নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জার্মানি থেকে জাপানে রহস্যজনক সাবমেরিন ভ্রমণ

“স্বাধীন ভারত আমরা দেখে যেতে পারবো কি না, এটা কোন ব্যাপার নয়। ভারত স্বাধীন হবে ও ভারতকে স্বাধীন করতে আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে দেব, এটাই যথেষ্ট।”- সুভাষ চন্দ্র বসু

১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারি কটক নগরীর এক অ্যাডভোকেট, জনকিনাথ বসু ও তার সহধর্মিণী, প্রভাতী দেবীর ঘর আলো করে এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। কে জানত যে সেই ছোট্ট শিশুই একদিন স্বাধীন ভারতের মহান নেতা এবং সর্বাধিক সম্মানিত স্বাধীনতা যোদ্ধাদের একজন হয়ে উঠবে। “তোমরা​​ আমাকে রক্ত দাও এবং আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব,” বলে একদিন বিশাল এক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে বসবে, একটি জাতিকে সাম্রাজ্যবাদের বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। এই ছেলেটি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছাড়া অন্য কেউ ছিলেন না। একজন সাহসী যোদ্ধা যিনি তাঁর সমগ্র জীবনকে নিজের দেশেরজন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন, যাতে তাঁর দেশবাসী স্বাধীন বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারে, স্বাধীনতা ও মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারে।

গত জানুয়ারিতে ছিল তার ১২০তম জন্মবার্ষিকী। এই আর্টিকেলে আমরা জানব, নেতাজীর মহাকাব্যিক সাবমেরিন ভ্রমণের চটুল গল্প ও তার মাতৃভূমির প্রতি তার অবিশ্বস্ত আনুগত্যের অনন্য এক কাহিনী।

বলছি ১৯৪১ সালের কথা। দিনটি ছিল জানুয়ারী মাসের ১৬ তারিখ। গভীর রাতে একজন মানুষ খুবই শান্তভাবে হৃদয়ের কোনে এক ফোটা স্বপ্ন ও মাথায় একটি মাস্টার প্ল্যান নিয়ে তার Audi Wanderer W24 তে চেপে বসলেন ও ৩৮/২, এলগিন রোড থেকে যাত্রা শুরু করলেন। পরনে একটি দীর্ঘ বাদামী কোট, বিস্তৃত পাজামা এবং মাথায় একটি কালো ফেজ টুপি পড়ে ঠিক এভাবেই সুভাষ চন্দ্র বসু ব্রিটিশ পুলিশের নাকের নিচে থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। উল্লেখ্য থাকে যে, তখন তাকে কঠোর পরিদর্শনে গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছিল।

ব্রিটিশরা তাকে দেশব্যাপী পাগলের মত খুজতে শুরু করে। বসু এদিকে খুবই শান্তভাবে গোম থেকে পেশোয়ারগামী একটি ট্রেনে চেপে বসেন। সেখানে থেকে তিনি জার্মানিতে চলে যান। তাঁর ভাতিজা শিশির বোসের সাহায্যে ছদ্মবেশে ভ্রমণ করেন। ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে, ভারত তথা সমগ্র বিশ্ব যখন জার্মানির গোয়েবলের রেডিও ঘোষণায় যখন হতাশ, ঠিক তখনই ভারতবর্ষের সর্বাধিক জনপ্রিয় নেতা বার্লিনে এসেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের হাত থেকে ভারতকে মুক্তি দেওয়ার জন্য হিটলারের সাহায্য চাইতে।

চিত্রঃ জার্মানীতে বসু

বসু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে শুধুমাত্র একটি সশস্ত্র বিদ্রোহই ভারতকে ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করতে পারে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠিক সময়ে একটি যথাযথ মুহূর্ত প্রদান করলো। যুক্তরাজ্য তখন জাপান, জার্মানি এবং ইতালির সম্মিলিত আক্রমনের মধ্যে ছিল। তাঁর বিশ্বাস ছিল এমন, “আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত, কি হারালাম সেটা ব্যাপার নয়।” তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে চূর্ণ করার জন্য ভিন্ন জাতির কাছ থেকে বহিরাগত সাহায্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল।

জার্মানিতে নেতাজীর দুটি উদ্দেশ্য ছিল: প্রথমত, ভারতবর্ষে একটি ভারতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা এবং দ্বিতীয়টি, আজাদ হিন্দ ফৌজ, বা “Legion Freies Indien” গড়ে তুলতে, পঞ্চাশ হাজার ভারতীয় সৈন্যের একটি বাহিনী তৈরী। নেতাজী চেয়েছিলেন যে তারা যেন জার্মান সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ মানদণ্ডে প্রশিক্ষণ লাভ করতে পারে, যাতে তারা একটি অভিজাত ফৌজ গঠন করতে পারে। এতে করে যেন আফগানিস্তান থেকে একটি যৌথ জার্মান-রাশিয়ান-ইটালিয়ান-ভারতীয় সেনাবাহিনীর দল মুক্তিযুদ্ধের সম্পুর্ন ভারতে প্রবেশ করতে পারে।

