আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি যা সাধারণ ভাবে সি আই এ নামে পরিচিত, নানা কারণে বিতর্কিত। বিভিন্ন সময়ে বিশ্ব গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো অভিযোগ করে আসছে যে এই সংস্থা সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গোপন কারাগার পরিচালনা করে আসছে। অভিযোগ আছে, বহু মানুষকে শুধু সন্দেহের বশে দিনের পর দিন এসব জায়গায় আটকে রাখা হয়। চলুন জানা যাক, সেরকম কিছু কারাগারের কথা।
১। ভারত মহাসাগরের দিয়াগো গার্সিয়া
দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপটি ভারত মহাসাগরে অবস্থিত। এটা ভারত থেকে ১৬০০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং তানজানিয়া থেকে ৩২০০ কিলোমিটার পুর্বে অবস্থিত।এই স্থানটি যুক্ত্রাজ্য নিজেদের অধীনে বলে দাবি করে। ১৯৬০-৭০ এর মাঝে যুক্তরাজ্য এই এই দ্বিপের সব অধিবাসীকে পাশের মৌরিশাস ও সিচিলিসে স্থানান্তরিত করে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে “ক্যম্পার থান্ডার কোভ” নামে বিশাল নৌ ও বিমান ঘাঁটিনির্মাণের অনুমতি দেয়। বর্তমানে এখানে ৪০০০ জন সামরিক সেনাসদস্য রয়েছে। যদিও যুক্তরাজ্য এখানে বন্দী রাখার কথা অস্বীকার করে আসছে কিন্তু ২০১৫ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আমেরিকার সেসময়ের সেক্রেটারি অব স্টেট কলিন পাওয়েল এর প্রাক্তন চীফ অব স্টাফ লরেন্স উইলকারসন ভাইস নিউজকে বলেন, “সন্ত্রাসবাদে জড়িত সন্দেহে অনেককে এই দ্বীপে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো।” এগুলো হয়েছিল ৯/১১ টুইন টাওয়ার হামলার কিছু পরেই।
২। তিমারা জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র, মরক্কো
মরক্কোর রাজধানী রাবাত থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এই ইন্টারোগেশন সেল বা অপরাধী জিজ্ঞাসাবাদের কেন্দ্রের অবস্থান। এটা মরক্কোর সরকারের অধীনে Directorate for the Surveillance of the Territory (DST) দ্বারা পরিচালিত।
২০০৪ সালে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করে যে, এই কারাগারে ব্যপক মাত্রায় মানবতাবিরোধী কাজ কর্ম হচ্ছে। সংস্থাটি জানায়, মরোক্কান জিজ্ঞাসাবাদকারীরা অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রহার, অপমান, বৈদ্যুতিক শক, আগুনে ছ্যাঁকা দেয়া ও ওয়াটার বোর্ডের মতো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির পন্থা অবলম্বন করে। জোর করে এরকম অপরাধের স্বীকারক্তি আদায় করা হতো যার সাথে অভিযুক্তের কোন সম্পর্কই নেই। ২০১০ সালে এপি জানায় যে, এই কারগার মূলত সি আই এ’র অর্থায়নে পরিচালিত হয়।
৩। ডিটেনশন সাইট গ্রিন, থাইল্যান্ড
