যেকোনো কাজে ঢিলেমি ভাব দূর করবেন কিভাবে?

ঢিমেতেতালা শব্দটার সাথে কি আপনি পরিচিত ? জানেন আর নাই জানেন আমরা কিন্ত হরহামেশাই ঢিমেতেতালামি করে থাকি । যদিও সোজা বাংলায় আলসেমি বলা যায় তবুও ঢিমেতেতালামি বলার কারণ ইংরেজী Procrastination আর Laziness দুটো ভিন্ন বিষয় । তাহলে এবার চটপট ঢিমেতেতালার একটা সংজ্ঞা দেওয়া দরকার তাইনা?! সহজ ভাষায় বলতে গেলে কোন কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে দেরী করে করার অভ্যাসকেই বলে ঢিমেতেতালামি । সাধারণত যারা ঢিমেতেতালামি করে তারা কঠিন কাজ বাদ দিয়ে সহজ কাজকে প্রাধান্য দেয় ; যদিও কাজটা তাকে করতেই হবে তবুও সে কাজটাকে এড়িয়ে যায় । যতক্ষণ না একদম দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তার আগ পর্যন্ত সে এভাবেই চলে । এর ফলাফল হয় মারাত্মক । প্রচন্ড মানসিক চাপ, অস্থিরতা, আর্থিক, সামাজিক ও ব্যক্তি পর্যায়েও বিভিন্ন দুর্দশার কারণ হয় ঢিমেতেতালামি । কাজ করার উদ্দেশ্য আর কাজ সম্পাদন করা এই দুইয়ের মাঝের যায়গাটার নামই ঢিমেতেতালামি । কিন্ত, কি কারণে এমন হয় সেটা জানা আছে ? না থাকলে জেনে নিন ।গবেষণায় দেখা গিয়েছে আত্মবিশ্বাসের অভাব, পরাজিত মনোভাব পোষণ করা, নিজের আচরণের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারা ইত্যাদি ঢিমেতেতালামির কারণ । তবে, এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো, আবেগপ্রবণতা । আমাদের সকলেরই এমন বহুবার হয়েছে যে আজ নয় কাল করবো, আজ নয় কাল বলবো এই করতে গিয়ে কাজটি আর করা হয়নি । আমার ভাইয়ের কথাই ধরুন, ফাইনাল পরীক্ষার আগে একমাস ছুটি পেয়েই সে বিশাল উদ্যমে একটা মস্ত কাগজে সমস্ত হিসেব নিকেশ করে তা পড়ার ঘরে টাঙিয়ে দিলো । এটাকে নাকি রুটিন বলে, এবং সে ছুটির সময়ে এভাবেই চলবে । আমরা সবাই প্রচন্ড খুশী হলাম তার কর্মদ্দিপনা দেখে । কিন্ত ওই যে, ঢিমেতেতালামি তাকে পেয়ে বসলো সেই ভুত পরীক্ষার আগের রাতেই কেবল তাকে ছাড়লো । মধ্যখানের একমাস ছুটি কোথায়, কিভাবে হাপিশ হয়ে গেলো সেটার রহস্য আজ অব্দি উদ্ঘাটন করা না গেলেও ; বেশ বোঝা যাচ্ছে এসব ওই ঢিমেতেতালামিয়ের কারণেই হয়েছে । আজকের মত এখানেই শেষ করি , সংজ্ঞা আর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলামতো । কি বললেন ? এ থেকে মুক্তির উপায় বলতে হবে ? আজ নয় আরেকদিন বলবো । আহা! মহাশয় হাতটা ছাড়ুন । আচ্ছা , আচ্ছা ,ঠিকাছে বলছি মুক্তির উপায় । আপনিতো মশায় বড্ড নাছোড়বান্দা ।

ঢিমেতেতালামির ভুত থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উপায় হলো দৃশ্যপট আর দৃষ্টিভঙ্গি দুটোই বদলে ফেলতে হবে। কিভাবে? আহা বলছিতো অস্থির হচ্ছেন কেনো । আপনার রোজকার কাজের মধ্যে যেসব জিনিস পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় সেগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে । টেলিভিশনের সিরিয়ালের ভীষণ আসক্তি কিংবা ফেসবুক বুকে নিয়ে পরে থাকা বন্ধ করতে হবে । পয়েন্ট আকারে বলি বুঝতে সুবিধা হবে

১. নড়েচড়ে খান – হ্যাঁ অনেক আলসেমী হয়েছে এবার বিশাল করে হাত পা ছড়িয়ে একটা হাই তুলে কাজে লেগে যান । জিমে যেতেই হবে এমন কোন বাধ্য বাধকতা নেই তবে কান ধরে অথবা না ধরে উঠবস করলেও কিন্ত শরীরটা কেমন চন্মনে লাগে । ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম করুন ।

