খুব ভয়াবহ এক ব্যাপার ঘটে গেছে মকবুল সাহেবের বাড়িতে। মকবুল হক চেয়ারে হেলান দিয়ে এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে বসে আছেন। চেহারা থমথমে হয়ে আছে। ঝুম বৃষ্টি হবার পূর্বে যেমন আকাশ গুমট হয়ে থাকে, ঠিক সেই রকম! অনতিবিলম্বেই যে তিনি কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিবেন সেটা স্পষ্ট।
ভয়াবহ ব্যাপার টা হল, মকবুল হকের ছেলে মিলু এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলে এনেছে। কলিং বেলের শব্দ শুনে মকবুল সাহেব নিজে দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলেই তাঁর মিনি হার্ট-অ্যাটাক এর মত হল। উনার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে; একা দাঁড়িয়ে না সাথে একজন তরুণী দাঁড়িয়ে, মাথা ভর্তি সিঁদুর! শুধু এখানেই থেমে থাকেনি; এক বেধর্মী মেয়েকে সাথে নিয়ে এক গাল হেসে সে সালাম দিল, ‘আসসালামুআলাইকুম, আব্বা।‘
মকবুল সাহেব যথেষ্ট শক্ত ধরণের লোক। তিনি নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করলেন। সালামের উত্তর না দিয়ে চেয়ারে এসে বসলেন। সেই যে বসেছেন আর উঠে দাঁড়াননি। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, তাঁর ছেলে এমন কাজ কীভাবে করতে পারে! কীভাবে সম্ভব! তিনি একটা সিগারেট ধরালেন। সাথে সাথে চা’ও চলে আসলো। কাজের বুয়া চা দিয়ে গেল, যাবার আগে পাংশু মুখে দু’জনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে গেল।
মকবুল সাহেবের স্ত্রী মিলুর মা এ ঘরে আসার সাহস পাচ্ছেন না। দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। মকবুল সাহেব নিঃশব্দে চা খাচ্ছেন, মাঝে মধ্যে সিগারেটে টান দিচ্ছেন। এটা হলো, কোনো সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বলক্ষণ। তিনি যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার আগে সাধারণত এই কাজ টা করে থাকেন। কখনো কখনো বাথরুমেও যান। এবং বাথরুম থেকে ফিরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আজ এতবড় ঘটনাতে বোধ হয় তাঁর জন্মের বাথরুম চুকে গেছে!
মিলু দু’পায়ের মধ্যে দু’হাত রেখে ভদ্র ভঙ্গিতে বসে আছে। ওঁর স্ত্রী মল্লিকা কোন ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটাই সে উপভোগ করছে। মকবুল সাহেব শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেট টা চায়ের কাপের মধ্যে ফেললেন, যদিও এসট্রে ছিল। তবুও তিনি চায়ের কাপেই সিগারেট টা ফেললেন।
এরপর তিনি উনার স্ত্রী’কে ডাক দিলেন,
‘রহিমা ভেতরে এসো। আমি চাই, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় পরিবারের সবাই উপস্থিত থাকুক।‘
রহিমা কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে এসে দাঁড়াল। সাথে ছোট মেয়ে মিলাও মায়ের সাথে পর্দার আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসল। ছোট মেয়ে বলতে মেয়ে উনাদের একটাই। মিলু কে বড় সন্তান ধরলে মিলা ছোটো সন্তান।
মকবুল সাহেব দু’বার খুক-খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর বললেন,
‘এ বাড়ি মুসলমানের বাড়ি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া হয় এখানে। কোন গান না শুনে শুধুমাত্র গজল শোনা হয় এ বাড়িতে। আর এই বাড়ির ছেলে কি-না একটা বেধর্মী মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসল? একি মগের মুল্লুক না-কি? এটা কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না! সমাজ-সংস্কৃতি বলে তো একটা ব্যাপার আছে না-কি?’
