শহীদ নূর হোসেন দিবসে বিশেষ গল্প : বিপ্লবী

প্রায় ত্রিশ বছর আগে আজকের এই দিনে নূর হোসেন নামক নির্ভীক যুবক তার বুকে ও পিঠে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” স্লোগান লিখে মিছিলে নামেন। মিছিলটি রাজধানীর জিরো পয়েন্টে পৌঁছলে একটি বুলেট এসে নূর হোসেনের বুক ঝাঁঝরা করে দেয়।

 

এই ঘটনার তিন বছর পর নব্বইয়ে চাঁদপুরে স্বৈরাচার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মিছিলে গুলিবর্ষণের ফলে বীর শহীদ জিয়াউর রহমান রাজু মৃত্যুবরণ করেন।

 

তাঁদের সম্মানেই আজকের এই গল্প …

 

এক

 

সময়টা আশির দশক।

 

শামিম বিকেলের টিউশনিটা সকালে করে নিচ্ছে। আন্দোলনের জন্য সারাদিন ভার্সিটিতে থাকতে হতে পারে। স্বৈরশাসক এরশাদের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করবে। সেখানে তো ওর থাকতেই হবে।

 

‘শালা নাকি মজিদ খান শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে! ‘ আপন মনে বিড়বিড় করছে শামিম। ‘শালারে. . ‘

‘স্যার আমার লেখা হইছে। ‘

 

ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলো ওর। মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকায় অকারণেই ছাত্রকে ধমকে দিল। কিছুক্ষণ পর ওবাসা থেকে বেরিয়ে এল সে। রাস্তায় হাঁটছে ধীর পায়ে। অনুশোচনা হচ্ছে। ছেলেটাকে ইদানিং একটু বেশিই বকাঝকা করছে। কে জানে, সামনের মাস থেকে টিউশনিটা থাকবে কিনা! এটা চলে গেলে বাড়িতে মা’র জন্য টাকা পাঠাতে পারবে না । রাগে মাথার চুলগুলি ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে শামিমের।

 

ভার্সিটির কলা ভবনের সামনে এসে মাথা থেকে এসব চিন্তা কর্পূরের মতো উবে গেল। শতশত শিক্ষার্থীদের কথোপকথনে মুখরিত হয়ে আছে জায়গাটা। শামিম এগিয়ে গিয়ে ওদের সাথে যোগ দিল।

 

কয়েক সেকেন্ড পরেই মিছিলটি শিক্ষাভবন অভিমুখে যাত্রা করল। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে জয়নাল। শামিমদের সাথেই পড়ে ছেলেটা। কী বলিয়ান কণ্ঠ তার! চিৎকার করে বলল,

 

“স্বৈরাচারী শাআআসওওক!”

 

বাকি সবাই সমস্বরে বলল,

 

“চাই না! চাই না!”

 

জয়নাল আবার বলল,

 

“মজিদ খান শিক্ষানীতি!”

 

সম্মিলিত শতকণ্ঠ আবারো বলল,

 

“চাই না! চাই না!”

 

ক্রমাগত উচ্চারিত হচ্ছে স্লোগান দুটি।

 

শামিম আশেপাশের ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকালো। বেশিরভাগই পরিচিত মুখ। সহসা নিতাইকে চোখে পড়ল ওর। ছেলেটা ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করে। এই মিছিলে কী করছে সে? হাত নেড়ে ছেলেটাকে ডাকলো শামিম। একগাল হেসে ভীড় ঠেলে ওর দিকে এগিয়ে এল নিতাই।

 

‘কীরে! এই মিছিলে কী করছিস তুই? এখানে এখন কেউ চা খাবে নাকি!’ কাছে আসতেই নিতাইকে জিজ্ঞেস করল শামিম।

‘স্লোগান দিতে দিতে কারোর যদি গলা হুগায়া যায়, তাইলে তো খাইবো!’ আবারো হাসল নিতাই। ‘মা’র খুব অসুখ। মেডিক্যালে আছে। টেকা লাগবো অনেক,’  বলতে বলতে চোখেমুখে আঁধার নামল ছোট ছেলেটার।

কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল শামিম। কী বলবে? কিছুই তো বলার নাই।

 

