তুরস্কের তোপকাপি প্রাসাদের জানা অজানা তথ্য

তোপকাপি প্রাসাদ (তুর্কি ভাষায়: Topkapı Sarayı )  তুরস্কের ইস্তানবুল শহরে অবস্থিত একটি রাজকীয় প্রাসাদ। দ্বিতীয় মুহাম্মদ পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই প্রাসাদের নির্মাণকাজ শুরু করান। এই প্রাসাদ প্রায় ৪০০ বছর (১৪৬৫ – ১৮৫৬) ধরে উসমানীয় সুলতানদের বাসস্থান হিসেবে বিদ্যমান থাকে।উসমানীয় শাসনামলের এক অপূর্ব নিদর্শন এই তোপকাপি প্রাসাদ।এটি শুধু উসমানীয় সুলতানদের বাসস্থান ই নয় এটা ইস্তানবুলের প্রশাসনিক ও শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।

blank
দ্বিতীয় মুহাম্মদ

এই প্রাসাদটি বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। এখানে রয়েছে মুসলমানদের জন্য পবিত্র স্মরণচিহ্ন যেমন হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর আলখাল্লা এবং তরবারি।তোপকাপি প্রাসাদ “ইস্তানবুলের ঐতিহাসিক এলাকা” এর অন্তর্ভুক্ত যা ১৯৮৫ এ উইনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। 

blank

বাইজেন্টাইন কন্সটান্টিপল জয়ী সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের নির্দেশে স্থাপনাটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে। চারটি মূল চত্বর এবং অনেক ছোট ছোট ভবন নিয়ে এই জটিল প্রাসাদটি গড়ে তোলা হয়েছে। রাজকীয় বাসস্থান হিসেবে এর গুরুত্ব উঁচুতে হলেও প্রাসাদে প্রায় ৪,০০০ লোকের বাসস্থান ছিল, যা পূর্বে একটি বিশাল তীরবর্তী এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে ১৫০৯ সালের ভূমিকম্প এবং ১৬৬৫ সালের অগ্নিকান্ডের পরে বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে প্রসাদ চত্বরটির সম্প্রসারণ করা হয়। প্রাসাদে মসজিদ, একটি হাসপাতাল, কয়েকটি বেকারি বা রুটিঘর এবং একটি টাঁকশাল রয়েছে।প্রাসাদের নাম অনুবাদে হয় “কামান ফটক প্রাসাদ”, নামটি এসেছে নিকটবর্তি একটি ফটক থেকে, যা ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে।

১৭ শতকের সুলতানগণ বোসফোরাস এ অবস্থিত নতুন প্রাসাদে সময় ব্যায় করতে পছন্দ করতেন, ফলে তোপকাপি প্রাসাদ ক্রমে ক্রমে এর গুরুত্ব হারাতে থাকে। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে রাজসভা নতুন তৈরি ডোলমাবাঞ্চ প্রাসাদে স্থানান্তর করার সিন্ধান্ত নেন সুলতান প্রথম আবদুল মজিদ। ডোলমাবাঞ্চ প্রাসাদ ছিল ইউরোপীয় শৈলীতে তৈরি শহরের প্রথম প্রাসাদ। যদিও কিছু রাজকর্ম যেমন রাজকীয় কোষাগার, গ্রন্থাগার, মসজিদ এবং টাঁকশাল তোপকাপি প্রাসাদে থেকে যায়।

১৯২১ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর , তোপকাপি প্রাসাদ সরকারী রায়ে ১৯২৪ এর এপ্রিল ৩ তারিখে সাম্রাজ্যিক সময়ের জাদুঘরে পরিণত হয়। তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরটির বর্তমানে সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। প্রাসাদ চত্বরে কয়েকশ ঘর এবং প্রকোষ্ঠ রয়েছে, তবে জনসাধারণের দর্শনের জন্য এখন শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ঘরগুলোতেই প্রবেশাধিকার রয়েছে। চত্বরটিতে মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী ছাড়াও তুর্কিশ সেনাবাহিনীর সশস্ত্র কর্মীদের পাহারায় মোতায়েন রয়েছে। প্রাসাদে উসমানীয় স্থাপত্যকলার বহু উদাহরণসহ বিপুল সংখ্যক চীনা মাটির বাসন, পোষাক, অস্ত্র, ঢাল, বর্ম-আবরণ, উসমানীয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র নকল, ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিক হস্তলিপির সংগ্রহ রয়েছে সেই সাথে উসমানীয় বিভিন্ন মূল্যবান ধন ও রত্ন প্রদর্শনী ব্যবস্থা করা হয়েছে।

blankblank

সুবিশাল এই প্রাসাদে রয়েছে সম্রাটদের ব্যক্তিগত রাজকীয় হেরেম। এই হেরেমে ছিল ৪০০ কক্ষ। যেখানে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা ছিল কোনটাতে স্ত্রী, কোনটাতে রক্ষিতা, কোনটাতে চাকরানী থাকবে। সম্রাটরা তাদের মনোরঞ্জনের জন্য হেরেমে যেত। হেরেমের সবচাইতে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল রানী মাতার ভবন। এতি ১৬শ শতাব্দী তে রানিমাতা তোপকাপি প্রাসাদের আসার পর তৈরি করা হয়।
হেরেমে জলসা, রাজকীয় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এর জন্য ১৬শ শতাব্দীতে একটি বিশাল হল তৈরি করা হয় যা ইম্পেরিয়াল হল বা ইম্পেরিয়াল সোফা নামেও পরিচিত। এই হল এ রয়েছে সুলতানের সিংহাসন।