‘আব্বা, আপনি যে সব গজল শুনেন, তাঁর লেখক কাজী নজরুল ইসলামও কিন্তু একজন হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। নাম, মৃণালিনী দেবী।‘- মিলু বলল।
মকবুল সাহেবের নুখ আরও গম্ভীর হল। তিনি গলার আওয়াজ কঠিন করে বললেন,
‘ইউ স্টুপিড! আমার মুখে মুখে কথা বল?’
মিলু চুপ করে রইলো। মকবুল সাহেব বললেন,
‘এ বাড়িতে কোন অনাচার চলবেনা। এই মূহুর্তে তুমি এই মেয়েটিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে। নো মার্সি! ইউ হ্যাভ টু বি পানিশড!’
মিলু ইতস্তত করে বলল, ‘আব্বা, কয়েকটা দিন পরে গেলে হতোনা? নতুন বউ নিয়ে এখন কোথায় উঠবো? অন্তত বাসর রাত টা……’
কথা শেষ হবার আগেই বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা আঁটকে গেল। এই চোখের ভাষা সে বুঝতে পারছে না। মকবুল সাহেব অতি রাগ, বিস্ময়’এ উনার চোখ ভাবলেসহীন হয়ে গেছে। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
‘মন্দিরে যাও নাহয় গাছ তলায়। অ্যাই ডোন্ট কেয়ার। তোমার ব্যাপারে আমি হাত ধুয়ে ফেলেছি। তুমি এক্ষুনি বের হয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। দক্ষিণ দুয়ার খোলা।‘
‘কিন্তু বাবা, আমাদের দরজা তো উত্তর দিকে।‘
মকবুল সাহেবের কথা আঁটকে গেল! বিয়ে করে তো এ ছেলের মাথা পুরোপুরি ভাবেই গেছে! তা নাহলে কী এমন সিচুয়েশনে বাবার সাথে রসিকতা করে! হাতের কাছের কাপ টা তিনি ছুঁড়ে মারলেন। তারপর কঠিন গলায় বললেন, ‘গেট লস্ট’।
‘বাবা, ঘর থেকে পোশাক গুলো নিয়ে যায়?’
‘না! এখুনি বের হও। জাস্ট নাউ!’
পরিস্থিতি সুবিধের না দেখে মিলু তাঁর বউ ‘প্রতিমা’কে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
এই ঘটনা রহিমার দূর্বল হার্ট সহ্য করতে পারল না। তৎক্ষণাৎ মুর্ছা গেল! পড়ে যেতে যেতে মেয়ে তাঁকে ধরে ফেলল। কাজের বুয়া ছুটলো পানি আনতে। স্ত্রী জ্ঞান হারিয়েছে কিন্তু মকবুল সাহেবের সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। এমন ঘটনা এই প্রথম না। অল্পতেই মুর্ছা যাওয়া রহিমার মুদ্রা দোষের মত!
তিনি শান্ত মুখে সিগারেট ধরালেন। সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তাঁর মনে হলো ছোটো একটা ভুল হয়ে গেছে! হতচ্ছাড়া টা-কে জামা-প্যান্ট খুলে ন্যাংটো করে বের করে দেওয়া উচিৎ ছিল! যেভাবে পৃথিবীতে এসেছো, সেভাবেই ফিরে যাও!
২।
বাড়ির সামনে কিছুক্ষণ পায়চারী করে অবশেষে মিলু একটা রিকশা নিল। রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করলো,
‘কই যায়বেন?’
উত্তরে মিলু বলল, ‘যেদিকে ইচ্ছে যেতে থাকো। হাবিয়া দোযখের পথ চিনলে সেখানেও নিয়ে যেতে পার!’