দোয়েল চত্বরের কাছে চলে এসেছে মিছিলটা। ওখানে বড়বড় কয়েকটা লরি দাঁড়িয়ে। নির্ঘাত এগুলো পুলিশ আর সেনাবাহিনীর লরি। হঠাৎ করেই মিছিলের উপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষন শুরু হলো। ছেলেমেয়েরা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিকে ছোটাছুটি করতে শুরু করছে। আর্তনাদ ভেসে আসছে সামনে পিছনে সবখান থেকেই। রাস্তার দিকে চোখ পড়তে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল শামিমের। বুকের মধ্যে রক্তের পুকুর বানিয়ে রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে নিতাই। হাঁটু গেড়ে মুমূর্ষু ছেলেটার পাশে বসল ও।

 

‘নিতাই!’ শামিমের কণ্ঠে হাহাকার ঝরে পড়ল। বিড়বিড় করে কী যেন বলছে ছেলেটা। ওর মুখের কাছে কান নিয়ে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করল শামিম। অস্পষ্ট কথাগুলো থেকে দুইটা শব্দের মর্মোদ্ধার করতে পারল ও।

 

‘মা’

‘মেডিকেল’

 

তারপর চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে গেল নিতাই। শামিম হতভম্ব হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকালো। মরার আগে মায়ের জন্য জমানো গুটি কয়েক রক্তে ভেজা নোট ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেছে নিতাই।

 

পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জয়নাল আর জাফর শহীদ হয়েছে। শহীদ ছাত্রদের মরদেহ জানাজার জন্য অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নিয়ে এসেছে ছেলেরা। কিন্তু এখানে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পুলিশ ওদের তাড়া করতে শুরু করে। প্রাণহীন শহীদদের লাশ সূর্য সেন হল পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যায় ছাত্ররা। কিন্তু হলের গেট ভেঙে যৌথ বাহিনী ছিনিয়ে নেয় লাশ দুটো। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র- কর্মচারীদের রুমে ঢুকে তাদের ওপর অত্যাচার চালায় যৌথবাহিনী। এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে শামিম। পা দুটো যেন ভেঙে আসছে। পকেটে হাত দিতেই রক্তমাখা নোটগুলো পেল ও। নিতাই এর জন্য খুব কষ্ট লাগছে। উঠে মেডিক্যালের দিকে এগোল। জানেনা কী করে নিতাই এর মাকে খুঁজে বের করবে।

 

২.

 

এই আন্দোলনের রেশ ধরে সারাদেশ ব্যাপি আন্দোলনের জোয়ার উঠে। স্বৈরাচারী সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর অত্যাচার চালায়। যার ফলে অনেককেই প্রাণ দিতে হয়। লাগাতার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি এরশাদ সরকার তার প্রণীত শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয়।

 

বছর তিনেক পরে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মাঝপথে এরশাদের সাথে আঁতাত করে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ। যার ফলশ্রুতিতে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর ফলে চলমান ছাত্র আন্দোলন চরমভাবে বাঁধাগ্রস্ত হয়।

 

এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেমে আসে হতাশা।

 

৩.

 

এরই মাঝে পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েকটি বছর। সালটা ১৯৯০। নভেম্বরের এক ভোরে ফজর নামাজ পড়তে বসেছেন ডাক্তার শামসুল হক মিলন। দেড় বছর বয়সী ছেলেটা এই ভোরবেলাতেই জেগে বসে আছে। বিছানা থেকে নেমে সে চড়ে বসল নামাজের শেষ বৈঠকে বসা বাবার পিঠে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে এরপর পিঠ থেকে নেমে ধপাস করে শুয়ে পড়লো কোলে। সালাম ফিরিয়ে ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন মিলন। কেন যেন নামাজে দাড়ালেই ছেলেটা তার কোলে কাঁধে চড়ে বসে! কখনো কখনো তো সেজদা দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে তাঁর জন্য। ওর মা এসে কোল থেকে সরিয়ে নিলে তারপর সেজদা দেন তিনি। নয়তো নামাজই ছেড়ে দিতে হয়।

 

একা একাই আদুরে গলায় ওর সাথে কিছুক্ষণ বকবক করলেন তিনি। এরপর ওকে কাঁধে চড়িয়ে কোরআন তেলাওয়াত করতে বসলেন।

 

নাস্তা খেয়ে কাপড় বদলে নিচ্ছেন ডা: মিলন। হাসপাতালে যেতে হবে। বাসা থেকে বের হবার আগে ছেলের জন্য গুঁড়া দুধ আনতে বলে দিল ওর মা।