blank

তুর্কী ভাষায় তোপকাপি মানে কামান দরওয়াজা। চীনের ফরবিডেন সিটির মত তোপকাপি প্রাসাদ ইস্তাম্বুল নগরীর মধ্যেই আরেক নগরী। সাত লক্ষ বর্গমিটার এলাকা নিয়ে এই প্রাসাদ গড়ে উঠেছে। এখানে টাকশাল, স্কুল, লাইব্রেরী, মসজিদ, রাস্ট্রীয় কোষাগার ও পারিষদদের বাসস্থান । গোটা প্রাসাদ এলাকা উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা।ইম্পেরিয়াল বা রাজকীয় গেট দিয়ে ঢুকলে প্রথম যে চত্বর পড়বে তা সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে প্রাসাদ রক্ষীদের বসবাসের স্থান, টাকশাল ইত্যাদি আছে।

তোপকাপি প্রাসাদের ইম্পেরিয়াল গেটের ডানদিকে রয়েছে তুর্কী হাম্মা্ম বা ফোয়ারা, এখানে ওজু ও গোসল করার ব্যাবস্থা রয়েছে। প্রাসাদ দেওয়ালের সাথে আছে হাজিয়া ইরেনী গীর্জা। এটাকে মসজিদে রুপান্তরিত করা হলেও এখানে নামাজ পড়া হত না। ইরেনী গ্রীক শব্দ, এর অর্থ হল শান্তি। রোমান ভাষায় এ গীর্জাকে বলা হত সান্তা ইরেনী। প্রাসাদ রক্ষী অটোম্যান সৈন্য বা জেনেসারীদের কুচকাওয়াজের মাঠও ছিল এই প্রথমচত্বর।

গেট অব স্যালুটেশান

এখন কোন জেনেসারী নেই এই প্রাসাদের ভেতরে।প্রথম চত্বর থেকে দ্বিতীয় চত্বরে ঢোকার জন্য গেট অফ স্যালুটেশান দিয়ে ঢুকতে হয়। প্রশাসনিক এলাকা ছিল এই এলাকা, চত্বরের চারদিকে প্রশাসনিক ভবনগুলো বানানো হয়েছিল।দুই পাশের দুই উঁচু স্তম্ভের মাঝখান দিয়ে দ্বিতীয় চত্বরে প্রবেশ পথ গেট অফ স্যালুটেশান । এখান দিয়ে সুলতান ছাড়া অন্য কারো ঘোড়ায় চড়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। চত্বরের দক্ষিনদিকে বিরাট রাজকীয় রন্ধন শালা। প্রতিদিন ছয় হাজার লোকের খাবার রান্না হত এখানে । জেনিসারী বা সৈনিকদের কোয়ার্টার, হাসপাতাল , স্কুল ইত্যাদি ছিল এই অংশে।

blankblank

blank

রাজকীয় হেরেম ছিল সুলতান, ছেলে মেয়ে , উপ পত্নী, প্রধান খোজা সহ পরিবারের অন্যান্য সবার বাসস্থান। আরবী শব্দ হেরেম এর অর্থ হল নিষিদ্ধ। হেরেম এখন যাদুঘরে পরিনত হয়েছে । সুলতানের কোন উপপত্নী সন্তান জন্ম দিলে তিনি স্ত্রীর মর্যাদা পেতেন। নিগ্রো খোজা ক্রীতদাসকে নিয়োগ দেওয়া হত হেরেমের রক্ষী হিসেবে। হেরেমের আইনকানুন নিয়ন্ত্রন করতেন সুলতানের মা সুলতান ভ্যালিড। দশম অটোম্যান সম্রাট সুলাইমানের শাসনকাল ছিল অটোম্যান শাসনের স্বর্নযুগ । তার সময়ে অটোম্যান সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল ১ কোটি ৬০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। পারস্য থেকে ইউরোপ উত্তর আফ্রিকা প্রভৃতি এলাকা নিয়ে এই বিশাল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল। সম্রাট সুলাইমান সর্বপ্রথম আইন এবং বিচার ব্যবস্থার প্রনয়ন করে তা লিপিবদ্ধ করেন। সম্রাট সুলাইমান মাত্র ৪৬ বছর রাজত্বকরেন।

blankblank

এরপর প্রাসাদের তৃতীয় চত্বর, এর গেটের সামনেই সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ন অনুষ্ঠানগুলো অনুষ্ঠিত হত। তৃতীয় চত্বরে সুলতান বা তার পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কারো ঢোকার অনুমতি ছিলনা।তৃতীয় চত্বরের কেন্দ্র হল সুন্দর সুবিশাল বাগান বা পার্ক। চত্বরের ডান দিকে ছিল সুলতানের কোষগার যা এখন যাদুঘর। এই চত্বরে বাইজেন্টাইন যুগের কিছু নিদর্শনের দেখা মেলে। প্রাসাদের সবচেয়ে আকর্ষনীয় হল যাদুঘর। মোট চারটে বিশাল হলঘরে রাখা আছে অমুল্য প্রত্নতাত্বিক সামগ্রী। এরপর আছে চতুর্থ চত্বর, চতুর্থ চত্বর থেকে বামে বসফরাস প্রনালী এবং ডানে মারমারা সাগর এবং আরো আধুনিক ইস্তাম্বুল দেখা যায়।

সূত্রঃ ইন্টারনেট