কখনো ভেবে দেখেছেন, কেন আপনার বাচ্চা স্কুলে যেতে চায় না?

সারাদিন আপনার বাচ্চা হৈ চৈ করে ঘরময় খেলছে। অসম্ভব প্রাণবন্ত একটি শিশু কেবল স্কুলে যাওয়ার আগেই কান্নাকাটি করছে, না যাওয়ার জন্য নানান অজুহাত দেখাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে সে এমনটা করতে পারে। তাই আপনাদের সামনে আমি কিছু সম্ভাব্য কারণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি যেগুলো হতে পারে আপনার বাচ্চার স্কুলের প্রতি অনীহার কারণ।

১: গৎবাঁধা নিয়ম

স্কুলজীবন আমরা সবাই পার করে এসেছি। একসময় আমাদের কাছেও খানিকটা বিরক্তিকর লাগতো কেননা স্কুলগুলো চলতো একটা গৎবাঁধা নিয়মে। রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠা, সময়মতো দিনের পর দিন স্কুলে যাওয়া, একই ক্লাস করা, একই ভাবে বাড়িতে ফিরে আসা। বড় হওয়ার পর ব্যাপারগুলো গা সওয়া হয়ে গেছে কিন্তু একসময় ব্যাপারটা খুব বিরক্তিকর ছিলো। আমাদের বাচ্চাদের সাথেও তাই হচ্ছে। প্রতিদিনের এই ছককাটা নিয়মে তাদের দিন চলছে। তারাও মাঝেমাঝে ক্লান্ত বোধ করে। তাই তারা স্কুলে যাওয়ার আগে মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা এই ধরণের ছোট ছোট অজুহাত দেখিয়ে স্কুলে যাওয়ার হাত থেকে নিস্তার পেতে চায়। তাছাড়া বাচ্চাদের ছুটির দিনগুলো কাটে হোমওয়ার্কের ফাঁদে আটকে। তাই প্রায়ই তারা স্কুলের প্রতি অনিচ্ছা প্রকাশ করে।

২: বিরক্তিকর ক্লাসরুম

বেশিরভাগ স্কুলের ক্লাসরুমগুলো সাদামাটা। একসাথে অনেকগুলো ছাত্রছাত্রী একসাথে বসছে, পড়া টুকছে, ক্লাস থেকে বের হয়ে আসছে। টিফিন পিরিয়ড বা খেলাধুলোর ক্লাস ছাড়া বেশিরভাগ স্কুলগুলোতেই বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের কোন ব্যবস্থা নেই। স্কুলের প্রতি বাচ্চাদের অনাগ্রহের এটি একটি অন্যতম কারণ।

৩: শাস্তি

স্কুলগুলোতে বাংলাদেশ সরকার শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করলেও মানসিক শাস্তি কিন্তু বাচ্চাদের ঠিকই দেয়া হচ্ছে। হোমওয়ার্ক না করলে, ক্লাসে কথা বললে, দেরী করে ক্লাসে ঢুকলে, একটু দুষ্টুমি করলে ঠিকই তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। প্রিন্সিপালের রুমে পাঠানো, বাবামায়ের কাছে নালিশ, ক্লাসের বাইরে পাঠানো, কানে ধরে দাঁড়া করানো এসব কিন্তু ঠিকই হচ্ছে। এসব শাস্তির ভয়েও বাচ্চারা অনেকসময় স্কুলে যেতে চায় না।

৪: অভিভাবক এবং শিক্ষকদের বৈঠক

বাবামায়ের সাথে শিক্ষকদের আলাপের দিন অর্থাৎ “Parents-Teacher Meeting” এর দিন বেশিরভাগ বাচ্চাই ভয়ে ভয়ে থাকে। কারণ এই দিন তার সমস্ত কার্যকলাপ শিক্ষকগণ তার বাবামায়ের কাছে তুলে ধরেন। বাচ্চাদের সমস্ত দোষত্রুটি তাদের বাবামায়ের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়। আর এই পুরো ব্যাপারটিতে মাথা নিচু করর দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া বাচ্চাটির আর কিছু করার থাকেনা। এই দিনটি নিয়ে বাচ্চাদের মনে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এটিও তার স্কুলজীবন অপছন্দ করার একটি কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