 

পিজিতে এসে ডা.মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সাথে দেখা হয়ে গেল ডা. মিলনের। তার সাথে ওখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ান দুজনে। কথা বলতে বলতে এগুচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের কোনায় আসতেই আচমকা কোথা থেকে যেন একটা বুলেট এসে আঘাত করে তার বুকে। অসহ্য যন্ত্রনায় বুক চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ডা. মিলন। সাথে সাথে বসে সহকর্মীর পালস চেক করেন ডা. মোস্তফা। হতাশ হয়ে হাতটা ছেড়ে দেন তিনি।

 

কখন থেকে বাচ্চাটা কেঁদেই যাচ্ছে! কোলে নিয়ে ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন মিসেস মিলন। কেন যে এত কাঁদছে বাবু – বুঝতে পারছেন না তিনি। ল্যান্ডফোনের তীব্র শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে ওটার দিকে তাকালেন।

 

“স্বৈরাচারী এরশাদের সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হয়েছেন ডা. মিলন!”

 

পরদিন প্রত্যেকটা খবরের কাগজের হেডলাইন হলো এটা। ডা. মিলনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলন কিছু দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত রূপ লাভ করল।

 

৪.

 

কদিন ধরেই শহরে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চলছে। বিক্ষোভের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে রাজু। ডাকাতিয়া পাড়ের ছোট্ট শহর চাঁদপুরে থাকে সে। চাঁদপুর সরকারি কলেজে পড়ে। কলেজের ছাত্রদের নিয়েই চলছে আন্দোলন। সকাল সকাল কলেজে যাওয়ার তোড়জোড় করছে রাজু।

 

তবে, কলেজ যাওয়ার আগে শামিমের বাড়ি যেতে হবে। ছেলেটা নাকি গতকাল ঢাকা থেকে এসেছে। ওর ন্যাংটো কালের বন্ধু।

 

ছিয়াশিতে মুজিব খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সংঘটনের ছাত্র আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিয়েছিল। আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর কী যেন হয়েছিল ছেলেটার। ঢাকা ছেড়ে নিজের শহরে ফেরেইনি। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে যাওয়ায়, এতদিন পর এসেছে কাল।

 

‘ভাইয়া!’

দরজার দিকে পা বাড়াতেই ছোট বোন সায়মা এসে ডাকল ওকে।

পিছন ফিরে তাকালো ও।

‘কীরে?’

‘শহরে নাকি নতুন একধরনের আইসক্রিম এসেছে! কোন আইসক্রিম! আমার জন্য আনবি?’

‘ইসসসসসসিরে! কত টাকা জমা রেখেছিস আমার কাছে- যে আইসক্রিম কিনে আনবো?’

‘লাগবেনা তোর আইসক্রিম! যা!’

রেগেমেগে চলে গেল ভাইয়ের ঘর ছেড়ে। মৃদু হেসে বাসা থেকে বের হল ও।

 

শামিমদের ছোট বাড়িটার উঠোনের পা রাখতেই শামিমের মায়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। অবাক হলো রাজু।

 

‘কী হয়েছে খালা?’

রাজু এগিয়ে গিয়ে শামিমের মায়ের সামনে দাঁড়ালো।

‘বাবা! তুই আসছিস!’

ব্যগ্র কণ্ঠে বললেন শামিমের মা।

‘শামিমরে বুঝাইয়া শুনাইয়া বাইরে নিয়া যা! পোলাডা আমার হারাদিন ঘরেত পইড়া থায়ে। ঘরে থাকতে থাকতে তো অয় ফাগল হই যাইবো!’

শামিমের মায়ের কথা শুনে উৎকন্ঠিত হল রাজু। হয়েছে কী শামিমের?

 

শামিমের ঘরে এসে দেখলো এখনো বিছানায় পড়ে আছে ছেলেটা।

‘কীরে? এখনো শুয়ে?’

চোখ নাচিয়ে বলতে গিয়েও থেমে গেল রাজু। একি হাল হয়েছে ওর বাল্যবন্ধুর! কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, চোখদুটি কোটরে ঢুকে গেছে।

 

‘এই অবস্থা ক্যান তোর! অসুস্থ তুই?’

বলতে বলতে শামিমের পাশে বিছানায় গিয়ে বসলো রাজু।

মাথা নাড়তে নাড়তে শোয়া থেকে উঠে বসলো শামিম।

‘শরীরে কোনো রোগ নেই।’

 

‘তবে?’

