পাঁচটি অনুগল্প এবং কিছু জীবন বদলে দেয়া অনুসিদ্ধান্ত…

গল্প-১:

রবার্ট ফুলটন (১৭৬৫-১৮১৫ ইং) সর্বপ্রথম স্টীমবোট তৈরি করেছিলেন। এর আগ পর্যন্ত পাল তোলা নৌকার প্রচলন ছিল। ১৮০৭ সালে যখন প্রথমবারের মত ফুলটন তার তৈরি বাষ্পীয় নৌকা হাডসন নদীতে ভাসান, তখন তার একদল নিন্দুক তীরে জড়ো হয়ে বলাবলি করছিল এই নৌকা কখনো চলবে না। কিন্তু ফুলটনের নিজের ব্যাপারে আস্থা ছিল প্রবল। তিনি ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন এবং দেখা গেল নৌকা তীর ভেঙ্গে আগাতে শুরু করেছে। তখন সেই নিন্দুকের চিৎকার করে বলতে থাকল- এই নৌকা কখনো থামবে না!

অনুসিদ্ধান্তঃ লোকের কথায় কান দিয়ে নিজের সময় নষ্ট করার কোন মানে হয়না। নিজের উপর আত্মবিশ্বাস করে কাজ করে গেলে এক সময় সফলতা ধরা দেবেই। মনে রাখবেন, শকুনের দোয়ায় কখনো গরু মরে না!

 

গল্প-২:

বানর শিকারীরা বানর ধরার জন্য অদ্ভুত এক কৌশল ব্যবহার করে। তার গোল ছিদ্রযুক্ত ভারী একটা বাক্স নেয়। বাইরে থেকে দেখা যায় এমন ভাবে বাক্সের ভেতরে কিছু বাদাম রেখে দেয়। তারপর বাক্সটি বানরদের চরণভূমির আশেপাশে কোথাও রেখে দেয়। বাক্সের গায়ে ছিদ্রটা এমন যে ভেতরে একটা বানর সহজেই হাত ঢোকাতে পারে। কিন্তু একবার হাত ঢুকিয়ে ভেতরের বাদামগুলো নেয়ার পর হাতের মুষ্ঠি বড় হয়ে যায়, তখন সে হাত আর ছিদ্র দিয়ে বের হয় না। বানর অবশ্য চাইলেই হাতে থাকা বাদাম গুলো ফেলে দিয়ে অনায়াসেই হাতটা বের করে নিতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বানর সামান্য কয়টা বাদামের মায়া ছাড়তে পারে না, ফলে বাক্সে আটকা পড়ে শিকারীর হাতে ধরা পড়ে।

অনুসিদ্ধান্তঃ আমরা মানুষেরাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বানরের মত আচরণ করি। তুচ্ছ কিছু জিনিস আঁকড়ে ধরে রাখি বলেই জীবনে এগিয়ে যেতে পারিনা। মায়া কাটানো শিখতে হবে, তবেই সফলতা সহজে ধরা দেবে।

 

গল্প-৩:

১৯৪০ সালের ২৩শে জুন আমেরিকার টেনেসী প্রদেশের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে উইলমা রুডলফ নামের এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ছিলেন বাবা-মায়ের ২০ তম সন্তান। চার বছর বয়সে পোলিও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্যারালাইজড হয়ে যান। পরে সেরে উঠলেও পা দুটো বেঁকে যায় তার, এজন্য ৯ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে অর্থোপেডিক জুতা পরে থাকতে হয়। ডাক্তাররা বলেছিল জীবনে কখনো স্বাভাবিক ভাবে আর হাঁটতে পারবেন না তিনি। কিন্তু তার মা সে কথা বিশ্বাস করেনি। তিনি রুডলফকে বলেন, সে যদি চায় তবে শুধু হাঁটতে নয়, দৌঁড়াতেও পারবে। শুধু চেষ্টা করে যেতে হবে। মায়ের কাছেই হার না মানার মন্ত্রে দীক্ষিত হন রুডলফ। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শেখেন, এরপর দৌড়াতে। ১৩ বছর বয়সে জীবনে প্রথম বারের মত দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন, পৌঁছেন সবার শেষে। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় তার। যার হাঁটার কথাও ছিল না, সে এখন দৌঁড়াতে পারছে! পরিশ্রম আরো বাড়িয়ে দেন তিনি। সময় গড়িয়ে যায়, ২০ বছর বয়সে আমেরিকার হয়ে অলিম্পিকে দৌড়াবার জন্য নির্বাচিত হন তিনি। ট্র্যাকে নামার আগেই ইতিহাস গড়েন তিনি, কিন্তু আসল বিষ্ময় তখনো বাকি ছিল। একে একে ব্যক্তিগত ১০০ ও ২০০ মি ইভেন্টে সোনা জিতে নেন তিনি। তৃতীয় প্রতিযোগিতা ছিল রিলে দৌড়। ৪ জন মিলে কম্বাইন্ডলি বাটন নিয়ে ৪০০ মিটার দৌড়ে যেতে হবে। রুডলফ দৌড়াবেন সবার শেষে। তৃতীয় জনের কাছ থেকে বাটন নেয়ায় সময় হাত ফসকে সেটা মাটিতে পড়ে যায়। পুরো গ্যালারি স্তব্দ হয়ে যায়, এই বুঝি সব শেষ! কিন্তু ঐ এক মূহুর্তই, সাথে সাথে মাটি থেকে ব্যাটন কুড়িয়ে নিয়ে রুডলফ দৌড় শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত ৪০০ মিটারেও সোনা যেতেন। ১৯৬০ সালের অলিম্পিক নতুন এক ইতিহাসের সাক্ষী হয়, পোলিও আক্রান্ত এক মেয়ে পৃথিবীর দ্রুততম মানবীর স্বীকৃতি পায়।

