১৪ প্রশ্ন-উত্তরে জানুন করোনা ভাইরাস নিয়ে সঠিক তথ্য, ফেসবুক গুজবকে বলুন ‘না’

corona-virus-myth-and-facts

সবুজ শ্যামল পাহাড় ঘেরা রুপসী বাংলায় অবশেষে হানা দিয়েছে নতুন করোনাভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) যার নাম দিয়েছে COVID-19। গতবছর ডিসেম্বর ৩১, ২০১৯ এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে চীন থেকে উহান নগরীতে একটি নতুন ধরনের সংক্রমনের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা COVID-19 কে মহামারী (Pandemic) ঘোষণা করেছে এবং বিশ্বের অনেক দেশই প্রায় লকড ডাউন অবস্থায় আছে।

বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগের সব থেকে বড় হাতিয়ার যেমন তথ্য, যা মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেখায়, তেমনি সবথেকে বড় সমস্যাটিও ভুল তথ্য। আমাদের জাতিগত সমস্যার মধ্যে তেমনি কান নিয়েছে চিলের পিছনে দৌড়ানো হয়ত অন্যতম একটিই হবে। প্রচুর মানুষ প্রচুর মতবাদের দেশে COVID-19 নিয়েও চলছে প্রচুর গুজব। জ্ঞানপিপাসু হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও CDC এর কাছে তেমনি কিছু প্রশ্নের উত্তর খুজে ফিরছিলাম, যার কয়েকটি আজকের আর্টিকেলে আলোচনা করব।

প্রশ্ন-১: বাড়িতে পোষা প্রাণীর মাধ্যমে কি নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) ছড়িয়ে দিতে পারে?
কুকুর বা বিড়ালের মতো সহচর/পোষা প্রাণী নতুন করোনাভাইরাসে (COVID-19) আক্রান্ত হতে পারে এমন কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায় নি। তবে পোষা প্রাণীর সংস্পর্শের যাওয়ার পরে সাবান ও পানি দিয়ে ভালভাবে হাতমুখ পরিস্কার করা সবসময়ই একটি ভাল অভ্যাস। এটি আপনাকে পোষা প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে এমন বিভিন্ন সাধারণ ব্যাকটিরিয়া যেমন E.coli এবং Salmonella বা অন্যান্য থেকে রক্ষা করবে।

প্রশ্ন-২: নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনগুলি কী নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) থেকে রক্ষা করে?
না। নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন যেমন নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি (Hib) ভ্যাকসিনগুলি নতুন করোনভাইরাস (COVID-19) থেকে সুরক্ষা দেয় না। এটি একটি নতুন এবং আলাদা ধরনের ভাইরাস, তাই এর জন্য নতুন ভ্যাকসিন প্রয়োজন। তবে গবেষকরা COVID-19 এর বিরুদ্ধে একটি ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছে।
যদিও এই ভ্যাকসিনগুলি COVID-19 এর বিরুদ্ধে কার্যকর নয় তবে শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতাগুলির বিরুদ্ধে আপনার স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এসব টিকা নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।

প্রশ্ন-৩: স্যালাইন দিয়ে নিয়মিত নাক ধুলে কি নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সহায়তা করতে পারে?
না। নিয়মিত স্যালাইন দিয়ে নাকে পরিস্কার করলে যে মানুষকে নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করবে এর কোনও ভিত্তি নেই। অল্প কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় যে হালকা সর্দির রোগীদের নিয়মিত স্যালাইন দিয়ে নাক পরিস্কার করলে দ্রুত পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারে। তবে শ্বাসকষ্টজনিত সংক্রমণ রোধ করার জন্য স্যালাইন দিয়ে নিয়মিত নাক পরিস্কার করলে কোন উপকার পাওয়া যায় এমন বক্তব্যের কোন ভিত্তি নেই।

প্রশ্ন-৪: নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) কি শুধু বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্যই ঝুকিপূর্ণ?
সমস্ত বয়সের লোকেরা নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) দ্বারা সংক্রামিত হতে পারে। তবে বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং হাঁপানি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি রোগের চিকিৎসারত অবস্থার আছে এমন লোকেরা এই ভাইরাসে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার জন্য সবথেকে ঝুকিতে আছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সকল বয়সের লোকদের এই ভাইরাস থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখার পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দেয়। উদাহরণস্বরূপ হাত ধোয়া, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা এবং রেসপিরেটরি হাইজিন ( শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার অঙ্গগুলোর যত্ন যেমন- মুখ, নাক) মেনে চলতে পরামর্শ দিয়ে আসছে।