 

‘ভয় লাগে আমার। বাইরে যেতে ভয় লাগে।’

 

‘বলিস কী! কেন?’

 

‘এই আন্দোলনে চোখের সামনে এতগুলো কাছের মানুষকে মরে যেতে দেখলাম। বজ্রকঠিন জয়নাল, চা ওয়ালা পিচ্চি নিতাই, ডাক্তার মামা … ‘

 

শামিমের কথার মাঝেই বাঁধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো রাজু,

‘ডাক্তার মামা? কোন ডাক্তার?’

 

‘পিজির ডাক্তার মিলন। মায়ের দুঃসম্পর্কের ভাই ছিলেন। আমার খুব স্নেহ করতেন। বাচ্চাটা মাত্র দেড় বছরের জানিস? উনি কী দোষ করলেন বল দেখি? উনি তো আন্দোলনে যান নাই। তাহলে কেন?’

এক নাগাড়ে অনেকগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে গেল শামিম। একটু থেমে বলল,

‘উনি মারা যাওয়ার পর বাইরে যেতেই ভয় লাগে। মরণের ভয় তো ছিল না কখনো। এখন কী হলো আমার বল তো?’

 

‘কিচ্ছু হয়নি তোর। আয় আমার সাথে!’

হাত ধরে  টেনে সাথে করে শামিমকে নিয়ে বের হল রাজু।

 

কলেজের কাছাকাছি আসতেই মুক্তার সাথে দেখা হলো ওদের। রাজুদের সাথেই পড়ে মেয়েটা। কেন যেন দারুণ ভাল লাগে ওর মেয়েটাকে। মুক্তাও হয়তো রাজুকে পছন্দ করে। অন্তত ওর লাজুক লাজুক দৃষ্টি তো সেটাই বলে।

 

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

আড়চোখে একবার শামিমের দিকে তাকিয়ে নিজেই আগ বাড়িয়ে এসে জিজ্ঞেস করল মুক্তা।

‘ছাত্র ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভ মিছিল আছে আজ। ছেলেরা সব অপেক্ষা করছে। ওখানেই যাচ্ছি। তুই?’

‘তুই আবার অই নোংরা রাজনৈতিক আন্দোলনে যাচ্ছিস?’

প্রশ্নটা এড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল মুক্তা।

‘তানিয়া তাহলে ঠিকই বলেছে!’

ভীষণ রেগে গেছে মেয়েটা।

 

তানিয়া রাজুর বান্ধবী। কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল রাজু। তারপর ও ও রেগে গেল।

‘নোংরা রাজনৈতিক আন্দোলন মানে? রাজনীতিটা নোংরা হতে পারে! আন্দোলনটা নোংরা নয়!’

চেঁচিয়ে জবাব দিল রাজু।

‘আর তুই আমার কাজে নাক গলাতে আসছিস কেন? বাসায় গিয়ে রান্নাবান্না কর না!’

বলে আর দাড়ালো না। গটগট করে হেঁটে শামিমকে নিয়ে গ্যালারি রুমের দিকে এগোল।

কয়েক কদম গিয়ে পিছন ফিরে তাকালো রাজু। মেয়েটা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে তখনো। চোখদুটো টলমল করছে জলে। চোখাচোখি হতে দৌড়ে পালিয়ে গেল মুক্তা।

মনটা খারাপ হয়ে গেল রাজুর। এত রূঢ় ভাষায় কথা না বললেও পারতো। মনে মনে ঠিক করলো মিছিলের পরেই গিয়ে মাফ চেয়ে নেবে ওর

কাছ থেকে।

 

এই ছোট নাটকটার কিছুই চোখে পড়ল না শামিমের। কিসের ধ্যান করছে, কে জানে!

 

কিছুক্ষণ পরেই কলেজ থেকে ছাত্রদের নিয়ে বিশাল বড় এক মিছিল বের করল রাজু। চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছে,

 

“স্বৈরাচার নিপাত যাক!

গনতন্ত্র মুক্তি পাক!”

