অন্যরকম ভালবাসার গল্প নিয়ে কিছু মুভি পর্বঃ ১

সিনেমা শুধু মনের খোরাকই নয়, সিনেমায় আমরা আমাদের জীবনের প্রতিফলন দেখতে পাই। খুঁজে পাই নিজেদের জীবনের হারিয়ে যাওয়া আবেগগুলো। যখন হারিয়ে যাওয়া আবেগ, হারিয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখের সামনে পর্দায় ভেসে ওঠে তখন কিছুক্ষণের জন্য বাস্তবতা থেকে হারিয়ে গিয়ে কল্পনায় মন ডানা মেলে। খুঁজে পেতে চায় সেই হারানো সুখগুলো আর ভুলে যেতে চায় কস্টগুলো ।

শুধু জীবনের প্রতিফলনই নয় সিনেমাতে আমরা সমাজের বিভিন্ন দিকেরও প্রতিফলন দেখতে পাই যা হঠাৎ আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়, মনে দাগ কেটে দিয়ে বলে আর কতদিন লাগবে বদলাতে? আর কত অন্যায় অবিচারের পর পরিবর্তন আসবে?

তো আজ এমনই কিছু সিনেমার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব। যেগুলো আপনাদের কখনো নিয়ে যাবে শৈশবে আবার কখনো শেখাবে ভালবাসার নতুন সংজ্ঞা । ভালবাসা কি শুধুই প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যেকার সম্পর্ক নাকি তার বিস্তৃতি আরো অনেক বেশী? তা জানতে চলুন তবে সিনেমাগুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

১। Bol (২০১১) (পাকিস্থান):
Image Source: Internet

IMDb Rating: 8.2.

পরিচালকঃ শোয়াইব মানসুর

লেখকঃ শোয়াইব মানসুর

অভিনয়েঃ হুমাইরা মালিক, মানযুর শেহবাই, শেফকাত ছিমা এবং আতিফ আসলাম সহ আরো অনেকে।

সিনেমটি ফুকুওকা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা অডিয়েন্স এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে।

জয়নাব, পাকিস্তানের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত হয়। মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছা ছিল যে, সে তার জীবনের গল্প মিডিয়ার কাছে বলবে। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার ফাঁসি হবার দিন মিডিয়ার সামনে তাকে হাজির করা হয়। জয়নাবের  বর্ণনায় উঠে আসে এক অন্ধকার সমাজের চিত্র।

জয়নাবের বাবা হাসমুতুল্লাহ প্রচন্ড ধর্মপ্রান গোঁড়া মুসলমান । পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ থেকে শুরু করে কোরান তেলওয়াত সব ইসলামিক নিয়ম সে মেনে চলে এবং সে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক নিষ্ঠুর প্রতিচ্ছবি। কারণ তার কথার অন্যথা হলেই সে স্ত্রী বা কন্যাদের গায়ে হাত তুলতে ছাড়তো না। ছেলের আশায় আশায় সে এক এক করে ৭ কন্যার জন্ম দেয় কিন্তু পরিবারে আয়ের মানুষ সে একা। এতে সংসারে অভাব লেগেই থাকে। এর মধ্যে সে ছেলে সন্তানের আশায় আবার সন্তান নেয়। কিন্তু এবার তার ভাগ্যে অন্য কিছুই লেখা ছিল। এবার তাদের ঘরে জন্ম নেয় ৩য় লিঙ্গের একজন । এ খবর জানতে পেরে এলাকার ৩য় লিঙ্গের একজন এসে শিশুটিকে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু হাসমুতুল্লাহ দিতে অসম্মতি জানায়। অসম্মতি জানালেও হাসমুতুল্লাহ কখনই শিশুটিকে মেনে নিতে পারে না এমনকি এজন্য সে শিশুটির কোন নামও দেয় না। এবং সে একবার তার স্ত্রীকে এ প্রস্তাবও করে যে, সে শিশুটিকে মেরে ফেলতে চায়। এতে তার স্ত্রী এবং কন্যারা অসম্মতি জানায় এবং সবসময় শিশুটিকে লুকিয়ে রাখে। তারা শিশুটির নাম রাখে সাইফুল্লাহ । এর মধ্যে জয়নাবের শ্বশুর বাড়ি থেকে জয়নাবকে তাড়িয়ে দিলে জয়নাব আবার বাবার বাড়িতে ফিরে আসে। ততদিনে তাদের সংসারে অভাব বেশ ভালভাবেই জেঁকে বসেছে।

