ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। অঝোরধারায় নেমেছে বৃষ্টি। চারদিকের থৈথৈ বৃষ্টির পানিতে শহরের রাজপথে হাঁটু জল। বর্ষায় এই ধরনের চিত্র দেখতে আমরা অভ্যস্ত। তাই এই বার বর্ষার কিছুটা সময় একটু অন্যভাবে কাটাতেই পারেন। এই ভরা বর্ষাতেই আমাদের পাশের দেশ ভারতে একটা ছোট ট্যুর্ আপনি দিতেই পারেন। একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা যে আপনার হবে, তা হলফ করে বলা যায়। ভারতের এমন কয়েকটি স্পট আছে যেগুলি বর্ষায় ঘুরতে যাওয়ার জন্য একেবারে আদর্শ। তেমন কিছু স্থানের সুলুক সন্ধান রইল আপনাদেরই জন্য।
১। কোড়াইকানাল
তামিলনাড়ুর জনপ্রিয় শৈলশহর কোদাইকানাল। সমতলের প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতেই কোদাইকানাল শহরের গোড়াপত্তন করা হয় ১৮৪৫ সালে। পর্যটনই এখানকার প্রধান আয়ের পথ। সারা বছরই এখানে লেগে রয়েছে ক্যামেরা গলায় ট্যুরিস্টদের ভিড়। তামিলনাড়ুর এই ট্রাভেল স্পটকে ‘প্রিন্সেস অব হিল স্টেশন’-ও বলা হয়। বর্ষার সময় এই পাহাড়ি এলাকা হয়ে ওঠে আরও মোহময়ী। বর্ষায় এই বনানী পরিবেষ্টিত অঞ্চলের রূপ, বছরের অন্য সময়ের তুলনায় একেবারেই আলাদা। জুলাই-অগস্ট অঝোর ধারায় ভিজিয়ে রাখে কোদাইকানালকে। ভিজে মাটির গন্ধে ভরে যায় পর্যটকদের মন। সূর্য আর মেঘের লুকোচুরি খেলা চলে অলস ভঙ্গিমায়। পাহাড়ের আড়াল থেকে ভেসে আসা মেঘ দেখা যায় অনেক দূর থেকে। প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্ট কোদাই লেকের চারপাশে সাজানো বাগান- ফুলেরি মেলা। নীল আকাশ আর পালানি পাহাড়ের ছায়া পড়ে কোদাইলেকের বুকে। শহরে বেশকিছু পার্ক আছে। রয়েছে মানমন্দির, সোলার ফিজিক্যাল অবজারভেটরি।
২। লোনাভালা
মহারাষ্ট্রের পুনেতে অবস্থিত লোনাভালা হিল স্টেশনটির চারদিকের সবুজ পাহাড় ও সুন্দর হ্রদ পরিবেশকে মুগ্ধ করে তোলে। সামনে খোলা আকাশ, চারপাশে সবুজ গাছে ঘেরা পাহাড়। আর পাহাড়ের গা বেয়ে নীচের দিকে নেমে আসছে ঝর্না। যেন এক টুকরো সবুজ স্বর্গ। সঙ্গে মনোরম পরিবেশ। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে গিয়ে বর্ষায় সময় কাটানোর উপযুক্ত ঠিকানা।
৩। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ
আন্দামান ও নিকোবর এই দুটি দ্বীপপুঞ্জ ভারত মহাসাগরে অবস্থিত। প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ হল এক স্বর্গোদ্যান এবং এইভাবেই প্রতি বছর বিপূল সংখ্যক পর্যটকদের আকর্ষিত করে। এটি অবকাশ যাপনের জন্য এক আদর্শ স্থান। অসাধারণ ওয়াইল্ড লাইফ আর ওয়াটার স্পোর্টসের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বুক ভরে তাজা শ্বাস নিতে অবশ্যই বর্ষার সময় এই দ্বীপপুঞ্জে ঘুরে আসতে পারেন।
আন্দামান ও নিকোবরে পারিপার্শ্বিক দৃশ্য মানেই সুন্দর সুন্দর সমুদ্রসৈকত ও ম্যানগ্রোভ অরণ্যগুলিতে উত্তেজক আনন্দের উপলব্ধি। এই দ্বীপপুঞ্জ সেই সমস্ত ব্যাক্তিদের জন্য আদর্শ যারা প্রকৃতির সর্বাঙ্গীন নির্জনতাকে ভালোবাসেন। সমুদ্র তীরবর্তী চারপাশের অঞ্চলগুলি ঐশ্বরিক ছোঁয়ায় যেন সদা আবিষ্ট।
৪। গোয়া