এ কথা শুনে প্রতিমা খিক করে হেসে ফেলল। মিলু বিরক্তি নিয়ে তাকাল প্রতিমার দিকে। এই পরিস্থিতিতে মানুষ হাসে কীভাবে! মাথার উপর খোলা আকাশ, থাকার জায়গা নেই, সবচে’ বড় কথা পকেটের অবস্থাও খুব একটা ভাল না। এখন বাড়ি ভাড়া করতে গেলে আর খাবার টাকা থাকবে না।
আকাশ গুমট বেঁধে আছে অনেক্ষণ ধরে। চৈত্রের শেষের দিকে। সূর্যের প্রিয় মাস এটা তাই ইচ্ছে মত তাপ ঢেলে দিচ্ছে পৃথিবীতে। মিলু দরদর করে ঘামছে। শার্টের হাতা দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে হাতাটা ভিজিয়ে ফেলেছে। প্রতিমা এটা লক্ষ করে শাড়ির আঁচল দিয়ে মিলুর কপালে, গালে মুছে দিল। বলল,
এসব ন্যাকামী কথাতে মিলুর কান না দিলেও চলবে। কুড়ি পর্যন্ত গোনার প্রয়োজন হল না। তার আগেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পরতে শুরু করল। মিলু রিকশার হুড টা নামিয়ে দিতে গেল কিন্তু প্রতিমা বাধা দিল। মূহুর্তেই বৃষ্টি জোড়ালো হতে থাকলো। বৃষ্টির পানিতে সিঁদুর ধুয়ে গাল রাঙ্গিয়ে ধুয়ে যেতে থাকলো। প্রতিমাকে এখন ঠিক কিশোরীর মত লাগছে দেখতে যে কিশোরী ভোরে উঠে বকুল কুঁড়োই বেলা হলে সেই বকুল সুতোই গেঁথে টাঙ্গিয়ে রাখে। খালি পায়ে ছুটে চলে দিক বেদিকে। যার জন্য বকা খায় মায়ের কাছে!
প্রতিমার ভাগ্যে বোধহয় এর কিছুই জুটেনি! খুব ছোটো বেলায় প্রতিমাকে কেউ একজন আশ্রমে দিয়ে যায়। সে বড় হয় সেখানেই। ভালোবাসা নামক ব্যাপারটা তাঁর কাছে ধোঁয়াশা হবারই কথা! মিলুর প্রতিমাকে প্রথম দেখে আশ্রমে। আশ্রমের নাম ‘নিভাস কুন্ডু আশ্রম। এখানে প্রায় সব বয়সী বাচ্চারাই আছে। মিলুর বন্ধু অমনিষের দিদির বাচ্চা হয়না। তাই তিনি একটা বাচ্চা দক্তক নিতে চান। সেই সুবাধেই মূলত তাঁরা এই আশ্রমে আসে। পথিমধ্যে ভাগ্যক্রমে মিলুর সাথে তাঁদের দেখা হয়ে যায় তাই মিলুও সঙ্গে আসে।
আশ্রমে আসার পর তাঁদের ঘুপচির মত একটা ঘরে বসতে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর মিলুদের জন্য চা নিয়ে যায় একটা মেয়ে। মিলু প্রতিমাকে প্রথম দেখে সেখানেই।
একটা নেভি ব্লু রঙের শাড়ী পরে ছিল প্রতিমা। একটা মেয়ে যে কী পরিমান সুন্দরী হতে পারে প্রতিমাকে না দেখলে মিলুর জানা-ই হত না! এ যেন সাক্ষাৎ দেবী!
এরপর থেকে প্রায়ই আশ্রমে যাওয়া আসা শুরু করে মিলু। নানান বাহানাতে একটি বার দেখার প্রয়াসে তাঁর সেখানে না গেলে চলেই না! কখনো কখনো দু’একটা উপহারও নিয়ে যায়। যেমন, ইমিটেশনের কানের দুল, চুলের কাকড়া, চুল বাঁধা ফিতে এই জাতীয় জিনিস। প্রতিমা প্রতিবারেই সেগুলো নিয়ে শুধু হাসে। মেয়েটা শুধু এই একটা জিনিসই পারে আর সেটা হলো সবসময় হাসি!
তিন মাস কেটে গেল এভাবেই। এরপর একদিন মিলু আশ্রমে গিয়ে শোনে প্রতিমার বিয়ের ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী এখানে মেয়েদের বয়স ১৬ পেরোলেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়; যদিও প্রতিমার ক্ষেত্রে বয়স ১৮ পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মাঝে যদি মেয়েরা নিজেরা পাত্র খুঁজে নেয় তবে ভাল আর খুঁজে না পেলে আশ্রম থেকেই পাত্র খুঁজে বিয়ে দিয়ে মেয়েদের বিদেয় করে দেওয়া হয়!
