কাকতালঃ দ্বিতীয় পর্ব

কাকতাল সিরিজের প্রথম পর্বের লেখায় বেশ কিছু বিশ্ব বিখ্যাত (কিংবা বলতে পারেন কুখ্যাত) কাকতালীয় ঘটনার কথা আপনাদের জানিয়েছিলাম। আজ হাজির হলাম তিন পর্বের সিরিজটির দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে। আশা করছি, প্রথম পর্বটির মত এই পর্বটিও আপনাদের ভালো লাগবে।

ব্রায়ান লারার রেকর্ড ও ইংল্যান্ড

ব্রায়ান লারার নাম শুনেছেন? প্রশ্ন দেখে হয়ত ভাবছেন, ‘হালায় পাগল নাকি!’ জানি প্রশ্নটা বোকার মত হয়ে গেছে! ক্রিকেটের এই কিংবদন্তীর নাম শুনেন নি, পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! লারার অনেক গুলো রেকর্ডের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ২০০৪ সালের ১২ এপ্রিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে করা অপরাজিত ৪০০ রানের ইনিংসটি। রেকর্ডটি এখনো অক্ষুণ্ন আছে এবং অদূর ভবিষ্যতে কেউ ভেঙ্গে দেবে সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ার ম্যাথু হেইডেনের করা ৩৮০ রানের রেকর্ড ভেঙ্গে লারা টেস্টে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের রেকর্ডটি নিজের করে নেন। বিখ্যাত এই ইনিংসকে ঘিরে বেশ কিছু কাকতালীয় ব্যাপার-স্যাপার আছে! হেইডেনের ৩৮০ রানের রেকর্ডের আগে টেস্টে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি ছিল লারার দখলে। ১৯৯৪ সালে করা ৩৭৫ রানের ইনিংসটি প্রায় এক দশক ধরে সর্বোচ্চ রানের খেতাব ধরে রাখলেও মাঝখানে কিছুদিনের জন্য হেইডেন এসে পড়েন, পরে হেইডেন থেকে আবার রেকর্ড নিজের করে নেন লারা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, লারার ৪০০* ও ৩৭৫ রানের রেকর্ডের দুইটি ইনিংসই এপ্রিল মাসে করা। দুইটিই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে করেছিলেন। ম্যাচ দুটিতেই প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড! দুইটি ম্যাচেই লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যায়! এবং দল হারার পরেও ম্যাচ দুটিতেই ম্যাচ সেরা হন লারা। কাকতালীয়ই তো, কি বলেন?

blank

অপরাজিত ৪০০ রানের পর লারা

মিস আনসিঙ্কেবল

ভায়োলেট জোসেপ তার নাম। জন্ম ১৮৮৭ সালে, আর্জেন্টিনায় আর মৃত্যু ১৯৭১ সালে, ইংল্যান্ডে। এই মহিলাকে আপনি বলতে পারেন বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যবান মহিলা কিংবা সবচেয়ে দূর্ভাগা মহিলা! অবাক হতে পারেন, একজন একই সাথে কিভাবে সবচেয়ে ভাগ্যবান এবং দূর্ভাগা হয়! চলুন দেখা যাক কিভাবে হয়।
পেশায় নার্স জোসেপ RMS Olympic-এ কাজ করতেন (RMS Olympic বিখ্যাত RMS Titanic এর বড় বোন হিসেবেই বেশি পরিচিত! একই কোম্পানী জাহাজ দুইটি তৈরি করেছিল)। ১৯১১ সালে সেপ্টেম্বরে RMS Olympic এর সাথে র‌্যয়াল নেভীর জাহাজ HMS Hawke– এর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। জোসেপ তখন অলিম্পিকেই ছিলেন এবং পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান। তবে এই ঘটনার পর জোসেপ অলিম্পিক ছেড়ে RMS Titanic-এ যোগ দেন। ১৯১২ সালে পানিতে ভাসানোর মাত্র ৫ দিনের মাথায় টাইটানিক যখন উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে আইসবার্গের সাথে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়, সেদিনও জোসেপ অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান। এরপরে ১৯১৬ সালে তিনি চড়েন তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় জাহাজ HMHS Britannic-এ। গেস হোয়াট! প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সাবমেরিনের সেট করা এক সি মাইনের আঘাতে HMHS Britannic ডোবার সময়ও তিনি অলৌকিক ভাবে বেঁচে যান! তার নাম মিস আনসিঙ্কেবল কি আর এমনি এমনি হল!

blank

বিখ্যাত টাইটানিক এবং ভায়োলেট জোসেপ

ঈশ্বরের খেল

জেরমি আরভিং রোডালে ছিলেন একাধারে একজন মার্কিন লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক এবং অর্গানিক মুভমেন্টের উদ্যোক্তাদের অন্যতম একজন। Rodale Inc. এর এই প্রতিষ্ঠাতা মূলত খ্যাতি লাভ করেন তার বিখ্যাত Organic Farming and Gardening ম্যাগাজিনের জন্য।  The Dick Cavett Show নামে তখন আমেরিকায় খুব জনপ্রিয় একটা টক শো-র অনুষ্ঠান হত। এই অনুষ্ঠানের একটা পর্বে জেরমি সাহেব অর্গানিক ফুডসের গুরত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেন- ‘আমার বয়স এখন ৭২ বছর। কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি আমি কমপক্ষে ১০০ বছর বাঁচবো! কারণ আমি রোজ আর্গনিক ফুড গ্রহণ করি’। দূর্ভাগ্যক্রমে ঐ শো চলাকালীন সময়েই তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান! ডিক ক্যাবেট শো-র সেই পর্বটি পরে আর কখনো টিভিতে প্রচার করা হয়নি। ঈশ্বরের খেল বোঝা বড় দায়!