রহস্যময় এই কারাগারের অস্তিত্ব থাইল্যান্ড বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। যদিও বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয় যে, এটা রাজধানী ব্যাংকক বা দেশটির উদন থানি প্রদেশের এর আশেপাশে কোথাও অবস্থিত। ২০০৯ সালে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সি আই এ নিজেরাই স্বীকার করেছে যে তারা ৯২ টি টেপ নষ্ট করে ফেলেছে যাতে সন্ত্রাসবাদীদের জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্য ও তথ্য ধারণ করা হয়েছিল এবং তা ধারণ করা হয়েছিল থাইল্যান্ডের কোন অজ্ঞাত স্থানে। সেই রিপোর্টে আরো বলা হয়, কারাগারটি মূলত বিভিন্ন নতুন শাস্তি পদ্ধতি কেমন কাজ করে তা বোঝার জন্য ব্যবহার করা হতো। এরই নির্মম শিকারদের একজন, আবু জুবায়েদ। সৌদি এ নাগরিককে ২০০২ সালে পাকিস্তান থেকে আটক করা হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী, জুবায়েদকে পানির নিচে মুখ হা করে চুবিয়ে শাস্তি দেয়া হতো। আবদ আল রাহীম নামে আরেক জনকেও এভাবে শাস্তি দেয়া হয়, যাকে ইউ এস এস কোল বোমা বিস্ফোরণের মূল পরিকল্পনাকারী বলে ধরা হয়।
৪। দ্য সল্ট পিট, আফগানিস্তান
কাবুলের উত্তরে একটি প্রাক্তন ইট ফ্যাক্টরিতে এই কারাগারের অবস্থান। ২০০২ সালে এই বন্দী কেন্দ্রটি নির্মিত হয়, যেটা তৈরিতে খরচ হয়েছে ২ লাখ মার্কিন ডলার। ২০০২ সালে একজন হাই-প্রোফাইল বন্দী গুল আহমেদ কারাগারে আটকাবস্থায় মারা যান। দ্য ডেইলি বিস্ট পত্রিকার ২০১২ সালে এক রিপোর্টে এ ঘটনা নিয়ে ব্যপক অনুসন্ধান চালায়। অভিযোগ রয়েছে, গুল আহমেদ অত্যাধিক তীব্র তাপমাত্রার জন্য মারা যান। তাকে বস্ত্রহীন করে প্রহার করা হয় এবং তীব্র শীতের রাতে কক্ষের মেঝেতে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়। ২০১৪ তে মার্কিন সিনেটে সি আই এ’র জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত কিছু গপন নথি অবমুক্ত ক্রা হয়। এতে দেখা যায়, এসব কাজের জন্য সি আই এর কোন কর্মকর্তা তো বিচারের মুখোমুখি হন নি, উলটো পুরষ্কৃত হয়েছেন। গুল রহমান পরে মারা যান। মার্কিন সিনেট রিপোর্টে এরকম আরো ১১৯ জন বন্দীর করুণ পরিণতির কথা প্রকাশিত হয়।
৫। ক্যাম্প ঈগল, বজনিয়া ও হার্জেগোভিনা
সাল ২০০৫। বসনিয়ার দুইজন ব্যক্তি নিহাদ কারসিক ও আলমিন হার্বেউস বসনিয়ার একটি পাব্লিক টেলিভিশন চ্যানেলকে একটি সাক্ষাৎকার দেন, যাতে তারা ক্যাম্প ঈগলে তাদের দিন গুলোর কথা তুলে ধরেন। বসনিয়ার সেনারা তাদের অপহরণ করে ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। ক্যাম্প ঈগল ছিল সাবেক যুগোস্লাভিয়ার বিমান ঘাঁটি। সেখানে তাদেরকে প্রহার করা হয়। এরপর কয়েকজন আমেরিকান্ন সাদা পোশাকে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ও বুঝতে পারে তারা ভুল ব্যক্তিদের আটক করেছে। নিহাদ ও আল্মিনকে ৩০০ ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় ও বলা হয় তারা যেন এসব নিয়ে মুখ বন্ধ রাখে। ২০০৬ সালে বিবিসি প্রচারিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুইস তদন্ততকারীরা বেশ কয়েকটি দেশে সি আই এ’র এরকম গোপন কারাগারের সন্ধান পেয়েছে। এদের মাঝে রয়েছে ইতালি, সুইডেন, মেসিডনিয়া, স্পেন, তুরস্ক, জার্মানি, সাইপ্রাস, ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, গ্রিস।