বাবা – সন্তানের প্রথম ও শেষ হিরো

আচ্ছা সব সময় মা মা আর মা করতে যেয়ে আমরা বাবার কথা ভুলে যাই না তো?! না তা হয়তো না! তবে মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে যেয়ে বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করাই হয়ে ওঠে না যে আর। শুধুমাত্র এক্ষেত্রেই নয় আরও অনেক ক্ষেত্রেই বাবারা যে মায়েদের থেকে অনেকাংশেই পিছিয়ে। কিন্তু বাবাদের ত্যাগ তিতিক্ষা তো কোন অংশেই কম নয়। বাবা সে তো সূর্যের মত অফুরন্ত নবায়নযোগ্য শক্তির এক উৎস।

জানি জন্মদাতা হওয়া সহজ কিন্তু একজন ভালো পিতা হওয়া অত্যন্ত কঠিন। কারণ একটা সন্তানের জন্ম শুধুমাত্র মায়ের পেট থেকেই নয় বরং বাবার হৃদয় থেকেও হওয়া চাই। নতুবা সেই জন্ম যে সব সময় অসম্পূর্ণই রয়ে যায়। মা বোঝে তার সন্তানের কতটুকু ক্ষুধা লেগেছে আর বাবা বোঝে তার সন্তানের কতটুকু টাকার প্রয়োজন। দু’টোই যে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ একজন সন্তানের জন্য।

একটা মেয়ে জানে যে তার বাবার থেকে ভালো তাকে আর কেউ বাসতে পারবে না। সে আরও জানে পৃথিবীর সব পুরুষ তাকে ধোঁকা দিলেও একমাত্র বাবাই তাকে কখনো ধোঁকা দেবে না। আর একটা ছেলে জানে বাবা যতদিন বাবার হোটেলও তার ঠিক ততদিন।

শুনেছি, পৃথিবীর এক এক দেশের বাবারা নাকি একেক রকম হয়! তবে আমি হলফ করে বলে পারি আমার বাবা যে দেশের নাগরিকই হতেন না কেন আমাকে ঠিক ততটাই ভালোবাসতেন, যতটা এখন তিনি আমাকে বাসেন। হয়তো বেশি ভালোবাসলেও বাসতে পারতেন তবে কম ভালোবাসার কোন সম্ভাবনাই নেই! অবশ্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট যেহেতু একেবারেই আলাদা। তাই এখানকার বেশিরভাগ জন্মদাতাই একজন ভালো পিতা।

ছোটবেলায় ঈদের কথা মনে পড়লে এখনো মনে হয় আমাদের সবার প্রয়োজনমত সবকিছু কেনা হলেও আব্বুর কোনবারেই কোনকিছুরই প্রয়োজন হতো না, তাই কেনাও আর হতো না। আবার একজোড়া মাত্র জুতো পরে কিভাবে বছরের পর বছর পার হয়ে যেতো আব্বুর, সেটার কারণ হয়তো একমাত্র বাবারাই বলতে পারবেন! ওদিকে আমার চাচা একটা মাত্র শার্ট পরেই কিভাবে যে দিনের পর দিন অফিস করতেন, সেটা আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি! অথচ আমাদের ভাইবোনদের জামাজুতোর অভাব হয়নি কোনদিনও। ছোটবেলায় আব্বুর বাইরে যাওয়া মানেই ছিল কিছু না কিছু নিয়ে বাসায় ফিরে আসা আর জুম্মার নামাজে যাওয়া মানেই ছিল জিলেপি আনা!

একবার গ্রামের বাড়ি থেকে আসার সময় ট্রেনে উঠতে যেয়ে পিছনের যাত্রীর পায়ের সাথে ধাক্কা লেগে আমার একটা জুতো ট্রেনের বগির নিচে পড়ে গিয়েছিলো। ট্রেনের সকল যাত্রীরা নিষেধ করা শর্তেও আমার আব্বু একবারও নিজের জীবনের কথা না ভেবে, শুধুমাত্র আমি কিভাবে খালি পায়ে বাসায় ফিরবো ভেবে এক লাফ দিয়ে নিচে থেকে জুতোটা তুলে এনেছিলেন! আর তখন ট্রেন ছেড়ে দিলে কি হবে ভেবেই আমার চোখ থেকে অঝরে জল ঝরেছিল সেদিন। অবশ্য সে কথা মনে পড়লে এখনো আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যায়!

