বই মানুষের সবথেকে কাছের বন্ধু। ঘোর লাগা কোনো বর্ষা হোক কিংবা হোক কোনো
মন খারাপের বিকেলের শেষভাগ, বই হাতে সমগ্রটাই পালটে যায়। একেকটা চরিত্রে নিজেকে ঢেলে দিয়ে ডুবে যাওয়া যায় সময়ের অতীত কিংবা ভবিষ্যতে। নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে আসে আবার পর মুহূর্তেই অট্টহাসিতে চমকে ওঠে আশেপাশের লোকজন। নির্জনতায় কোনো শর্ত ছাড়াই ছায়াসঙ্গী হয়ে পাশে থাকে। বই পড়ার অভ্যাস যাদের আছে তারা খুবই ভাগ্যবান। কিছু বই কিছু চরিত্র, কিছু গল্প মনে দাগ কেটে যায়। অনেককিছু শেখায়ও বটে।
“পলাতক” এমনই একটি বই যাতে পাঠকের কয়েক ধরনের ক্ষুদা মেটার উপকরণ রয়েছে।

কাহিনি সংক্ষেপ
ড. একরাম আড়াই শ বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কীভাবে বেঁচে আছেন এই আড়াই শ বছর? কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি? কী নিয়ে পালিয়েছেন? এই আড়াই শ বছরেও কেউ তার টিকিটিও ছুঁতে পারল না! ধরা পড়ার পরে কী হবে? কেড়ে নেয়া হবে তার সবকিছু, যা নিয়ে তিনি পালিয়েছিলেন?
ধীরেধীরে উন্মোচন হয়েছে সব। এক এক করে রহস্যের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে সব সত্য।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
থ্রিলার সাইফাই “পলাতক”। সায়েন্স ফিকশন আমার পছন্দের জনরা হওয়াতে বইটার প্রতি আগ্রহের কমতি ছিল না। তবে ভয়ে ছিলাম এই ভেবে যে লেখকের প্রথম বই। গতানুগতিকভাবে সেই কিছু কাটখোট্টা ইংরেজি নাম, রোবট, ওমেগা, মহাকাশ, সুপারকম্পিউটার এগুলাই পাবো। কিন্তু না, বইটি হাতে নেয়ার পর অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করতে লাগল। যেখানে আমরা বইয়ের নাম থেকে শুরু করে চরিত্র, স্থান, প্রেক্ষাপট সবকিছুই দেশের বাহিরের ধাঁচে পড়ে অভ্যস্ত, সেখানে এটা যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুই। বইয়ের নাম থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুই আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে।
যা আগে কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।
কল্পবিজ্ঞান মানেই আমাদের মনে জাগে একটুখানি সায়েন্স এর সাথে প্রায় পুরোটাই কল্পনার মিশেল। যেখানে পটভূমি সেই সুদূর ৩০১৮ সালের সেখানে তো কল্পনার জগৎটা আরো রাশভারীই হবার কথা। কিন্তু লেখক এই দিকটায় খুবই যত্নশীল ও পরিশ্রমী ছিলেন তা লেখাতেই বোঝা গেছে। বিজ্ঞানের প্রতিটা তথ্য প্রায় নির্ভুলতার সাথে দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
বিজ্ঞানের অনেক নতুন নতুন আবিষ্কার লেখনীর সাথে মেলবন্ধন করে তুলে ধরা সত্যিই ঈর্ষনীয়ভাবে ভালো লেগেছে। তথ্যের ভাণ্ডার দেখে মনে হয়েছিল প্রবন্ধ না হয়ে যায়! কিন্তু না, এখানে লেখক চাতুরতা ও কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসটাকে এই পর্যায়ে আনতে তাকে খুব খাটতে হয়েছে তা স্পষ্ট। অনেক গবেষণা করে প্রতিটা বিষয় উপস্থাপন করেছেন তিনি। এবং তাতে সফলও হয়েছেন।
সবথেকে যে বিষয়টি মনে দাগ কেটেছে তা হলো কিছু মুহূর্তে জীবনানন্দ দাশসহ কয়েকজন কবির কবিতার চয়ন জুড়ে দেয়া। এটাও সম্ভব! তাও আবার সায়েন্স ফিকশনে! কীভাবে! পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম এর (লেখক) দ্বারাই সম্ভব। আর এমনভাবে কবিতার অংশগুলো দেয়া হয়েছে যেন ওই মুহূর্তটার বর্ণনা বা অনুভূতি এরচেয়ে ভালো করে কোনোকিছুতেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আর কবি জীবনানন্দ যেন এমন কিছু মুহূর্তের জন্যই কবিতাগুলো লিখেছিলেন!