প্রশ্ন-৫: কোন অ্যান্টিবায়োটিক কি নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য কার্যকর?
না, অ্যান্টিবায়োটিকগুলি ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে না। কেবল ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) একটি ভাইরাস। এবং তাই, কোন অ্যান্টিবায়োটিকই নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) প্রতিরোধ বা চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়।
তবে আপনি যদি COVID-19 এর জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন তবে হয়ত অন্যান্য ব্যাকটিরিয়ার কো-ইনফেকশন ঠেকাতে কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজের বুদ্ধিতে/ফার্মেসির দোকানদারের কথায় কখনোই এন্টিবায়োটিক খাওয়া উচিৎ নয়।

প্রশ্ন-৬: নতুন করোনভাইরাস প্রতিরোধ বা চিকিৎসার জন্য কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ রয়েছে কি?
এখন অবধি, নতুন করোনভাইরাস (COVID-19) প্রতিরোধ বা চিকিৎসার জন্য কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। তবে ভাইরাসে আক্রান্তদের লক্ষণগুলি থেকে মুক্তি এবং চিকিৎসা করার জন্য যথাযথ যত্ন নেওয়া উচিত এবং গুরুতর অসুস্থতায় আক্রান্তদের যথাযথ যত্ন নেওয়া উচিত। কিছু নির্দিষ্ট চিকিৎসার ব্যপারে গবেষণা চলছে এবং ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গবেষণা এবং উন্নয়নের প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করছে।

প্রশ্ন-৭: পাবলিক টয়লেটের হ্যান্ড ড্রায়ারগুলিতে ৩০ সেকেন্ড হাত রাখলে COVID-19 ভাইরাস মরবে কি?
না। হ্যান্ড ড্রায়ার COVID-19 ধ্বংসের জন্য কার্যকর নয়। নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) থেকে নিজেকে রক্ষা করতে, আপনার ঘন ঘন হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে আপনার হাত পরিষ্কার করা উচিত বা সাবান এবং পানি দিয়ে ভাল করে হাত ধোয়া উচিত। হাত ধোয়া হয়ে গেলে পেপার টাওয়েল বা পারসোনাল কাপড় দিয়ে ভাল করে মুছে নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন-৮: N95 মাস্ক কি বারবার ব্যবহার করা যায়? আমি কি এটি ধুতে পারবো? আমি কি হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে এটি পরিস্কার করতে পারি?
না। মেডিকেল মাস্ক বা N95 মাস্ক সহ ফেস-মাস্কগুলি পুনরায় ব্যবহার করা উচিত নয়। যদি আপনি COVID-19 বা অন্যান্য শ্বাস প্রশ্বাসের জনিত সংক্রমণে আক্রান্ত এমন কোনও ব্যক্তির সংস্পর্শে যান তবে আপনার মাস্কের সামনের অংশটি দূষিত হয়ে পড়তে পারে। তখন আপনার মাস্কের সামনের অংশে হাত স্পর্শ না করে সরিয়ে ফেলা উচিত এবং এটি যথাযথভাবে ঢাকনাওয়ালা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া উচিত। মাস্ক অপসারণের পরে আপনার উচিত হ্যান্ড স্যনিটাইজার বা সাবান-পানি দিয়ে ভালভাবে আপনার হাত ও মুখমন্ডল পরিস্কার করা।

প্রশ্ন-৯: একটি অতিবেগুনী (ইউভি) রশ্মির সাহায্যে নতুন করোনভাইরাস (COVID-19) কে ধ্বংস করতে পারি?
অতিবেগুনী (ইউভি) রশ্মির সাহায্যে ভাইরাস মারা যায়, তবে হাত বা ত্বকের অন্যান্য অংশগুলিকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য ইউভি ল্যাম্প ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ ইউভি রেডিয়েশনের কারণে ইরাইথেমা (ত্বকের জ্বালা) হতে পারে।