সে দিন বুঝেছিলাম সুপারম্যান চরিত্রটা কাল্পনিক হলেও, আমার সামনেই যে সুপারড্যাড বলে যে ব্যক্তিটা আছেন তিনি মোটেও কাল্পনিক নয়। হ্যাঁ সুপারড্যাড আমার আছে সত্যি সতিই!

আব্বু অফিস থেকে আসলে ঘামে ভেজা শরীর দেখেও বুঝতাম না টাকা উপার্জন করা কতটা কঠিন! ভাবতাম অফিস গেলেই বুঝি এতো এতো টাকা পাওয়া যায়! আব্বু যদি অবসর গ্রহণ না করতেন তাহলে হয়তো টাকার মূল্য আমি বুঝতেই পারতাম না। অথচ এখনো পেনশিয়ানের সামান্য টাকা থেকে চা পান না খেয়ে কিছু টাকা বাঁচিয়ে আমাকে দিয়ে দিতে দু’বার ভাবেন না তিনি!

স্বভাবসুলভ এখনো আমার আব্বুর কিছুই লাগে না। যে শুধুমাত্র দিয়েই খুশি, বিনিময়ে কিছুই না চেয়ে বরং আরও অনেক কিছু না দিতে পারার আক্ষেপই তার চোখে বেশি। হাসিমুখে সাধ্যমত দিতে পারলেই যেন পেয়ে যান সবকিছু। সত্যি তার মত আর কেউ না কেউ না। তারই তো অবদান সবচেয়ে বেশি।

সত্যি একজন বাবার থেকে বেশি দায়িত্ববান ব্যক্তি আর কে হতে পারে? সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে শুধুমাত্র সন্তানের সুখের নিমিত্তে নিরলস কাজই বা আর কে করতে পারে? একমাত্র বাবা ছাড়া! এর আগেই বলেছি আমাদের দেশের বাবারা অন্যান্য আর পাঁচটা দেশের বাবা তুলনায় একেবারেই আলাদা, তবে তাদের সন্তান হিসেবে আমরা কতটুকুই বা আলাদা? যদি আলাদাই হতাম তাহলে আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম নামক জায়গাটা কি কখনো থাকতো?!
ছোটবেলায় আমরা বাবা-মায়ের সন্তান ছিলাম, বার্ধক্যে তারাই তো আমাদের সন্তান। আর ঠিক সেভাবেই তো তাদেরকে দেখাশোনা করা উচিৎ।

সেই সন্তানই তো সবচেয়ে সৌভাগ্যবান যার মাথার উপরে বাবা নামক বটের ছায়া এখনো বিদ্যমান। তাই আসুন আমাদেরকে মানুষের মত মানুষ করতে যারা সর্বদা স্বার্থহীন সবসময় ব্যাকুল, তাদেরকে আজ থেকে আরও একটু বেশি ভালোবাসি। আর মায়েদের সাথে সাথে বাবাদের প্রতিও ভালোবাসা প্রকাশ করি। সব কিছুর জন্যই তাকে ধন্যবাদ জানাই। এবং জেনে বা না জেনে করা অসংখ্য ভুলের জন্য এখনই মাফ চেয়ে নিই। কারণ কে বলতে পারে মাফ চাওয়ার আর ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ আর হয় কি না হয়। আর কারো বাবা যদি জীবিত না থেকে থাকে তবে আজকের এই বিশেষ দিনে প্রাণ ভরে তার জন্য দোয়া করে দিই, “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানির সাগীরা”। যদিও আমি মনে করি কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা থাকলে প্রতিটা দিনই বাবা দিবস, প্রতিটা দিনই মা দিবস – এর জন্য আলাদা করে দিবসের প্রয়োজন হয় না, কারণ বাবা-মা সন্তানের কাছে আর কিছুই চায় না একটু খানি ভালোবাসা ছাড়া। সবশেষে বাবা নামক হিরোদের সম্মান জানাই প্রতিদিন প্রতিবেলা প্রতিক্ষণ। বাবা নামক শেষ আশ্রয় সর্বদা চিরঅটুট থাকুক এই প্রত্যাশায়, বাবাদের প্রতি ভালোবাসা আর শুভকামনা সবসময়।