পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম মানব বসতীপূর্ণ স্থান ‘ওইময়াকোন’

মহাবিশ্বে পৃথিবী খুব ছোট একটি বিন্দু হলেও এর রয়েছে স্থানভেদে বাহারী সৌন্দর্য এবং আবহাওয়ার বিশাল পার্থক্য। কোথাও উত্তপ্ত শুষ্ক মরুভূমি আবার কোথাও হীম শীতল জমাটবাঁধা জন জীবন। অথচ যেখানে জীবনধারণই অসম্ভব সেখানেও গড়ে উঠেছে জনবসতি। পৃথিবীর সেই সবচেয়ে শীতলতম স্থান হল রাশিয়ার সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলের একটি গ্রাম নাম ওইময়াকোন

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৫০ মিটার উপরে অবস্থিত গ্রামটি

ওইময়াকোন শব্দের অর্থ হল জমাট বাঁধেনি এমন পানি। কারণ এখানে একটি উষ্ণ প্রস্রবন রয়েছে। ওইময়াকোন নদীর নামে আসলে এর নামকরণ করা হয়েছে। যেখানে শীতকালে মাছ ছাড়া হয়। ওইময়াকোন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭৫০ মিটার উপরে। এই গ্রামে শীতকাল অনেক দীর্ঘ আর অনেক ঠান্ডা থাকে। এখানে ডিসেম্বরে দৈনিক তিন ঘন্টা দিন এবং জুন মাসে দীর্ঘ একুশ ঘন্টা দিন লক্ষ্য করা যায়। এখানে ১৯৩৩ সালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল -৬৭ ডিগ্রি যা উত্তর গোলার্ধের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
এখানে শিকারে আসা ব্যক্তিরা আগে উষ্ণ প্রস্রবনের পানি ব্যবহার করত। জানা যায়, ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের দিকে গ্রামটি হরিণ পালকদের জন্য যাত্রাবিরতির যায়গা হিসেবে পরিচিত ছিল। সে সময় মাটির নিচ থেকে উঠে আসা উষ্ণ পানি পশুদের পান করাতেন তারা। পরে সেখানকার আদি অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার।

blank
গ্রামটিতে প্রায় ৫০০ মানুষের বাস

আবহাওয়ার দিক থেকে একেবারেই বসবাসের অযোগ্য হলেও এই বৈরী আবহাওয়ায় প্রায় ৫০০ মানুষের বসবাস। গ্রামটি এতটাই ঠাণ্ডা যে, লোকজন বাইরে বের হলে তাদের চোখের ভ্রু থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন অংশ তুষারাবৃত হয়ে যায়। চশমার কাচ মুহূর্তেই ঝাপশা হয়ে যায় এমনকি বরফ জমে যায়। সাধারণ শ্বাস প্রশ্বাস মুশকিল হয়ে যায় যেখানে। এখানকার মানুষ প্রচন্ড ঠান্ডা থেকে বাঁচতে ফার এবং বুট জুতা পড়ে থাকে। কেউ যদি মারা যায় তার শেষকৃত্য করাও বেশ দুষ্কর।

blank
এখানে থেমে থাকা মানেই জমে যাওয়া

এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না বললেই চলে। সুতরাং মোবাইল যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকে। এখানে ব্যাটারী, ইঞ্জিন দ্রুত বিকল হয়ে যায়। গাড়ি সবসময় চালু রাখতে হয় নয়ত আর সারাজীবনে চালু নাও হতে পারে। এমনকি এখানে কলম দিয়ে লেখা যায় না কারণ অত্যাধিক ঠান্ডায় কলমের কালিও জমে থাকে। পানি পান করতে গেলে মুহূর্তেই গ্লাসের পানি জমে যায় ! তবুও এতটা কঠিণ পরিস্থিতিতে মানুষ লড়াই করে বেঁচে থাকে।

এদের সুস্বাদু এবং বিখ্যাত খাবার হল স্ট্রংগানিনা। যেটা মাছ থেকে তৈরি করা হয়। এখানের মানুষের প্রধান খাদ্য মাছ, মাংস, দুধ। কারণ এই গ্রামে চাষবাস করা সম্ভব না বললেই চলে খারাপ আবহাওয়া ও বরফাবৃত অবস্থার জন্য। এরা বল্গাহরিণ এবং ঘোড়ার মাংস খায় যা এখানের নিকটস্থ ফার্ম থেকে আসে। তবে মাছ শিকার করতে হয় প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করেই। বরফের আস্তরণ ভেদ করে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ধৈর্য ধরে মাছ শিকার করতে হয় এদের। এতকিছুর পরেও এরা অপুষ্টিতে ভোগেনা কারণ তারা নিয়মিত পশুর দুধ পান করে যা তাদের শরীরের পুষ্টিগুণ এবং লড়াই করার শক্তি যোগায়।

blank
তাদেরকে মাছ-মাংস, সবজি ইত্যাদি তাজা রাখতে হিমাগার ব্যবহার করতে হয়না

এই গ্রামের বাড়িঘরগুলোও বেশ অদ্ভূত হলেও আবহাওয়া উপযোগী। এখানে বাড়ি ঘরের বাথরুমগুলো থাকে ঘরের বাইরে। ঘরের ভেতর উষ্ণ রাখতে চব্বিশ ঘন্টা বিশেষ পদ্ধতিতে আগুনের ব্যবস্থা রাখা হয়। কাঠ কয়লার আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয় তবে সেটা বেশ নিরাপদ।

গ্রামে মাত্র একটি দোকান ও একটি পেট্রোল স্টেশন রয়েছে এবং মদ্যপানের জন্য একটি বারও রয়েছে। তবে বারটি পৃথিবীর সবচেয়ে একা আর নিঃসঙ্গ বার বলে মনে করা হয়। অতিরিক্ত ঠান্ডায় জমে যাওয়া একটি বার যেন !

blank
মাইনাস ৪১ ডিগ্রী তাপমাত্রায় ব্যালেরিনার ছবিটি তোলা হয়েছে, কোন ফটোশপ ব্যবহার করা হয়নি

গ্রীষ্মে ওইময়াকোন জুন থেকে আগস্টের মধ্যে বছরের ৩ মাস এখানে তাপমাত্রা মাইনাসে থাকে না। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বছরের ৭ মাস পুরোটাই বরফে ঢাকা থাকে। তাপমাত্রা কমপক্ষে গড়ে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। সবচেয়ে কম তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯২৪ সালে মাইনাস ৭১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে গ্রীষ্মে গ্রামটি এক অপূর্ব রুপ ধারণ করে যা সত্যই মনোরম। সত্যিকার অর্থে গ্রামটি একটি বিস্ময়কর শীতকালীন স্থান।

তথ্যসুত্র: ইন্টারনেট।