গোয়া ভ্রমণ ভারতীয় পর্যটন সীমার একটি উচ্চ বিন্দু। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য, রূপালি সুবর্ণ সৈকত, সবুজ পাহাড়, মুখে জল আনা সুস্বাদু সামুদ্রিক খাদ্য এবং অন্যান্য দৃশ্যমান এবং অলীক সৌন্দর্যের আশীর্বাদপ্রাপ্ত একটি আকর্ষণীয় স্হান হল গোয়া। গোয়ার গীর্জা এবং চ্যাপেল, সূর্য- ধৌত সৈকত বা রঙিন বাজার, যেখানেই আপনি যাবেন পর্তুগিজদের প্রভাব অনুভব করবেন। বৃষ্টিতে গোয়ার সমুদ্র একেবারে অন্য রূপে ধরা দেয়। সারা বছরই গোয়ার সমুদ্র সৈকতে ভিড় জমান দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক। অপেক্ষাকৃত কম ভিড় থাকে বর্ষার সময়। এই সময়েই গোয়া ঘুরে নিতে পারেন।
৫। মুন্নার
মুন্নার কেরালার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় পর্যটনস্থলগুলির একটি। ‘হানিমুন ডেস্টিনেশন’ হিসেবে এই জায়গাটির যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। এই জায়গা যেন সত্যিই স্বর্গ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই হিল স্টেশনটি বর্ষার সময়ে আরও মোহময়ী হয়ে ওঠে। বর্ষায় ঘুরতে চাইলে মুন্নার একেবারে আদর্শ জায়গা । এখানকার নদী, চা বাগান, পাহাড়, ঢেউ খেলানো রাস্তা ও অবশ্যই আবহাওয়া পর্যটকদের কাছে বিশেষ উপভোগ্য। চারদিকের রোমান্টিক পরিবেশ ও চোখধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানেই পর্যটকেরা বারবার ছুটে আসেন এখানে।
৬। শিলং
“প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড” হিসাবে পরিচিত শিলং, উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। একটা সময় হাওয়া বদল করতে বহু বাঙালিই এই শহরে পাড়ি জমাতেন। শিলংয়ের খাসি কিংবা জয়ন্তী পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে বর্ষার অন্য রূপ দেখতে পারেন। শিলং শহরের বাইরে ও অভ্যন্তরে প্রচুর দর্শনীয় আকর্ষণ রয়েছে, যা প্রতিটি পর্বত প্রেমীদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। উমিয়াম লেক, এলিফ্যান্ট জলপ্রপাত, মওলীননোঙ্গ ভিলেজ, শিলং পার্ক বা শিলং ভিউপয়েন্ট, লেডি হাইদরি উদ্যান, গল্ফ লিঙ্ক, ওয়ার্ড’স লেক, লৈৎলাম গিরিখাত, লেডি হাইদরি উদ্যান এসবই শিলংয়ের প্রধান আকর্ষন। চাইলে আপনি ঘুরে আসতে পারেন শিলং-এর নিকটবর্তী আরো কিছু দর্শনীয় স্থান: মৌসিনরাম, চেরাপুঞ্জি ও দ্বাকি।
৭। কুর্গ
কর্ণাটকের দক্ষিন পশ্চিমে পশ্চিমঘাট পর্বতের একটি অপূর্ব সুন্দর হিল স্টেশন কুর্গ। দক্ষিণ ভারতের মনোমুগ্ধকারী ছোট্ট শহর এই কুর্গ। সবুজ উপত্যকা, ঘন জঙ্গল ও কুয়াশা আবৃত পাহাড়ের চুড়ো কুর্গের বৈশিষ্ট। কুর্গের কফি আর মশলা খুব বিখ্যাত। এখানকার কমলা বাগান, সতেজ কফির সুবাস এবং সবুজ শ্যামলিমার বেষ্টনীতে সুখকর মধুচন্দ্রিমা যাপনে উত্তম জায়গা এটি। সবুজে ঘেরা পাহাড়। ঘন জঙ্গল। সুদৃশ্য ঝর্নায় ঘেরা কুর্গ আপনার মন কাড়বেই। সঙ্গে উপরি পাওনা গরমাগরম তাজা কফি।
৮। উদয়পুর
ভারতের রাজস্থান রাজ্যে অবস্থিত উদয়পুর একটি জেলা শহর। ঝকঝকে রূপোলী সুবর্ণ বালির ভূমি, বর্ণময় রঙ্গিন কাঠামোর ভূমি, আবেগপূর্ণ গান, প্রাণবন্ত নৃত্য, প্রাচীন লোক ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ হস্তশিল্পসমৃদ্ধ –এসবই উদয়পুরের ঐতিহ্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সোনালি মরুভূমির সাথে সাথে ঐতিহাসিক দূর্গ এবং প্রাসাদ, শিল্প ও সংস্কৃতির জন্যও সুপরিচিত। জেলার প্রাসাদে ঘেরা উদয়পুরও বর্ষায় অন্যভাবে ধরা দেয় পর্যটকদের কাছে। ‘সিটি প্যালেস’, ‘মনসুন প্যালেস’ কিংবা ‘লেক প্যালেস’ ঘুরে আসতেই পারেন এই সময়ে।
৯। যোগ ফলস