বিয়ের খবর শোনার পর মিলু আশ্রম পরিচারিকা কে গিয়ে বলে সে বিয়ে করতে চায় প্রতিমাকে। যদিও পরিচারিকা প্রথমে রাজি ছিলনা। পরে অনেক বুঝিয়ে রাজি করানো হয়! আশ্রম কতৃপক্ষকে এতে বরং খুসিই মনে হল। মেয়ের বিয়ে দেওয়া মানেই একটা দায়িত্ব কমে যাওয়া!
কিন্তু এখানে শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়। প্রতিমাকে বিয়ে করলে এখুনি করতে হবে এবং হিন্দু নিয়ম মেনেই করা লাগবে! অবশ্যি পরে শুধু রেজিস্ট্রি করে মালা বদল এবং শেষে সিঁদুর পরিয়েই বিয়ের কাজ চুকে দেওয়া হয়।
এভাবে একধরণের ঘোরের মধ্য থেকে মিলু বিয়ে টা করে ফেলে! এ ধরনের বিয়ে গুলোর সাধারণত ভবিষ্যৎ ভাল হয়না।
৩।
বৃষ্টি কমে গেছে। তবে ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি পরছে এখনো। প্রতিমা মিলুর হাত ধরে রিকশাতে বসে আছে। মিলু সেদিকে খেয়াল না করে থাকার জায়গার কথা ভাবছে। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ! কিছুক্ষণ অন্ধকার হয়ে রয়ল চারিদিকে! কানে একটা তীক্ষ্ণ চিনচিনে শন্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলনা।
যখন মিলু চোখ মেলে তাকালো তখন দেখতে পেল সে রাস্তায় পরে আছে আর অদূরেই প্রতিমা মুখ থুবড়ে পরে আছে। মিলুর সারা গা রক্তে মাখামাখি। সে একটা হাত এগিয়ে দিয়ে প্রতিমাকে তোলার চেষ্টা করলো। শক্তি পাচ্ছে না তবুও চেষ্টা করল।
প্রতিমার মুখ টা তুলেই মিলু হকচকিয়ে গেল। মাথার একজায়গায় আঘাত পেয়ে থেতলে গেছে। রক্তে পুরো মুখ মাখামাখি। আরও একবার প্রতিমার সিঁথি সিঁদুরে রাঙ্গিয়ে গেছে। এ সিঁদুর রক্তের সিঁদুর! আশেপাশে অনেক লোক জড় হয়ে গেছে ততক্ষণে। রিকশাওয়ালা সহ ওঁদের তিন জন কে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে তোলা হচ্ছে।
মিলুর মনে হচ্ছে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে সে প্রতিমাকে দেখতে পেলো। সিঁদুরে রাঙা সিঁথিতে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে। একেবারে অকৃত্তিম হাসি!
৪।
পরদিন সকালে মকবুল সাহেব খবরের কাগজ হাতে বসেছেন। কাগজের দ্বিতীয় পাতায় একটা খবরে তাঁর চোখ আঁটকে গেল।
‘সড়ক দূর্ঘটনায় দম্পতির মৃত্যু। গতকাল উত্তরা তেরো নম্বর সেক্টরে ছ’ নম্বর রোডে একটি ট্রাক এবং রিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে দু’জন যাত্রী মারা যায়। ধারণা করা হচ্ছে তাঁরা দু’জন দম্পতি। মেয়েটি মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে ঘটনা স্থলেই মারা যায়। এবং ছেলেটিকে হাসপাতালে নেবার পথে মৃত্যু ঘটে। রিকশা চালক গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। তাঁদের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি।‘
খবরের সাথে সংযুক্ত ছবি দেখে নিজের ছেলে কে চিনতে কোন বেগ পেতে হলনা মকবুল সাহেবের। জীবনে প্রথমবার তাঁর সমস্ত হৃদয় হাহাকারে পূর্ণ হয়ে গেল!
photo: https://afremov.com/the-tears-of-angels-palette-knife-oil-painting-on-canvas-by-leonid-afremov-size-40-x30-offer109-118179121.html