অনুসিদ্ধান্তঃ চেষ্টার কোন বিকল্প নেই। চেষ্টাই পারে অসাধ্যকে সাধন করতে।

 

গল্প-৪:

জীবনের প্রথম ভাগে ওয়াল্ট ডিজনী (১৯০১-১৯৬৬) একজন প্যারোডি কার্টুনিস্ট ছিলেন। প্রথম দিকে কাজ পেতে তাকে খুব বেগ পেতে হত। কার্টুন নিয়ে পত্রিকা অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতেন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাকে প্রত্যাখ্যাত হতে হত। এমন অনেক বার তিনি শুনেছিলেন যে তার সব আইডিয়া বস্তাপঁচা, তার সত্যিকারের কোন প্রতিভা নেই! একদিন গীর্জার এক পাদ্রী তাকে খাবারের বিনিময়ে কিছু ব্যঙ্গচিত্র আঁকার ফরমায়েশ দেন। ডিজনী তখন গীর্জার অদূরে একটা ছোট চালা ঘরে থাকতেন, তার ঘর ছিল ইঁদুরের স্বর্গরাজ্য। সেই ইঁদুরদের মধ্য থেকে ছোট্ট একটা ইঁদুরকে তার খুব ভাল লেগে যায়। এই ইঁদুরটিকে নিয়েই তিনি আঁকা শুরু করেন। আর এভাবেই তার সবচেয়ে জনপ্রিয় আর সফল চরিত্র ‘মিকি মাউস’-এর জন্ম হয়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানী’, অ্যানিমেটেড মুভির জন্য যেটা বর্তমানে পৃথিবীর সেরা। ভাবা যায়, এক সময় ‘প্রতিভাহীন’ গালি শোনা তরুণ ডিজনী জীবন সায়াহ্নে এসে ২৬টি অস্কার (২২টি প্রতিযোগিতামূলক, ৪টি সম্মানসূচক, নমিনেশন ৫৯ বার) জেতেন! যেটা এখনো পর্যন্ত রেকর্ড এবং এটি এমন একটা রেকর্ড যেটা আদৌ কখনো ভাঙ্গার কোন সম্ভাবনা নেই।

অনুসিদ্ধান্তঃ সুযোগ জীবনে বারবার আসেনা। একবার দুয়ারে কড়া নাড়া সুযোগ হেলায় হারালে সেটা দ্বিতীয়বার আর কখনো নাও আসতে পারে। তাই প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার করা খুব জরুরী।

 

গল্প-৫:

একবার এক লোক প্রচন্ড রেগে গিয়ে তার প্রতিবেশীকে অনেক গালাগাল করলো। পরে সে তার ভুল বুঝতে পারলো, বুঝতে পারলো যে তার প্রতিবেশীর কোন দোষ ছিল না। সে খুব অনুতপ্ত হল। বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে সে গীর্জার পাদ্রীর কাছে গেল পরামর্শ চাইতে। সব শুনে পাদ্রী তাকে এক বস্তা তুলা জোগাড় করার পরামর্শ দিলেন। লোকটি অবাক হলেও পাদ্রীর কথামত তুলার বস্তা নিয়ে হাজির হল। পাদ্রী এবার তাকে শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত রাস্তায় তুলাগুলো ছড়িয়ে দিতে বলল। এবারও লোকটি পাদ্রীর পরামর্শ মেনে নিল। তুলা ছড়িয়ে দিয়ে লোকটি ফের পাদ্রির কাছে ফেরত এল। এবার পাদ্রী বললেন- যাও, ছড়িয়ে দেয়া তুলাগুলো আবার কুড়িয়ে নিয়ে এসো। লোকটি চোখ কপালে তুলে বলল- সেটি এখন আর কিভাবে সম্ভব? বাতাস তো সব তুলো উড়িয়ে নিয়ে গেছে। এবার পাদ্রী বললেন- হুম, মুখের কথাও তাই। একবার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলে ফেরানোর আর কোন উপায় থাকে না। তাই সামনের বার থেকে কিছু বলার আগে ভালো করে ভেবে নেবে।

অনুসিদ্ধান্তঃ মুখের কথা খুব গুরত্বপূর্ণ একটা বিষয়। কথার উপর অনেক সময় অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই কিছু বলার আগে সেটার পরিণামটা একবার ভেবে নেয়া উচিত।