তবে, বার্লিনে বোসের দুই বছরের অবস্থানকাল বেশ হতাশাজনক ছিল। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাডল্ফ হিটলার জার্মানিতে পৌঁছানোর পর পুরো এক বছর তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেননি। যখন তিনি করেছিলেন, তখন হিটলার তাকে ভারত স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে কোনও আশ্বাস দেন নি। নাজি নেতা তার বই ‘মেইন ক্যাম্প‘-এ লিখেছিলেন যে তিনি একজন জার্মান হিসাবে, অন্যদেশের চেয়ে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতকে দেখতে চেয়েছিলেন।

blank
চিত্রঃ নেতাজী ও হিটলারের সাক্ষাৎ

অবশেষে, হতাশ হয়ে বসু ১৯৪২ সালের শেষের দিকে জার্মানি ছেড়ে জাপান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন, জাপানী সেনারা বার্মা (এখন মিয়ানমার) জয় করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশের ক্ষমতায় ফোড়ন কাটতে তারা POW ক্যাম্পগুলোয় প্রায় দশ হাজার ভারতীয় জওয়ানকে বন্দী করেছিল। সেই জওয়ানরা ছিলেন একেকজন সেনা, যা বসু খুঁজছিলেন। বোসের জাপান যাত্রার কারণ ছিল সেটাই।

এই সময়, তার বাহন বলতে কোন মোটর গাড়ী, বিমান বা কোন ট্রেন ছিল না। বরং এটি  ছিল একটি Unterseeboot 180 (বা U-180) সাবমেরিন। জার্মানি উত্তর কোনায় ল্যাবি শহরের নগরীর মাথায়  বাল্টিক খাঁড়ির মুখে বরফ-জলের নিচ দিয়ে ছিল তার যাত্রাপথ। U-180 ছিল একটি লং-রেঞ্জ সাবমেরিন। এটার সামনের দিকের টর্পেডো টিউব অতিরিক্ত কার্গো রাখার জন্য সরানো হয়েছিল। জাপানের সামরিক বাহিনীর জন্য জেট ইঞ্জিন এবং অন্যান্য টেকনিক্যাল উপাদানগুলির ব্লুপ্রিন্টগুলি এবং টোকিওতে অবস্থিত জার্মান দূতাবাসের জন্য কূটনৈতিক বার্তা প্রদান করাই ছিল এর মুল লক্ষ্য।

blank
চিত্রঃ নেতাজী ও জাপানি সাবমেরিনের ক্রু

১৯৪৩ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি, সাবমেরিনের চূড়ান্ত মালবাহী কার্গোটি একটি মোটরবোটে করে সৈকতে পৌছে। সাথে দুইজন ভারতীয় যাত্রী, সুভাষ চন্দ্র বসু এবং আবিদ হাসান সাফরানি (বসুর নিকটতম সহযোগী ও জয় হিন্দ শ্লোগানের আবিষ্কর্তা)। ইউ-বোট ক্রুকে জানানো হয়েছিল যে তাদের যাত্রীরা ইঞ্জিনিয়ার ও নরওয়ের দিকে যাবে। ফলস্বরূপ, বসু এবং সাফরানি যতদিন পর্যন্ত জার্মানির জলসীমায় ছিলেন ততদিন সূর্যের আলোর দেখা পেতেন। পরে নরওয়েজিয়ান উপকূল বরাবর এটিকে উত্তোলন করে ও তারপর এটি পশ্চিমাঞ্চলে মুখ ঘুরিয়ে ফরেও দ্বীপপুঞ্জের দিকে  কোর্স সেট করে।

সমুদ্র বেশ উত্তাল ছিল এবং সাথে দুই ভারতীয় যাত্রীও সমুদ্রজনিত অসুস্থতায় (seasick) ভুগতে শুরু করেন। তবে, সমুদ্রের নিচে এই বন্দীদশা সত্বেও এটি বসুর জন্য ছিল একটি উল্লাসকর মুহুর্ত।। তিনি এখানে বসেও দিল্লীর মুক্তির স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে কাজ করেন। যখন তাঁর সহযোগী ক্রুদের নিয়ে মজা করছিলেন, বসু তখন বেশিরভাগ সময় জাপানীদের সাথে রাজনৈতিক যোগাযোগ করার ব্যাপারে পড়াশুনা করেছিলেন।