৫: আকস্মিক পরীক্ষা

“সারপ্রাইজ টেস্ট” বাচ্চাদের জন্য এক মূর্তিমান বিভীষিকা। হঠাৎ করে স্কুলে যাওয়ার পর তারা জানতে পারে যে, আজকে পরীক্ষা নেয়া হবে। অনেকেরই পূর্বপ্রস্তুতি থাকে না, তাতে পরীক্ষা খারাপ হয়। আর পরীক্ষা খারাপ মানেই বাড়িতে বকা শোনা, টিচারের কটুক্তি। তাই অনেকসময় সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় বাচ্চাদের মনে ভীতি কাজ করে যে, “আজ আবার কোন সারপ্রাইজ টেস্ট হবে না তো?”

৬: রাগী শিক্ষক

সাধারণত বাচ্চাদের শিক্ষকেরা হাসিখুশী থাকেন। কিন্তু মাঝেমাঝেই এমন কিছু শিক্ষক দেখা যায় যারা অতিরিক্ত নিয়মনিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের ছাত্রছাত্রীদের শৃঙ্খলা শেখাতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু সব বাচ্চারা এক নয়। এক এক বাচ্চার মনস্তাত্ত্বিক গঠন একেক রকম। সবাইকে একই ছাঁচে ঢেলে গড়া সম্ভব না। তাছাড়া বাচ্চাদের সাথে যতটা কোমল স্বরে কথা বলা যায় ততই মঙ্গল। অনেকসময় রাগী শিক্ষক এবং তাদের বকাঝকা শোনার ভয়েও বাচ্চারা স্কুলে যেতে চায় না।

৭: তর্জন

তর্জন বা “Bullying” একটি অন্যতম প্রধাণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে যে কারণে বাচ্চারা স্কুলের প্রতি তীব্র ইচ্ছা পোষণ করে। এটি শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই এর কারণে অনেক বাচ্চা স্কুলে যেতে চায় না। আপনার বাচ্চাকে যে কেউ উত্যক্ত করতে পারে। তার সহপাঠী, উপরের ক্লাসের কোন ছাত্র/ছাত্রী এমনকি তার শিক্ষকও। এতে বাচ্চার কোমল মনের ওপর প্রচণ্ড আঘাত পরে। তারা অপমানিত বোধ করে, লজ্জা এবং ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। হতেই পারে যে কেউ আপনার বাচ্চাকে উত্যক্ত করছে কিন্তু সে তার চাপা স্বভাবের কারণে আপনাকে কিছু বলতে পারছেনা। এবং সে স্কুলে না যাওয়ার জন্য নানান টালবাহানা করছে। তাই বাচ্চাদের সাথে কথা বলে জানতে চেষ্টা করুন, তাদের মনের ভেতর কি চলছে। এই Bullying বা তর্জনের কারণে অনেক বাচ্চারাই নানান ধরণের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

৮:  বাড়ির কাজ

বাড়ির কাজ বা হোমওয়ার্ক সবচেয়ে বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। নিজের ছেলেবেলার কথাই ভেবে দেখুন! কিন্তু এখন হোমওয়ার্কের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে ১০ গুণ! সারাদিন ক্লান্তিকর সময় আকুলে কাটানোর পর বাড়ি ফিরে পর্বতপ্রমাণ হোমওয়ার্ক নিয়ে বসতে হয়। স্কুল আর হোমওয়ার্কের মাঝে বাচ্চাগুলোর দম ফেলার ফুরসত নেই। স্কুলে গেলেই একগাদা হোমওয়ার্ক নিয়ে ফিরে আসতে হবে, এই ভয়েই অনেক বাচ্চা স্কুলে যাওয়ার আগেই কান্না জুড়ে দেয়।

জীবনে চলার পথে পড়াশোনা খুব জরুরি। কিন্তু এই ভবিষ্যৎ গড়ার পথে আপনার বাচ্চা তার শৈশব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না তো?