স্মার্টফোনের স্বাস্থ্যঝুঁকি: প্রযুক্তির আশীর্বাদ যখন অভিশাপ

স্মার্টফোন এখন আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। একটি মুহূর্তও যেন আমাদের স্মার্টফোন ছাড়া চলে না। দিনে তো বটেই, গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থেকে স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকা এখন অনেকেরই নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির আধুনিকায়নের যুগের এই নতুন অভ্যাস আমাদের চোখ ও মস্তিষ্কের ওপর ফেলছে চরম বিরূপ প্রভাব। যার ফলস্বরূপ শরীরের বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোও নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

স্মার্টফোনের আলো কীভাবে আমাদের শরীরের ক্ষতি করে?
স্মার্টফোনের পর্দা একপ্রকার উজ্জ্বল নীল আলো নিঃসরণ করে, যা দিনের কড়া আলোতেও আমাদেরকে ফোনের পর্দা স্পষ্টভাবে দেখতে সাহায্য করে। এই নীল আলো visible light spectrum এর অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ এর তড়িৎদৈর্ঘ্য অতিবেগুনি রশ্মির মত visibility’র বাইরে নয়, বরং এটি দৃশ্যমান। ফলে রাতের বেলা ফোন ব্যবহার করলে আমাদের মস্তিষ্ক এই নীল আলোকরশ্মির কারণে ধাঁধায় পড়ে যায় এবং একে দিনের আলো হিসেবে ধরে নেয়। কারণ আমাদের মস্তিষ্ক তো সৃষ্টির আদিকাল থেকে এমনভাবেই programmed হয়ে আছে যে, দিনে আলো থাকে এবং সেটি জেগে থাকার সময়; অপরদিকে রাত হয় অন্ধকার এবং এটি ঘুমোনোর সময়। পুরো শরীরের বিভিন্ন সিস্টেম এই নিয়ম অনুসারেই নিয়ন্ত্রিত হয়। তো রাতে স্মার্টফোন ব্যবহারের সময় সেই programming অনুযায়ী নীল আলোকরশ্মির প্রভাবে আমাদের মস্তিষ্ক মেলাটোনিন তৈরি করা বন্ধ করে দেয়। মেলাটোনিন মূলত এমন একটি হরমোন, যা রাতের বেলা নিঃসৃত হয়ে শরীরকে ঘুমিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়ে থাকে। এই মেলাটোনিনের অভাবে ঘুম আসতে বাধা পায় এবং ঘুমের স্বাভাবিক নিয়মে ব্যাঘাত ঘটে। কালক্রমে শরীরের ওপর এর আরো নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে।

স্মার্টফোনের নীল আলোকরশ্মি শরীরের কী কী ক্ষতিসাধন করে?
●রাতে ঠিকমত ঘুম না হলে তা পরদিন স্মৃতিশক্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
●নতুন কিছু শেখায় মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
●দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ঘটলে শরীরে নিউরোটক্সিন তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে ভালো ঘুম হতে দেয় না।
● মাথা, ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা অনুভূত হতে দেখা যায়।
●চোখের ক্ষতি হতে পারে, যেমন-
১) চোখ শুষ্ক বোধ
২) চোখে চুলকানি হওয়া,
৩) চোখে ঘোলা দেখা,
৪) দূরের জিনিস দেখতে সমস্যা হওয়া,
৫) এমনকি রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। (তবে এ বিষয়টি এখনও গবেষণাধীন রয়েছে।)
●স্মার্টফোনের আলো ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনের কাজেও ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, ফলে স্থুলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
●এদের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
●রাতে দীর্ঘক্ষণ আলোর সংস্পর্শে থাকা এবং পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার সঙ্গে স্তন ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের যোগসূত্র রয়েছে।

নীল আলোকরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচার উপায় কী?
●প্রয়োজন ছাড়া স্মার্টফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। রাতে ঘুমাতে যাবার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই নীল আলো নিঃসরণকারী সব গ্যাজেটের ব্যবহার বন্ধ করুন।
●স্মার্টফোন ব্যবহারের সময় আমরা স্বাভাবিকের তুলনায় কম সংখ্যক বার চোখের পলক ফেলি। এর ফলে চোখে চুলকানি ও শুষ্কতা অনুভূত হতে পারে। তাই স্মার্টফোনের ব্যবহারের সময় প্রতি ২০ মিনিট পরপর দশবার চোখের পলক ফেলুন। প্রতিবার চোখ বন্ধ করে এক সেকেন্ডের বেশি সময় ধরে বন্ধ রাখার পর চোখ খুলুন।
●স্মার্টফোন ব্যবহারের ফাঁকে ২০ মিনিট পরপর ২০ সেকেন্ডের জন্যে বিরতি নিন এসময় চোখের দৃষ্টি অন্তত ২০ফিট দূরে কোনকিছুর ওপর নিবদ্ধ করুন। এতে চোখের মাংসপেশীগুলো শিথিল হবে। আশেপাশে সবুজ গাছপালা থাকলে সেদিকে তাকিয়ে চোখকে বিশ্রাম দিতে পারেন। সবুজ রং চোখের জন্যে আরামদায়ক।
●অতিরিক্ত আলো বা একেবারে কম আলো- দু’টোই চোখের জন্যে ক্ষতিকর। তাই আশপাশের পরিবেশের আলো অনুযায়ী ফোনের brightness set করুন। রাতের গভীর অন্ধকারের মাঝে, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে স্মার্টফোন ব্যবহারের অভ্যাস ত্যাগ করুন।
●চোখ ও স্মার্টফোনের পর্দার মাঝে ১৬-১৮ ইঞ্চি দূরত্ব বজায় রাখুন। প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও নিয়মিত ব্যবহারে ধীরেধীরে এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন।
●খেয়াল রাখুন, ভুল font size, display colour নির্বাচনের কারণে চোখের ওপর অতিরিক্ত চাপ যেন না পড়ে। এগুলো এমনভাবে নির্বাচন করুন, যেন তা চোখের জন্যে সহনীয় ও আরামদায়ক হয়।
●আপনার স্মার্টফোনের পর্দার ওপর anti-glare glass protector বা matte screen protector ব্যবহার করুন।
●Blue light filter ব্যবহার করতে পারেন।
●চোখকে সুস্থ রাখতে ভাইটামিন এ, ভাইটামিন সি, ভাইটামিন ই, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, জিংক সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন।

প্রযুক্তি কখনো আমাদের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে আসে, আবার কখনো তা বয়ে আনে অভিশাপ। নির্ভর করছে আপনি কীভাবে এটিকে ব্যবহার করছেন, তার উপর। তাই আসুন প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহারের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্বন্ধে সচেতন হই এবং নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে এর সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করি।