The Men from Imphal” বইয়ে তাঁর স্মৃতিকথায়, সাফরানি লিখেছেন,

“আমি যত মানুষ চিনতাম, তিনি তাদের চেয়ে বেশি কাজ করতেন। তিনি রাতে দুটোর আগে খুব কম সময়ই ঘুমাতে যেতেন এবং আমার মনে পড়ে না, শেষ কবে তাকে সুর্যদয়ের সময় বিছানাতে দেখেছি। পূর্ব এশিয়ায় সংগ্রামের জন্য তিনি অনেক পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তাদের সবাইকে কাজ করার জন্য এবং অভ্যাসবশতই প্রত্যেকেই বিস্তারিতভাবে বলতেন।”

blank
চিত্রঃ ইউ-180 সাবমেরিনের ডেকের উপর সুভাষ চন্দ্র বসু এবং ক্যাপ্টেন ওয়ার্নার মুসেনবার্গ

২১শে এপ্রিল, ১৯৪৩ সালে মাদাগাস্কারের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের 400 মাইল দূরে ইউ -180 একটি জাপানি সাবমেরিনের সাথে মিলিত হয় এবং সংকেত বিনিময় করে। সুভাষ চন্দ্র বসু একটি ইউ-বোটে চড়ে বসেন। অন্ধকার কালো আকাশের নিচে জার্মান উ-বোটকে পাহাড়সম ঘূর্ণায়মান  ঢেউ যখন আঘাত করছিল, ক্যাপ্টেন নেতাজীকে জাপানের সাবমেরিনে যেতে জাহাজটি ত্যাগ না করার জন্য জোরালো নির্দেশ দেন। নেতাজী তখন উত্তর দিয়েছিলেন:

“আমি ফিরে যাওয়ার জন্য এতদূর আসিনি।”

নাটকীয়ভাবে কয়েকবার ঘুর্নায়মান ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে তিনি কোনোরকমে জাপানি সাবমেরিনে পদার্পন করেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, ছোট নৌকাটি দুই সাবমেরিনের মাঝে ঢেউয়ের তোড়ে ডুবতে বসেছিল। আরও মজার ব্যাপার ব্যাপার হল, নেতাজী সাতার জানতেন না।

দুজন জাপানী প্রকৌশলী তারপর তাদের জায়গা থেকে U-180 কে পঞ্চাশটি গোল্ড বার সহ ডেকের উপরে নিয়ে গেলেন । তারপর দুটো সাবমেরিন ঢেউয়ের নিচে ডুবিয়ে দেওয়া হয় এবং তারপর যার যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। হিটলারের সাথে দুই বছর অতিবাহিত কাটানোর পরে, বসু তখন জাপানের ইম্পেরিয়াল নৌবাহিনীর অতিথি হয়ে উঠেছিলেন।

blank
চিত্রঃ টোকিওতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী  হিদেকি তোজো ও সুভাষ চন্দ্র বসুর সাক্ষাৎ

আই-২৯ এ জাপানি ক্যাপ্টেন তেরাওকা ভারতীয় অতিথিদের জন্য নিজের কেবিন ছেড়ে দিয়েছিলেন। এটা নিয়ে সাফরানি তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “এটি ঘরেফেরা বা অনুরূপ কিছু”-র মত। যাত্রা শুরু করার আগে জাপানী ক্রুরা মালয়েশীয়ার পেনাং থেকে কিছু ভারতীয় মশলা কিনে নেন। তারা বসু এবং হাসানকে তাদের ক্রসিং এর উদযাপন এবং তাদের রাজার জন্মদিন উপলক্ষে গরম গরম সুস্বাদু খাবার পরিবেষণ করেছিল।

আসছে দিনগুলিতে, বসু সুমাত্রার সাবাং থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে শেষ পর্যন্ত টোকিওতে পৌছান। এখানেই ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী কমান্ড নিয়ে তিনি তার জীবনের সবচেয়ে প্রশংসিত অধ্যায়ের শুরু করেন। যদিও তার স্বাধীন দিল্লীতে ফিরে আসার স্বপ্নটি কখনোই পূরণ করেন নি, তবে বাস্তবতা তৈরির যে লক্ষ্য ছিল তা তরঙ্গায়িত হয়। ১৯৪৫ সালের আগস্টে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলায় জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর, বসু INA এর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেন এটা বলে যে,

“The roads to Delhi are many. And Delhi still remains our goal.”

নিচে কমেন্টে লিখে ফেলুন এই ঘটনার ব্যাপারে আপনার মতামত।

আর লাইক করুন বাংলাহাব-এর ফেইসবুক পেজ ও সাথেই থাকুন। হাজারও ক্লিকবেইট ও অশ্লীল সাইটের ভীড়ে একমাত্র বাংলাহাব-ই আপনাকে পরিচ্ছন্ন ও তথ্যমূলক কন্টেন্ট বাংলায় দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিশ্বাস না হলে আমাদের সাইটটি ঘুরেই দেখুন। ধন্যবাদ।