এরপর সাইফুল্লাহ বড় হয়ে কাজের সন্ধানে বের হলে কর্মস্থলে সে যৌন হয়রানির শিকার হয় এবং এরপর বাসায় এ কথা বলার পর সে প্রচন্ড আক্ষেপ থেকে বলে যে তারও হয়ত রাস্তায় রাস্তায় হিজড়াদের মত করে নেচে গেয়ে বেড়ানো উচিত। এ কথা শুনে হাসমুতুল্লাহ নিজেকে আর নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারে না। রাতেই সে নির্মমভাবে শ্বাসরোধ করে সাইফুল্লাহকে হত্যা করে। এবং পুলিশ তার কাছ থেকে ২ লাখ টাকা চায় এই খুনের ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য। এজন্য সে এক বাঈজীকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় । এভাবেই সিনেমাটি বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জয়নাবের ফাঁসি কার্যকর হয় । কিন্তু  কি কারনে জয়নাবের ফাঁসি হয় তা জানতে হলে সিনেমাটি দেখে ফেলুন, শুধু এটুকু বলা যায় যে সিনেমাটি একবার শুরু করলে না শেষ করে ওঠা মুশকিল হবে কারণ আগে থেকে কোন ধারনা করা মুশকিল হবে যে এরপর কি ঘটতে যাচ্ছে! আর সিনেমায় চমক হিসেবে থাকছে আতিফ আসলাম।

এই সিনেমাটিতে লেখক সমাজের কিছু রূঢ় বাস্তবতাকে খুব নিপুনভাবে তুলে ধরেছে । পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি কিভাবে একটি পরিবারকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয় সেই গল্পই তুলে ধরা হয়েছে এখানে।

২। Ratsasan (2018) (তামিল):
Image Source: Internet

Imb Rating: 8.7

পরিচালকঃ রাম কুমার

লেখকঃ রাম কুমার

অভিনয়েঃ ভিসনু ভিশাল, রাধা রাভি, সাঙ্গিলি মুরুগান, নিঝালগাল রাভি

সিনেমাটি আনন্দ ভিকেতান সিনেমা এওয়ার্ড এবং ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ড সাউথ পুরস্কার অর্জন করেছে।

অরুন, একজন তরুণ ও নতুন সিনেমা নির্মাতা। সে তার সিনেমার কাহিনী নিয়ে প্রযোজকদের দ্বারে দ্বারে ঘোরে কিন্তু কেউ তার সিনেমার কাহিনী পছন্দ করে না। এরপর অরুন বাধ্য হয়ে পুলিশের চাকুরিতে যোগদান করে। অরুনের পরিবার বলতে তার বড় বোন, দুলাভাই এবং ভাগনি। সে পুলিশের চাকুরীতে যোগ দিলেও সবাইকে তার সিনেমার গল্প শুনিয়ে বেড়াত। এভাবেই সিনেমার স্বপ্নকে ঘিরে তার দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ এর মধ্যেই শহরে ঘটতে থাকে রহস্যময় নৃশংস সব হত্যাকান্ড। এবং এই হত্যাকান্ডের শিকার হয় সব ১৫ বছরের কিশোরীরা। পুরো শহর জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

আরো চিন্তার বিষয় হল, যেসব কিশোরী নিখোঁজ হয়ে যায় তাদের বাড়িতে একটা উপহারের বাক্সে একটি পুতুলের ক্ষত বিক্ষত মাথা খুঁজে পাওয়া যায়। এসব খুনের কোন কূল কিনারাই করতে পারছিল না পুলিশ। অরুন তার সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখতে গিয়ে এরকম অনেক হত্যাকান্ড নিয়ে ঘাটাঘাটি করে দেখতে পেয়েছিল যে এসব হত্যাকান্ড মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরাই ঘটিয়েছিল। সেই সূত্রকে সামনে রেখেই সে তার বসকে বিভিন্ন ক্লু দিয়ে বোঝাতে চেস্টা করে খুনীকে ধরার জন্য কিন্তু তার বস তার কোন কথাই শুনতে চায় না। একদিন সে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে এসব একজন মানসিক ব্যাধিগ্রস্থ খুনীর কাজ। এরপর সে তার ক্লু অনুযায়ী খুনীকে সনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন খন্ড খন্ড ঘটনাকে এক করতে থাকে।

এরই মাঝে অরুনের ভাগনির জন্মদিনে ঘটে যায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, জন্মদিনের রাতেই তার ভাগনি নিখোঁজ হয়। পাওয়া যায় সেই ক্ষত বিক্ষত পুতুলের মাথাসহ উপহারের বাক্স। এর কিছুদিন পরেই তার লাশ পাওয়া যায় তাদেরই গাড়ির ব্যাককাভারে। অরুনের পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। এরপর অরুন খুনীকে ধরার জন্য তার পরিকল্পনা নতুন করে সাজায় এবং শেষ পর্যন্ত উন্মোচিত হয় এক বেদনাদায়ক ভয়ংকর অতীতের যা পুরো সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কে সেই ভয়ংকর খুনী? অরুন কি শেষ পর্যন্ত খুনিকে ধরতে সক্ষম হয়? জানতে দেখে ফেলুন সিনেমাটি । আশা করা যায়, সিনেমাটি দেখে হতাশ হবেন না।