ট্র্যাম্প ও সিম্পসনের ভবিষ্যতবাণী

The Simpsons হচ্ছে আমেরিকায় সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা (এখনো চলছে, এই বছর ৩০তম সিজন এয়ার হলো) অ্যানিমেটেড কমেডি কার্টুন। ডার্ক কমেডি আর নানা ভবিষ্যত বাণীর জন্য সিম্পসন এমনিতেই বিখ্যাত ছিল। তবে বোধ করি, সিম্পসনের সবচেয়ে বিখ্যাত অনুমান ছিল ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া নিয়ে! যারা বর্হিরাজ্যের খোঁজ খবর রাখেন, বছর পাঁচেক আগেও ট্র্যাম্পকে কেউ চিনতেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু সিম্পসন সেই ২০০০ সালেই প্রেডিক্ট করেছিল যে একদিন ডোনাল্ড ট্র্যাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে এবং শেষ পর্যন্ত হলোও তাই! আসলেই কি সব নিছকই প্রেডিক্টশান? নাকি এর পেছনে আরো কোন ‘কিন্তু’ আছে!

blank

সিম্পসনের প্রেডিক্টশনে ট্র্যাম্প

জমজ

জিম লুইস এবং জিম স্প্রিঙ্গার দুই জমজ ভাই। কিন্তু তাদের বেড়ে উঠা আর বাকি দশটা জমজের মত না। জন্মের পরপরই পরিবার তাদের নিতে অস্বীকার করায় তারা আলাদা হয়ে যান। দুই ভিন্ন শহরের ভিন্ন দুইটি পরিবার আলাদা আলাদা ভাবে তাদের দত্তক নেন। পরিবার দুইটির কেউই জানত না যে তারা জমজ। দুই পরিবারই তাদের দত্তক নেয়া সন্তানের নাম রাখেন জিম! দুই ভাই-ই তাদের নিজেদের মত করে বড় হয়েছেন, কিন্তু তাদের জীবনের মিল দেখলে মাথা খারাপ করা অবস্থা হয়! দুই ভাই-ই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ট্রেনিং নেন, দুই জনেই মেকানিক্যাল ড্রয়িং এবং কাঠের কাজে দক্ষ, দুই ভাইয়েরই প্রথম স্ত্রীর নাম লিন্ডা! দুজনই তাদের প্রথম সন্তানের নাম রাখেন জেমস এলান, দুজনেরই প্রথম বিয়ে ডিভোর্সে গড়ায়, দুজনই দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং দুজনেরই দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম বেটি! এমনকি দুই ভাইয়েরই পোষা কুকুরের নাম টয়! এত্ত মিল, কিভাবে সম্ভব? হাসপাতালে আলাদা হবার ৩৯ বছর পর ১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী দুই জিম পরিবারের যখন পুনর্মিলনী হয়েছিল, তাদেরও নিশ্চয় চোখ কপালে উঠেছিল এত মিল দেখে!

blank

জিম লুইস এবং জিম স্প্রিঙ্গার 

টাইটানিকের ডুবে যাওয়া

বিখ্যাত RMS Titanic পানিতে ভাসানোরও ১৪ বছর আগে, ১৮৯৮ সালে এক মার্কিন ফ্যান্টাসি লেখক, নাম মরগান রবার্টসনFutility, or The Wreck of the Titan’ নামে একটি ফ্যান্টাসি উপন্যাস লিখেন। টাইটান নামের একটি জাহাজের ডুবে যাওয়া এই এই উপন্যাস। তার বইতে মরগান টাইটানকে নিয়ে লিখেছিলেন, মানব ইতিহাসে তৈরি শ্রেষ্ঠ শিল্প, যেটি কখনোই ডুববে না। আরো লিখেছিলেন সেই কখনো না ডোবা জাহাজটি কিভাবে কোন এক এপ্রিলে উত্তর আটলান্টিকে ভাসমান বরফ খন্ডের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়! কি? পরিচিত ঠেকছে? ঠেকারই কথা। বাস্তবের টাইটানিকেও একই ঘটনাই ঘটেছিল। পার্থক্য শুধু এটুকুই, ডোবার সময় গল্পের টাইটানের গতিবেগ ছিল ২৫ নট, আর বাস্তবের টাইটানিকের ২২.৫ নট! হোয়াট এ লাকি গেস! মিল আছে আরো অনেক কিছুই। যদিও টাইটানিকের ডিজাইনেরও আরো অনেক আগে মরগান বইটি লিখেছিলেন, তবুও দুইটি জাহাজের আকার, গড়ন, ধারণক্ষমতা, লাইফবোর্ডের সংখ্যা, ভেতরের চাকচিক্য, মানুষের আগ্রহসহ নানা বিষয়ে মিল পাওয়া যায়। কিভাবে সম্ভব এটা!?

blank

লেখক মরগান, টাইটানিক এবং বই টাইটানের প্রথম সংষ্করণের দূর্লভ কপি

কাকতাল- পর্ব ১ ঃ লিংক

 

To Be Continued...