 

চিত্রলেখার মোড়ে যেতে সামনে পুলিশ দেখলো রাজু। ভয় পেল না ও। আগের চেয়েও দৃঢ় কন্ঠে স্লোগান দিচ্ছে।

 

বন্দুকের গুলিটা যখন ওর পেট ফেড়ে বের হয়ে গেল , তখন  অদ্ভুত দৃষ্টিতে নিজের পেটের দিকে তাকালো রাজু। তারপর পাশে দাঁড়ানো শামিমকে নিয়ে লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়। প্রাণপণে জ্ঞান না হারানোর চেষ্টা করল ও। কেন যেন মনে হচ্ছে একবার চোখ বুজলে আর মেলতে পারবে না। কেন যেন মনে হচ্ছে আর ঘরে ফিরতে পারবে না । সায়মাকে আইসক্রিম কিনে খাওয়াতে পারবে না। আর কখনো মুক্তার সাথে দেখা হবেনা। ওর কাছে মাফ চাওয়া হবে না। মনে একরাশ হতাশা নিয়ে চোখ মুদলো রাজু।

 

ছয়দিন ধরে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ল সে। ডাক্তার বলেছিল প্রচুর রক্ত লাগবে ওর। সাথে সাথে বন্ধু-শুভাকাংখীরা এসে ভীড় করতে লাগলো হাসপাতালে। সবাই রক্ত দিতে চায়। শামিম তো হাসপাতাল থেকে নড়েইনি। এত কাছে ছিল দুজনে, কিন্তু গুলিটা রাজুকেই ফেড়ে দিল?

 

মুক্তা কয়েকবার এসে দেখে গেছে রাজুকে। কিন্তু এর মাঝে একটা মূহুর্তের জন্যও জ্ঞান ফিরেনি বিপ্লবীর।

 

অবশেষে ১৯৯০ সালের ৩ ডিসেম্বর  সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে জিয়াউর রহমান পাটওয়ারী রাজু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। তার মৃত্যুর সংবাদ

শুনে চাঁদপুর শহরে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শুরু হয় ধ্বংস-লীলা। কিছুদিন পর জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে উত্তপ্ত দাবানল থেমে যায়।

 

রাজুর জানাযা অনুষ্ঠিত হলো চাঁদপুর সরকারি কলেজ মাঠে। সকল ছাত্র সংগঠনের সিদ্ধান্তক্রমে শহীদ জিয়াউর রহমান পাটওয়ারীকে সম্মানের সাথে চাঁদপুর সরকারি কলেজ মাঠে অবস্থিত শহীদ মিনারের পাশে সমাধিস্থ করা হলো।

 

তারপর।

তারপর আরো অনেক বছর পর একদঙ্গল ছেলে চাঁদপুর কলেজের পশ্চিমপাশের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে । কলেজ মাঠে ক্রিকেট খেলার উদ্দেশ্যে।

তখন বিকেল। এইসময়ে এই গেট কখনোই খোলা থাকেনা। অথচ এখন খোলা। অবাক হয়ে মাথা উঁচিয়ে গেটের নামটার দিকে তাকালো আব্দুর রাজ্জাক।

 

“শহীদ জিয়াউর রহমান (রাজু)” যতবার এই গেট দিয়ে ঢোকে ততবার ভাবে , প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাক নাম রাজু ছিল? কখনো তো শোনেনি!

 

খেলা জমে ঊঠেছে। হঠাৎ তমাল একটা বিশাল ছক্কা মারায় বলটা গিয়ে পড়ল মাঠের কোনায় । শহীদ মিনারের পাশের সমাধিটায়। রাশেদ দৌড়ে গেল বল আনতে। গিয়ে দেখে আশি উর্ধ্ব এক অশীতিপর বৃদ্ধ শহীদ মিনারের পাশের কবরটা পরিস্কার করছে। এপিটাফটার উপর টপ টপ করে তাঁর চোখের পানি পড়ছে। রাশেদ বলটা কুড়িয়ে বৃদ্ধের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো।

 

‘এটা কার কবর, চাচা?’

‘জানোনা বুঝি? আমার ছেলের কবর।’

কফ জড়ানো গলায় বললেন তিনি।

‘না, চাচা! জানিনা। আপনার ছেলের কবর এখানে কেন?’

বৃদ্ধকে চুপ থাকতে দেখে রাশেদ আবার বলল,

‘বলবেন না চাচা?’

হাত নেড়ে বন্ধুদের ডাকল ও।

‘শুনবে?’ ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দিকে

তাকালেন বৃদ্ধ।

 

‘সে এক বিশাল কাহিনী।’