৩। Hamid (2018) (ইন্ডিয়া):
Image Source: Internet

Imb Rating: 7.7

পরিচালকঃ আইজাজ খান

লেখকঃ রাভিন্দার রান্ধাওয়া, সুমিত সাক্সেনা ।

অভিনয়েঃ তালহা আরশেদ রেশি, বিকাশ কুমার, রাশিকা দুগাল সহ আরো অনেকে।

সিনেমাটি রিজিওনাল এওয়ার্ড এবং সিলভার লোটাস এওয়ার্ড ,ন্যাশনাল ফিল্ম এওয়ার্ডস ইন্ডিয়া পুরস্কার অর্জন করে।

হামিদ ৭ বছরের এক শিশু যে কাশ্মীরে তার বাবা মায়ের সাথে বসবাস করে । সে বাবা মায়ের আদরের একমাত্র সন্তান। তার বাবা সাম্পান তৈরি করে সংসার চালায়। হামিদের সাথে তার বাবার খুব ভাব। একদিন রাতে হামিদের জেদ পূরনের জন্য তার বাবা বের হয় কিন্তু এরপর আর সে ফিরে আসে না। এরপর থেকে হামিদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার সময় কারন এরপর থেকে তার মা তার সাথে অস্বাভাবিক আচরন শুরু করে। কোনভাবেই হামিদকে আর তার মা সহ্য করতে পারে না যেহেতু হামিদের জিদ মেটানোর জন্য বের হয়ে তার বাবা আর ফিরে আসেনি। হামিদ তার বাবাকে খুঁজতে থাকে। একদিন সে স্কুলে তার বন্ধুর কাছে জানতে পারে যে তার বাবা আল্লাহ্‌র কাছে চলে গেছে। এরপর সে জানতে পারে যে, ৭৮৬ হচ্ছে আল্লাহ্‌র নাম্বার। তাই সে তার বাবার ভাঙা মোবাইল থেকে ৭৮৬ নাম্বারে আল্লাহ্‌র কাছে কল দেয়, কিন্তু ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসে না । হঠাৎ একদিন ওপাশ থেকে উত্তর আসে। হামিদের ডায়াল করা নাম্বারে ঘটনাক্রমে কল চলে যায় একজন ভারতীয় সেনার কাছে যে কিনা কাশ্মীরে সেনাবাহিনীতে কাজ করে । হামিদ ভাবে এতদিনে সে আল্লাহ্‌র সাথে কথা বলতে সক্ষম হয়েছে। সে ভাবে ফোনের অপর পাশে আল্লাহ্‌ই কথা বলছে। তখন সে আল্লাহ্‌র কাছে তার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে বলে। আরো বলে যে, বাবা নেই বলে তার সাথে তার মা এখন আর আগের মত করে কথা বলে না আর তাকে আগের  মত করে ভালবাসে না। বাবাকে ছাড়া তারা খুব কস্টে আছে। তার মা একদম বদলে গেছে।

তাদের সংসারে অভাব কাটানোর জন্য হামিদ তার বাবার সাম্পান বানানোর দোকানে যোগ দেয়। তার বাবা সবসময় তাকে কাশ্মীরে জঙ্গিদের এড়িয়ে চলতে বলতেন। কিন্তু একদিন হামিদ বুঝতে পারে যে তার বাবা আর বেঁচে নেই, ভারতীয় সেনার হাতে মৃত্যুবরন করেছে তখন সে ক্ষুব্ধ হয়ে জঙ্গিদের মত ভারতীয় সেনাদের ঢিল ছুঁড়ে মারে । একসময় তার মা ও মেনে নেয় যে তার স্বামী আর বেঁচে নেই। একদিন হামিদের কাছে এক কৌটা লাল রঙ আসে। পার্সেল আসে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে। তারপর? জানতে হলে দেখে ফেলুন সিনেমাটি।

সিনেমার পুরো সময় জুড়ে শিশু শিল্পী তালহা আরশেদ রেশির অনবদ্য অভিনয়,দর্শককে তাদের শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেবে। মনে করিয়ে দেবে মনে মনে আল্লাহ্‌র কাছে বলা কথাগুলো, আল্লাহ্‌র কাছে দেয়া অভিযোগগুলো। বাবা ছেলের অকৃত্রিম ভালবাসা নিয়ে যাবে এক অন্য ভূবনে। এই সিনেমার জন্য তালহা আরশেদ শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পীর পুরস্কার অর্জন করে।

তো অবসরে দেখে নিতে পারেন এই অসাধারণ সিনেমাগুলো ।

চলবে……