
গর্ভাবস্থাকে একটি অনেক আনন্দের ও সুন্দর সময় বলা হয়। তবে, কাঙ্খিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত যেভাবেই হোক যখন নিশ্চিত হন যে গর্ভধারণ করেছেন তখন স্বাভাবিকভাবেই আরও নানা পরিবর্তনের সাথে সাথে হবু বাবা ও মা, বিশেষ করে নারীর মানসিক চাপ ও উদ্বেগের ধরণটি বেড়ে যায়। আবার অনেকে বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেন। নারীর গর্ভকালীন সময়ের মানসিক চাপ ও উদ্বেগের পরিমান যদি স্বাভাবিকের থেকে বেশী হয়, তবে তা জন্মপূর্ব বিষণ্ণতা ও অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সূচনা করতে পারে।
বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তনের ফলে এই সময় নারীর দেহে এবং আবেগের ধরনে যে পরিবর্তনগুলো চলতে থাকে, তার সাথে মানিয়ে চলতে অনেকেই গর্ভাবস্থার প্রথমে অনেকে হিমশিম খান। যেমন কর্মজীবীদের জন্য তার কাজের জায়গাটির দায়িত্বটি, সুখী দাম্পত্য সম্পর্কটি, যদি আরও সন্তান থেকে থাকে, তাদের দেখভাল করা –একেবারে গর্ভাবস্থার আগে ঠিক যেভাবে সব মেইন্টেইন করতেন সেভাবেই সব করতে চান। এই সময়ে অনেকেই মাল্টিটাস্কার বা সুপারমম হিসেবে নিজেকে প্রমান করতে উঠেপড়ে লাগেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, গর্ভাবস্থার শারীরিক পরিবর্তন ও মানসিক পরিবর্তন বা অস্থিরতার সাথে মানিয়ে নিতে গর্ভবতী নারীর সবচে বেশী সহযোগিতা ও সহমর্মিতার প্রয়োজন হয়।
গর্ভকালীন সময়ে বিষণ্ণতা ও যুক্ত উপসর্গগুলো সম্পর্কে অনেকে জানলেও সচেতন নন। উদাসীনতা ও যথাযথ চিকিৎসামূলক পদক্ষেপ নেয়ার অভাবে মায়ের মধ্যে জন্মত্তর বিষণ্ণতা দেখা যাওয়া সহ মা ও শিশুর উপর ক্ষতিকর প্রভাব পরে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩০% নারী জন্মপূর্ব বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন এবং এরা যদি তখন প্রয়োজনীয় সাহায্য ও চিকিৎসা না পান তবে এদের প্রায় ৫০% জন্মত্তর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন।
সাধারণত যে ৭টি বিষয় জন্মপূর্ব বিষণ্ণতার ঝুঁকি বাড়ায়
১। হরমোনের পরিবর্তন
নিজেকে সুস্থ রাখতে এবং গর্ভে শিশুকে ধারণ করতে ও সুস্থভাবে বেড়ে উঠার জন্য মায়ের শরীর যেন উপযুক্তভাবে তৈরি হতে পারে সে কারনে বিভিন্ন হরমোন বেশ সক্রিয় হয়ে উঠে। কিছু হরমোনের পরিবর্তন সহজেই গর্ভবতী নারীকে বিষণ্ণ করে তুলতে পারে।
২। সম্পর্ক বিষয়ক
এই সময়ে সঙ্গীর কাছে প্রত্যাশা বেড়ে যায় অনেক। ভবিষ্যৎ শিশু ও মায়ের কথা ভেবে তিনি যদি স্নেহ-মমতা-ভালবাসা দিয়ে আশানুরূপ সহযোগিতা করতে না পারেন, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে সহযোগিতা না পান অথবা সদস্যদের মধ্যে ভাল সম্পর্ক না থাকে; অথবা ঐ সময়ে হবু মা-কে যদি একা থাকতে হয় তাহলে উভয়ের দিক থেকেই চাওয়া পাওয়ার টানাপোরেন সহ সম্পর্কে অস্থিরতা তৈরি হয় যা হবু মা’কে বিষণ্ণ করে তুলতে পারে।
৩। শারীরিক দুর্বলতা, ক্লান্তি নিয়ে হতাশা
গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে, আবার কারো ক্ষেত্রে পুরো গর্ভাবস্থা জুড়েই মর্নিং সিকনেস থাকে। পরিমান অনেক বেশী হলে অনেককে হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হয়। এই সময়ের দুর্বলতা ও ক্লান্তির কারনে হবু মা তার আগের স্বাভাবিক কাজগুলো সহজে করে ফেলতে পারেন না যেটি তার মনে হতাশা ও বিষণ্ণতা অনুভূতি তৈরি করতে পারে।
৪। মায়ের অল্প বয়স, গর্ভধারণে সমস্যা ও গর্ভপাতের ইতিহাস
মায়ের বয়স যদি কম হয়, যদি আগে গর্ভধারণে সমস্যা হয়ে থাকে, গর্ভপাত অথবা মৃত শিশু প্রসবের ইতিহাস থাকলে, বর্তমান গর্ভাবস্থায় নারীটি এক ধরনের আশঙ্কায় ভুগতে থাকেন, যা থেকে বিষণ্ণতা তৈরি হতে পারে।
৫। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব
এই সময়ে অনেকেরই অনিদ্রা দেখা দেয়, যার ফলে ঐ সময়টুকু তিনি জেগে জেগে অনেক কিছু অতিরিক্ত চিন্তা করে ফেলেন, যার ফলে নেতিবাচক অনুভূতি বেড়ে যায়। এই সময়ে প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রশান্তিমূলক ঘুম ও বিশ্রাম।
৬। আর্থিক উদ্বেগ
পরিবারের আসন্ন নতুন সদস্যটির জন্য সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে কোন বাবা-মা না চায়! তাই বর্তমান যুগের গতিময়তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলতে আর্থিক বিষয়ক উদ্বেগে হবু বাবামায়েরা ভুগে থাকেন, এবং সন্তানের ভবিষ্যত কি হবে না হবে ভেবে অনেকে বিষণ্ণ হয়ে পরেন।
৭। পারিবারিক বিষয়
পরিবারের নতুন সদস্যটি যেন সুন্দর ও সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ পায় সেজন্য অনেক হবু বাবামা পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ সচেতন হয়ে উঠেন। এসময় আগের শারীরিক বা মানসিক কোন তিক্ত অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি মর্মপীড়ার কারন হতে পারে যা হাসিখুশি থাকতে বাধা দেয়।
ব্যক্তিভেদে জন্মপূর্ব বিষণ্ণতার কারণগুলো আলাদা হতে পারে।
জন্মপূর্ব বিষণ্ণতার লক্ষণ
গর্ভাবস্থায় এত রকম আবেগিয় তারতম্য হয় যে তার সাথে মানিয়ে চলা মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে পরে । এই অভিজ্ঞতা কারো জন্য স্বাভাবিক হলেও কারো জন্য তা ভীষণ দুঃসহ।
১। দীর্ঘমেয়াদী বিষণ্ণতা
একটানা ২ সপ্তাহের বেশী একই রকম বিষণ্ণ মেজাজে থাকা।
২। কান্না কান্না ভাব
গর্ভাবস্থায় হরমোনের কারনে আবেগ অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠে, খুব সামান্যতে অনেক বেশী কষ্ট লেগে যায়। কিন্তু যদি মনে হয় তুলনামুলক যতটুকু কষ্ট পাওয়ার কথা তার থেকে অতিরিক্ত পাচ্ছেন তবে এখানে সচেতন দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
৩। অসাড় বা শুন্য অনুভূতি
কারণ ছাড়া কোন কিছুতে আগ্রহ ও আনন্দ না পাওয়া। বিষণ্ণতা থেকে আনন্দদায়ক অনুভুতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হচ্ছেন তখন এরকম অনুভূত হতে পারে।
৪। অপরাধবোধ/লজ্জা
গর্ভাবস্থার সাথে অনেক রকম প্রত্যাশাই জড়িত হয়ে পরে। আশেপাশের মানুষের অভিজ্ঞতা শুনে বা দেখে আপনি যা আশা করতে চাচ্ছেন সেই রকম আশা বা অনুভূতি যদি কাজ না করে, সেই ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে নানা নেতিবাচক চিন্তা চলে আসে যা থেকে তিনি অপরাধবোধ বা তীব্র লজ্জা বোধ করতে পারেন।
৫। নিজেকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা
এটা হতে পারে যদি গর্ভবতী মা ঘনিষ্ঠ আবেগিয় বন্ধনযুক্ত পরিবারের সদস্য হয়ে থাকেন অথবা আশেপাশে সন্তান নেই এমন বন্ধুবান্ধব থেকে থাকেন। এমন মা নিজের গর্ভাবস্থা নিয়ে বিব্রত বোধ করে অন্যদের সাথে মেলামেশা কমিয়ে দেন। নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করতে থাকেন, যা আতঙ্ক ও বিষণ্ণতার অনুভূতি তৈরি করতে পারে।
৫। অতিনিদ্রা ও অনিদ্রা
গর্ভাবস্থার বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন, বিভিন্ন মানসিক চাপ ও অন্যান্য চিন্তার কারনেও অনেক নারী অনিদ্রায়, আবার অনেকে অতিনিদ্রায় ভোগেন।
জন্মপূর্ব বিষণ্ণতার লক্ষণগুলো যদি কোন গর্ভবতী নারীর সাথে মিলে যায় তবে তার অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা দরকার।
লেখিকা সম্পর্কেঃ জোহরা আফরিন উপমা। আমি পেশায় একজন কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞানী। গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালবাসি। মনোবৈজ্ঞানিক ফিচার লেখার সাথে যুক্ত আছি। প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরতে ও জ্ঞান শুনতে ভাল লাগে।