সায়েন্স ফিকশনে যখন গভীর জীবনবোধ থাকে তখন কিছুটা ইমোশনাল হওয়া অন্যায় কিছু না। আমরা যারা সায়েন্স ফিকশন পছন্দ করি, যেখানে ইমোশন বলে তেমন কিছু থাকে না, তাদের জন্যই হয়তো লেখক চালাকি করে এই ব্যবস্থা করেছেন! একরামের মুখ থেকে বলানো লেখকের ভাষায় বাবার সংজ্ঞাটা যেন ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে…
❝…“কিছু পুরুষদের ভালোবাসাটা বুকপকেটে থাকে প্রেমপত্রের মতো ঘাঁপটি মেরে চুপটি করে। এটা পয়সার মতো ঝনঝন করে বাজে না। বাজে না নূপুুরের মতোও। এটা ঘুড়ির মতো, অনেক উঁচুতে চুপচাপ উড়ে বেড়ায়–কিছু অতিসংকোচের টানে।
এই পুরুষরা কোনো কিছুর প্রেমে পড়ে না। কারো প্রতি প্রেম বুকে জমানোও তাদের জন্য নিষেধ। কাঁধে দায়িত্ব অনেক। হিসাবের খসড়াটা বার বার কাটাছেঁড়া করতে হয়। কদম ফেলার চেয়ে চিন্তা বেশি করতে হয়।
তারা কাছের মানুষদেরকে লজ্জায় বলতে পারে না, ‘ভালোবাসি।’ কিন্তু লজ্জার মাথা খুঁইয়ে হাত পাততে পারে–বাকিদের লজ্জা নিবারণের জন্য।
কারো চোখে তাদের স্বপ্ন দেখা ভীষণ বারণ। কারণ, অনেকগুলো চোখ তাদের দিকে চেয়ে থাকে, বেঁচে থাকার আশায়; আশা পূরণের আশায়।
আমরা এই পুরুষদের নাম দিয়েছি–‘বাবা।’ ”…❞
আমরা আমাদের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই হতাশ থাকি। থাকি অনিশ্চয়তা ঘোরে। দুঃখ কষ্টগুলোকে আকাশের মতো বিশালত্ব নিয়ে ঘিরে থাকতে দেখি। কিন্তু লেখকের কাছে এই বিষয়টা অন্যভাবে ধরা দিয়েছে। ভাবনার গণ্ডিতে জায়গা করে নিয়েছে যে কথাটা…
“দুঃখ হলো ঢিলটার মতো, যা তোমার পানির মতো মনকে আঘাত করে। ঢেউগুলো সুখ, যা দুঃখ-কষ্টের পরেই আসে। কিন্তু আমরা তা খেয়াল করি না। খেয়াল করলে দেখতাম স্রষ্টা আমাদের এক টুকরো পাথরের বদলে কত বড়ো ঢেউ দেন।”

এতকিছুর মাঝেও লেখক হাসাতে ভোলেননি মোটেও। কিছু জায়গায় খুবই সতর্কতার সাথে জুড়েছেন রম্য। পাছে আবার রম্যরচনা না হয়ে যায়।
লেখকের প্রথম বই হিসেবে আশা করেছিলাম অনেক ভুলত্রুটি থাকবে। কিন্তু সে আশায় অনেকাংশে পানি ঢেলেছেন লেখক ও ভূমিপ্রকাশ। যদিও সামান্য কিছু ভুলত্রুটি ছিল কিন্তু লেখকের ঝরঝরে পাঠকবান্ধব লেখনী তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে সফল হয়েছেন।
আরেকটা কথা, বইটার প্রচ্ছদটা খুবই ভালো লেগেছে। যা আবার লেখক নিজেই করেছেন!
বইটা পড়ার পরে মনেমনে ভাবছি, আমাদের দেশের সাইফাই জনরায় পরিবর্তনের ছোঁয়া আসছে। ভবিষ্যতে ভালো কিছুই পাচ্ছি তাহলে আমরা।
বই পড়ুয়াদের বলব বইটা কিনতে ইচ্ছা না হলে ধার করে হলেও পড়ে নিন। কালেকশনে হয়তো একটা বই কম থাকবে কিন্তু স্মৃতির ঝুড়িতে কিছু ভালো লাগা জমা হবে।
তার আগামী উপন্যাস সংক্রমণ ১.০ জন্য অপেক্ষার রেশটা বেড়ে গেল।
একনজরে বই পরিচিতি
═══════════════════════════
বই : পলাতক
জনরা : থ্রিলার, সায়েন্স ফিকশন
লেখক : সজল চৌধুরী
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৮
প্রচ্ছদ : সজল চৌধুরী
বাঁধাই : হার্ড কভার
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৯২ পৃষ্ঠা
অধ্যায় : ৫৩
প্রকাশনী : ভূমিপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য : ২৩০৳ মাত্র
প্রাপ্তিস্থান :
◉ অনলাইন বুকশপসমূহ :
➔ Bibidh – বিবিধ
➔ rokomari.com
➔ BookPanda BD
এছাড়াও বাকি ই-শপগুলোতেও পাওয়া যাবে।
◉ ঢাকা :
➔ নীলক্ষেত : “আলভী বুকস্টোর” (মোস্তফা চাচার দোকানের কাছাকাছি)
➔ বাংলাবাজার : ভূমিপ্রকাশের শোরুম, ৩৮ বাংলাবাজার, ২য় তলা। (সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাদিকে, ফেইথ বুকস এর সাথে লাগোয়া।)
◉ রাজশাহী :
➔ “নিউজ হোম,” নিউমার্কেট।
◉ দিনাজপুর :
➔ “গ্রীন লাইব্রেরি,” মুন্সিপাড়া, নিমতলা রোড
Feature image source: তাসমিয়া