প্রশ্ন-১০: আমার সারা শরীর জুড়ে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন স্প্রে করে কি নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে?
না। আপনার সারা শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন স্প্রে করলে তা আপনার শরীরে ইতিমধ্যে ঢুকে গেছে এমন ভাইরাসকে হত্যা করবে না। এই জাতীয় পদার্থের স্প্রে করলে তা কাপড় ও কোষ ঝিল্লির (যেমন, চোখ, মুখ ইত্যাদির) জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। অ্যালকোহল এবং ক্লোরিন উভয়ই মেঝে বা অন্যান্য স্থানকে জীবাণুমুক্ত করতে কার্যকর হতে পারে তবে তাদের যথাযথ নিয়মে তা ব্যবহার করা উচিত।
নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আপনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। তারমধ্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে আপনার হাত ঘন ঘন পরিষ্কার করা বা সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা অন্যতম।

প্রশ্ন-১১: গরম এবং আর্দ্র জলবায়ু এমন অঞ্চলে COVID-19 ভাইরাস ছড়াবে না?
এখনও পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, COVID-19 ভাইরাস গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়া সহ অঞ্চল সহ সমস্ত অঞ্চলে সংক্রমিত হতে পারে। জলবায়ু নির্বিশেষে আপনি যদি COVID-19 এর সংক্রমন হয়েছে এমন স্থানে বসবাস করেন বা ভ্রমন করেন তবে নিজের জন্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। COVID-19 এর থেকে নিজেকে রক্ষার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে ঘন ঘন আপনার হাত পরিষ্কার করা। এটি করে আপনি আপনার হাতের ভাইরাসগুলি ধুয়ে ফেলে আপনার চোখ, মুখ এবং নাকের মাধ্যমে এর সংক্রমণ এড়াতে পারেন।

প্রশ্ন-১২: শীত আবহাওয়া এবং তুষারের দেশে নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) আক্রমন করতে পারবে না।
ভুল। শীতল আবহাওয়া নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) বা অন্যান্য রোগকে মেরে ফেলতে পারে বলে বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। বাহ্যিক তাপমাত্রা বা আবহাওয়া নির্বিশেষে মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা প্রায় ৩৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি থাকে। নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) থেকে নিজেকে রক্ষা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা সাবান-পানি দিয়ে ঘন ঘন আপনার হাত পরিস্কার করা।

প্রশ্ন-১৩: গরম পানি দিয়ে গোসল করলে নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) থেকে তা প্রতিরোধ করবে?
গরম পানি দিয়ে গোসল করলে আপনাকে COVID-19 এর সংক্রমন থেকে তা বিরত রাখবে না। আপনার গোসলের পানি যত গরম বা ঠান্ডাই হোক না কেন আপনার দেহের তাপমাত্রা প্রায় ৩৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি থাকে। আসলে, বেশি গরম পানি দিয়ে গোসল করা ক্ষতিকারক হতে পারে, কারণ এতে চামড়া পুড়ে যেতে পারে। নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) থেকে নিজেকে রক্ষা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা সাবান-পানি দিয়ে ঘন ঘন আপনার হাত পরিস্কার করা।

প্রশ্ন-১৪: নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) মশার কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমণিত হয় কি?
নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) মশার মাধ্যমে সংক্রমণ হতে পারে, এখন অবধি এমন কোনও তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া যায় নি। নতুন করোনাভাইরাস (COVID-19) একটি রেসপিরেটরি বা শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস যা প্রাথমিকভাবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি, হাঁচি, নাকের সর্দি বা মুখের লালার মাধ্যমে ছড়ায়। নিজেকে রক্ষা করতে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা সাবান-পানি দিয়ে ঘন ঘন আপনার হাত পরিস্কার করুন। এছাড়াও, হাঁচি-কাশি আছে এমন কারও সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এড়িয়ে চলুন।

যেহেতু বিশ্বে চলছে মহামারী ও তা প্রতিরোধে চলছে প্রচুর গবেষণা। ফলে এখন যেটি ছিল সত্য, দুদিন পরে তার খন্ডন যে হবে না, তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। তাই উল্লেখ করা হচ্ছে যে আজ যে সকল আলোচনা করা হবে তার লেখার তারিখ ১৫ই মার্চ, ২০২০ পর্যন্ত। অর্থাৎ, ১৫ই মার্চ, ২০২০ এর পরে যদি কোন নতুন সত্য উন্মোচিত হয় এবং এখানে আলোচিত কোন তথ্য যদি খন্ডন করা হয়, তার জন্য লেখক বা প্রকাশক কেউই দায়ী থাকবে না।