেই। এই ভয়ংকর অস্ত্র ব্যাবহারে কারোর আঙুল কাটা যায়, কারোর গায়ে তৈরি হয় গভীর ক্ষতের। সামান্য এক ১০ বছরের বাচ্চাকে পিঠে ১০০ কেজির বস্তা নিয়ে চলতে হয় অনেকটা পথ। চলার পথে একদন্ড থামার জো নেই। একটু বিশ্রামের জন্য দাড়ালেই সহ্য করতে হয় চাবুকের বাড়ি। এদেরকে কোকো সংগ্রহের জন্যে পাঠানো হয় এমনসব স্থানে যেখানে এর আগে মানুষের পা পরেছে নাকি সন্দেহ। এসব জায়গায় পাঠানোর জন্যে শিশুরাই প্রথম পছন্দ। কারন এরা বাচল কি মরল এতে মালিক পক্ষের কিছু যায় আসে না, তার ওপরে তারা কোকো ফিল্ডের দুর্গম জায়গায় যেতে পারে, যেখানে একটু বড়রা ঢুকতে পারবে না। হ্যা, পোকা, সাপ আর বিছের কামড়ে বেশ কিছু বাচ্চা মারা যায়, কিন্তু তাতে মালিকদের কি। এক বাচ্চা হারালে শত শত এমন বাচ্চা আছে কাজ করার জন্য।

blank
ম্যাশেটি হাতে শিশু শ্রমিক

এসব ফার্মের কোকোর অন্যতম ক্রেতা বিশ্ববিখ্যাত চকোলেট কোম্পানিগুলো যেমন নেসলে, হার্সেস, মার্স, ক্যাটবেরি ইত্যাদি। প্রতিযোগিতার বাজারে কোকোর দাম কম রাখার জন্যই শিশু শ্রমিক দরকার হয়। এজন্যে বড় বড় কোম্পানির নজর থাকে এসব অঞ্চলের দিকে।

একটা সময় এসকল অত্যাচার-নিপীড়ন সকলের অগোচরে হলেও এখন এই বিষয়টি সকলের সামনে আসছে। সম্প্রতি, তদন্তকারীরা পশ্চিম আফ্রিকান কোকো খামারগুলিতে পাচার করেছে এমন শিশুকে খুঁজে পেয়েছে এবং তাঁরা এও দেখেছে যে, বেতন ছাড়াই এই শিশুদের কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইটস ফোরামের ডিরেক্টর অ্যাববি মিলস আরও বলেন, “[পশ্চিম আফ্রিকায়] প্রতি গবেষণা গবেষণাটি দেখায় যে, বিশেষ করে আইভরি কোস্টে মানব পাচার হচ্ছে।”  কোকো শিল্পের দাসত্ব সমগ্র বিশ্ব জুড়ে দাসপ্রথার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠত এবং একই মানবাধিকার লঙ্ঘন এর সাথে জড়িত।

এখুন আসলেই কি “স্লেভ ফ্রি চকলেট” পসিবল!! শিশু শ্রম, দাসত্ব এবং মানব পাচার রোধের অবদান রাখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তাদের ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও,  চকলেট শিল্পে চাইল্ড লেবার সমস্যা সমাধান করার জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ তাঁরা গ্রহণ করেনি। সারা বিশ্বে $৬0 বিলিয়নের চকলেট শিল্পের মধ্যে সম্পৃক্ত চকোলেট কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য জন্য ক্রয়ের জন্যে শিশু শ্রম এবং ক্রীতদাস শ্রম ব্যবহারের শেষ করার ক্ষমতা রাখে। বর্তমানে সল্প পরিসরে কোকো ফার্মে বিক্রি করা শিশুদেরকে উদ্ধার ও পুনর্বাসন করার জন্য চকোলেট শিল্পকে আরো বিকাশত করার জন্যে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু এই অপ্রতুল প্রচেষ্টায় আসলে কোন বড় পরিবর্তন চোখে পরছে না। এখনো লাখ লাখ শিশু এই দাসতের যাতাকলে পিষ্ট।

 

blankহয়তো আমার এই লেখা আপনাদের উপর কোন প্রভাব পড়বে না। হয়তো আপনার প্রিয়জনের মুখে লেগে থাকা চকোলেটের খয়েরী দাগ আপনাকে দান্তের কথা মনে করাবে না। কিন্তু জেনে রাখবেন এই সকল শিশুদের দুক্ষ-দুর্দশার জন্যে আমরাও দায়ী। আমাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে আজ বলি হচ্ছে হাজারো শিশু। তাই স্কলে সতর্ক হই, নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই অন্ধকার শ্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

জানাই। দান্তেরা চকোলেট খায়নি কোনোদিন। জানে না এর স্বাদ। কিন্তু দান্তেরা চায় বাঁচতে, চায় একটু সুখ পেতে। চকোলেটের রঙ্গিন মোড়ক বর্জন করেই আমরা তাঁদেরকয়ে দিতে পারি এই সুযোগ।

কোকো ফার্মের শিশুদের মানবেতর জীবনযাত্রা নিয়ে মিকি মিস্তারতি এবং রবিন রোমানোর ২০১০ সালে করা “The dark side of chocolate” শীর্ষক ডকুমেন্টারির লিংকঃ The dark side of chocolate

আমার লেখার এই ডকুমেন্টারির থেকে অনুপ্রাণিত।