বেঙ্গালুরু রাজধানী কর্নাটকের অন্যতম আকর্ষণ যোগ ফলস । বেঙ্গালুরুর এই জায়গাটিতে চারটি স্বচ্ছ জলের ঝর্না রয়েছে। চারটি জলধারা একত্র হয়ে এই বিশাল জল প্রপাতের সৃষ্টি। রাজা, রানী, রোভার এবং রকেট এই চারটি জলধারা সহযোগে যোগের প্রাকৃতিক দৃশ্য অর্পূব। গাঢ় সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে তীব্র বেগে নেমে আসছে যোগ প্রপাতের চারটি জলধারা। বর্ষার সময় যোগ আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে এক অনাবিল সৌন্দর্য ধারণ করে। জল প্রপাতের আশে পাশে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের পাখিদের। বৃষ্টির দিন এমন অপরূপ পরিবেশ আপনাকে অন্য আমেজ এনে দেবে।
১০। নৈনিতাল
ভারতের উত্তরাখণ্ড অঙ্গরাজ্যের একটি শহর হল নৈনিতাল। নৈনি লেকের নামানুসারে এই জায়গার নাম হয়েছে নৈনিতাল। বর্ষাকালে ঘুরতে যাওয়ার জন্য একেবারে উপযুক্ত জায়গা। নৈনি লেক আর জঙ্গলের রাস্তা আপনার স্মৃতির পাতায় থাকবে বহুদিন। এখানকার পর্বতগুলির চূড়া থেকে দৃশ্যমান ভূ-দৃশ্যাবলি অসাধারণ। দক্ষিণে রয়েছে বিস্তীর্ণ সবুজ সমভূমি আর উত্তরে তাকালে দেখা যাবে বরফাবৃত হিমালয়ের কেন্দ্রীয় পর্বত নন্দা দেবী, ত্রিশূল এবং নন্দা কোট । নৈনিতালের রাজভবনটি দর্শক ও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। এছাড়া আপনি যেতে পারেন জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক, নৈনিতাল চিড়িয়াখানা, ব্রিটিশ আমলে তৈরি সেন্ট জনস চার্চ, মুক্তেশ্বর হিল স্টেশন যেখান থেকে কুমায়ুন হিমালয়ের অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য দেখা যায়।
১১। রানিক্ষেত
উত্তরখন্ডের এই টুরিস্ট স্পটটি একেবারে পিকচার পারফেক্ট। রানিক্ষেতের অসাধারণ সৌন্দর্য্যে আপনি অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। পাইন গাছে মোড়া অপূর্ব এই রানিক্ষেত, গরমকালে গেলে দেখবেন লাল রোডোডেনড্রনের পাপড়ি যেন কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে আপনার জন্যে। বিনসর, এখান থেকে হিমালয়ের কিছু শিখর যেমন ত্রিশূল, নন্দাদেবী, ঘুন্টি পরিষ্কার দেখতে পাবেন, তবে অবশ্যই মেঘ না থাকলে।
১২। উটি
নীলগিরি পাহাড়ের বুকে শৈলশহর সবুজে ছাওয়া উটি। উটি মানে সবুজের ছোঁয়া, ঢেউ খেলানো পার্বত্য ঢাল। একদিকে রেলষ্টেশন এবং অপরদিকে চ্যারিং ক্রস-এই নিয়ে জমজমাট উটি। নীল আকাশের নীচে পাহাড়ের গায়ে সবুজ চা বাগিচার চাদর টোডা উপজাতির বাসভূমি উটিকে মোহময়ী করে তুলেছে। সারাবছরই এখানে ঠান্ডার আমেজ থাকে। গাছ-গাছালিতে ঘেরা এলাকার মধ্যে ছোট ছোট কটেজ আর সবুজ গালিচায় মোড়া উটি গরমের সময় বেড়াতে যাওয়ার সেরা ঠিকানা।
উটির দর্শণীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে চার্চ, রোজ গার্ডেন, বোটানিকাল গার্ডেন, মিউজিয়াম, ডোডাবেট্টা পিক, কেট্টি উপত্যকা আর শহরের মাঝে টলটলে জলের হ্রদ। উটির অন্যতম আরেকটি আকর্ষণ টয়ট্রেনে ভ্রমণ। এই বর্ষায় ঘুরে আসতে পারেন প্রকৃতির আরেক আকর্ষণ উটি।
লেখিকা সম্পর্কেঃ পাপিয়া দেবী অশ্রু। শখ -বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ানো, গান করা, ছবি আঁকা। লেখা – লিখিতে বেশ আগ্রহ থাকলেও তেমন ঘটা করে হয়ে উঠেনি কখনও। শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত আছি। ইচ্ছে আছে একেবারেই নতুন কিছু করার, যা বিশ্বজুড়ে সবার দেখার মতই। অদ্ভুত ইচ্ছে!!!