ছাত্রীদের পরিচয়ে পাবলিক-প্রাইভেট দ্বন্দ্ব কেন?

এইতো কেবল মাসখানেক আগের কথা। নারীদিবসে খুব গর্ব করে লিখেছিলাম, আমরা নারী, আমরা সব পারি। নারীকে আমি নারীর চোখেই দেখি সবসময়। এরমধ্যে পাবলিক বা প্রাইভেট কোন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে তা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কখনো আসেনি।

যেসব মেয়ে ছোটবেলা থেকেই উচ্চশিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করতে চায় তাদের প্রায় সবারই স্বপ্ন থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তবে প্রতিযোগীর সংখ্যার চেয়ে আসন সংখ্যা যেখানে ঢের কম, সেখানে বাধ্য হয়ে প্রাইভেটেই ভর্তি হতে হয় অনেককে।

আমরা যারা প্রাইভেটে পড়ি তারা পাবলিকে পড়ুয়াদের সম্মান করি। হ্যাঁ, তারা তাদের মেধা দিয়ে দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিয়েছে, যা আমরা পারিনি। কিন্তু কখনো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবিনি।

‘পাবলিকের ছাত্রীদের ঘনঘন মেকআপ লাগে না, ব্রেকআপও হয়না’- এমন শিরোনাম দেখে বেশ খানিকটা থমকে গেলাম। মাত্র একটি বাক্য দিয়ে কত সহজে সমগ্র ছাত্রীসমাজকে দুই ভাগ করা হয়ে গেলো। নিজে যেহেতু প্রাইভেট পড়ুয়া, তাই নিজের গায়ে কিছুটা লাগাটাই স্বাভাবিক।

একজন পাবলিকে পড়ুয়া আপুর লেখার প্রতি সম্মান রেখেই তার কিছু উক্তি বিশ্লেষণ করতে চাই। প্রথমত, প্রাইভেটে পড়ুয়া ছাত্রীরা গণরুমে থাকার সুযোগ না পেলেও সবার সাথে একত্রে থাকতে জানে। আমার মত হাজারো প্রাইভেট পড়ুয়া ছাত্রী ভবিষ্যতে যৌথ পরিবারে থাকার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখে।

মফঃস্বল থেকে উঠে আসা অনেক মেয়েই পাবলিকে চান্স না পেয়ে প্রাইভেটে ভর্তি হয়। হয়ত, নিজের সম্মান শ্রেণী পাশের স্বপ্নটা মাঝপথে থামিয়ে দিতে চায়না বলে। প্রাইভেটে প্রতি সেমিস্টারে বেশ অনেকগুলো টাকা দিতে হয়। সেই টাকার জন্য নিজের দামী জামা কেনার ইচ্ছাটাকেও কবর দেয় অনেকে।

টিউশনির বাজারে পাবলিকের ডিমান্ড বেশি। তাই তারা বেতনও পায় বেশি। পাবলিকের ছাত্রী থেকে দুই তৃতীয়াংশ কম বেতন পাওয়ার পরও প্রাইভেটের ছাত্রীরা টিউশনি করায়। মা বাবার উপর চাপটা যদি তাতে খানিকটা কমে আরকি!

আপুর পুরো লেখায় সবচেয়ে হাস্যকর লেগেছে মেকআপ আর ব্রেকআপ এর ব্যাপারে পাবলিক প্রাইভেটকে দুভাগ করা। এমন শত শত প্রাইভেট পড়ুয়া ছাত্রী আছে যারা কখনোই মেকআপ করেনা। এই আমার নিজের কাছেই তো সাজগোজ বলতে ২০টাকার সস্তা কাজল। হ্যা, অনেকেই মেকআপ করে কিন্তু সেটা তো পাবলিকেরও অনেক মেয়েও করে। পাশ্চাত্য দেশের পোশাকে নিজেকে মানিয়ে নেন অনেক পাবলিক পড়ুয়া ছাত্রী। এটা তো একান্তই একজন ছাত্রী/নারী নিজস্ব ইচ্ছা। তার পোশাক বা সাজগোজে পাবলিক প্রাইভেট ফুটে উঠেনা। শুনলে হয়ত অবাক হবেন, আমাদের প্রাইভেট ভার্সিটিতে লেগিংস পরা মানা আছে। অশালীন পোশাক পরতে বারণ আছে।

পুরো লেখায় বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে প্রেম, প্রেমিক আর ভালোবাসার সম্পর্ক তুলে ধরছেন আপু। প্রেমের ক্ষেত্রেও কি পাবলিক প্রাইভেট প্রভাব ফেলে! পাবলিকের মেয়েরা একজনকে নিয়ে পুরো ভার্সিটি জীবন কাটিয়ে দেয়। আর, প্রাইভেট পড়ুয়ারা ঘন ঘন ব্রেকআপ করে। এই আমি নিজেই তো ১ বছর ধরে একজনকে ভালোবেসে অপেক্ষা করে যাচ্ছি। কোন একদিন আমার ডাকে সে সাড়া দিবে সেই দিনের অপেক্ষায় আছি। কই আমি তো অন্য কারোর সাথে প্রেমে জড়াইনি। বরং, প্রেমের প্রস্তাবে হাসিমুখে জানিয়ে আসছি, আমি একজনকে ভালোবাসি, তার অপেক্ষায় আছি।

সব কিছু সপে দেয় এমন মেয়েদের আমরা বোকা বলি। প্রাইভেট নাকি পাবলিকে পড়ুয়া তা দিয়ে বিচার করিনা। ভালো আর খারাপ মিলেই সবকিছু। পাবলিক বলুন আর প্রাইভেট বলুন অনেক ভালো ছাত্রী যেমন উভয় জায়গায় রয়েছে। তেমন জাতি কলঙ্কিত করার মতনও ছাত্রী দুই জায়গায় রয়েছে।

দোহাই লাগে, পাবলিক প্রাইভেট দিয়ে আলাদা করতে যাবেন না। আমরা নারী। আমরা শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টায় চেষ্টারত। এতটুকু পরিচয়ই কি যথেষ্ট নয় আমাদের জন্য? কেন নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবো। আমার বান্ধবীদের অনেক পাবলিকে পড়ে। আমরা যখন এক হই তখন সবার জীবনের গল্পগুলো তো একই রকম শুনি। কই, সেখানে তো প্রাইভেট পাবলিক আমাদের মাঝে কোন দেওয়াল তুলতে পারেনা।

আমরা প্রাইভেটিয়ান। আমরা পাবলিকে পড়ার স্বপ্ন পূরণ করতে না পেরেও হাল ছাড়িনা। আমরা অধিক অর্থ ব্যায় হবে জেনেও নিজের পড়ালেখা বন্ধ করে দেইনা। বরং, নিজের প্রিয় দামী মোবাইল, পোশাক কেনার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দেই সেমিস্টার ফি জোগাড়ের জন্য। আমরা মনেপ্রাণে বাঙালি আর বাংলাদেশি। নচেৎ, পাবলিকে চান্স না পাওয়ার পর উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরেই দৌড়াতাম।

আসুন প্রাইভেট পাবলিক দ্বন্দ্বটাকে উপড়ে ফেলি নিজের চেতনা আর মস্তিষ্কে। আমাদের পরিচয় হোক, আমরা ছাত্রী, আমরা নারী, আমরা জয়িতা।

লেখিকাঃ  নিশীতা মিতু। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এন্ড টেকনোলোজি।