২. রিমাইন্ডার দিয়ে রাখুন – ছোট কাগজের টুকরায় লিখে ঘরের যেখানটায় সবার আগে চোখ যায় সেখানে লাগিয়ে রাখুন । আর না হলে মোবাইলে রিমাইন্ডার সেট করে নিন , স্মার্ট ফোন পকেটে নিয়ে ঘুরলেইতো শুধু হবেনা এর ব্যাবহারটাও স্মার্টভাবে করতে হবে । তবে হ্যাঁ মোবাইলে চার্জ দিতে আলসেমী করবেননা যেনো ।

৩. অন্যের সাহায্য নিন– যদি ঢিমেতেতালামি আপনার অনেক বেশী হয় তাহলে কাছের বন্ধু বা প্রিয়জনদের কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারেন । কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নেয়াও দরকার হতে পারে । অবশ্য সেটা আপনার আলসেমির মাত্রার উপর নির্ভরশীল

৪. নিজের ঢোলটা পেটান – হ্যাঁ , আমরা যারা আলসে, তাদের সবার ব্যাপারে কাছের লোকেরা ধারণা পোষণ করে যে এতো আলসে , একে দিয়ে হবেনা । তাই আপনার পরিবর্তনের কথা সবাইকে জানান । প্রাথমিক হাসি ঠাট্টার জবাব আপনার কাজ দিয়েই দিতে পারবেন; সুতরাং হতাশ হওয়ার জায়গা নেই ।

৫. “আমি হবো সকাল বেলার পাখি” – হ্যাঁ ভাই সক্কাল বেলায় ঘুম থেকে ওঠা এবং রাতে আগে ঘুমিয়ে পড়া আপনার কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে আপনাকে একজন সফল মানুষে পরিণত করতে পারে । সকাল বেলা ওঠার উপকারিতা লিখে শেষ করা যাবেনা আর অপকারিতা জানা নাই ।

৬. ধাপে ধাপে পরিস্কার করুন – আপনি হয়তো আপনার জীবন থেকে শুরু করে নিজের ঘরটা কতটা অগোছালো হয়ে আছে তাই নাই ভেবে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন । কিন্ত আপনি যদি এই বিশাল ঝামেলাটাকে ছোট ছোট কাজে ভাগ করে নেন তাহলে কিন্ত সহজেই স্বচ্ছ জীবন অভিযান শুরু করা যায় । পুরো ঘর হয়তো একদিনে গোছাতে অনেক সময় লাগবে তাহলে একদিন টেবিল, একদিন আলমারি এমন করে ধাপে ধাপে গুছিয়ে ফেলুন । মনে রাখবেন, “Something is better than nothing”

৭. এক্ষণই করুন – যা করার তা এখনি করুন । নইলে হয়তো আর কখনোই করা হবেনা । নিজেকে একবার জোর করে বলুন করতেই হবে । ব্যাস করে ফেলতে পারবেন ইনশা আল্লাহ ।

৮. সময় ও কাজের তালিকা তৈরি করুন – প্রত্যেকটা কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময় ভাগ করে নিন । কাজের সময়ে নিরধারনের ক্ষেত্রে ২৫ মিনিট কাজ আর ৫ মিনিট বিরতি এই পদ্ধতি ব্যাবহার করতে পারেন । এটাকে বলা হয় Pomodoro technique ।

৯. ধুমধাড়াকা গান শুনুন – জী হ্যাঁ আলসেমি দূর করার জন্য এটা বেশ কার্যকর পদ্ধতি । আপনার কাজের সাথে তাল মিলিয়ে এমন একটা প্লে লিস্ট বানিয়ে নিতে পারেন ।

১০. ভয়কে জয় করুন – অধিকাংশ সময় আমরা ভয়ের কারণে পিছিয়ে যাই । যদি না পারি সেই ভয়, লোকে কি বলবে সেই ভয়, “সংশয়ে সংকল্প সদা টলে, পাছে লোকে কিছু বলে ” । এই মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে । মনে রাখবেন “সঙ্কোচেরও বিহ্বলতা নিজেরই অপমান, সঙ্কটেরও কল্পনাতে হয়োনা ম্রিয়মাণ”

লক্ষ্য স্থির করে সেই দিকে এগিয়ে যান । নিজের অর্জনগুলো যত ছোটই হোক, নিজেকে বাহবা দিন ।লেগে থাকুন , জয় আসবেই ।

লেখকঃ তানভীর আহমেদ শুভ, কাউন্সেলিং  সাইকোলজিস্ট ও ফটোগ্রাফার।