এ লেখার সাথে যুক্ত ছবি্টি গ্রাফিক্সের মাধ্যমে পরিবর্তিত। মূল ছবির উৎস জাতীয় পত্রিকা।
জাতি হিসেবে আমরা ক্রিকেটপাগল। ভারতের ক্ষেত্রে যদি “ইট ক্রিকেট, ড্রিংক ক্রিকেট” বলা হয়, আমাদের জন্য অবলীলায় সেটিকে “লিভ ক্রিকেট” বলে ফেলাই যায়। যখন বাংলাদেশের কোন সিরিজ চলে, আমাদের জীবনাচরণই বদলে যায়। কি অফিসে, কি ক্লাসে অথবা বাসায়, সবখানেই প্রাধান্য পায় ক্রিকেট। দেশের ক্রিকেটের প্রতি এই আবেগের পাশাপাশি ক্রীড়ামোদী অনেক মানুষ দেশের বাইরের ক্রিকেটেরও খোঁজ রাখতে ভালোবাসেন। কাউন্টি ক্রিকেটের কি অবস্থা, কিংবা অস্ট্রেলিয়ার বিগব্যাশ কিংবা আইপিএল, সব খানেই উৎসুক কিছু চোখ খুঁজে ফেরে আনন্দ, কিংবা রোমাঞ্চ।
সময়ের সাথে সাথে ক্রিকেট অনেক এগিয়ে গেছে। প্রতি মুহূর্তেই নতুন রেকর্ডের জন্ম হচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে অনেক দিনের পুরোন রেকর্ড। কিন্তু এই রেকর্ডের ভাঙাগড়ার ভীড়েও এমন কিছু ঘটনা আছে, যেগুলো হয়তো আমাদের অনেকেরই জানার বাইরে। সাধারণভাবে অজানা কিন্তু বৈচিত্র্যময় কিছু ঘটনা নিয়েই আজ আমি লিখছি। সুপ্রিয় পাঠক, চলুন না ঘুরে আসি সেরকম কিছু ঘটনার মধ্যেঃ
১। ক্রিস গেইল
ক্রিস গেইলের মারকাটারী ব্যাটিং এর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যাটিং এর সংজ্ঞাই বদলে ফেলা এই ব্যাটসম্যান কিন্তু টেস্টেও অসাধারণ এক রেকর্ডের অধিকারী। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি কোন এক টেস্ট ম্যাচের প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকিয়েছেন। তাঁর আগে এই রেকর্ড আর কারো ছিল না। এখন পর্যন্ত সেটি অক্ষুণ্ণই আছে।
২। অ্যালেক স্টুয়ার্ট
অ্যালেক স্টুয়ার্ট ইংল্যান্ডের একজন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ছিলেন। ছিলেন সাবেক অধিনায়কও। তাঁর জন্মতারিখের সাথে তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের রানের একটা অদ্ভুতুড়ে সামঞ্জস্য আছে। তাঁর জন্মতারিখ ৮.৪.৬৩। মজার ব্যাপার হলো, তাঁর মোট টেস্ট রানও ৮৪৬৩!
৩। অ্যালান বোর্ডার
অ্যালান বোর্ডার অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে একজন সফল ব্যাটসম্যান ও অধিনায়ক। তিনি তাঁর ক্যারিয়ারের ১৫৬ টি টেস্টের মধ্যে ১৫৩ টি টেস্টই খেলেছিলেন একটানা। মাঝে কোন বিরতি না দিয়ে এতগুলো টেস্ট খেলার রেকর্ড আর কারো নেই।
৪।অ্যাডাম গিলক্রিস্ট
অভিষেকের পর থেকে আবার একটানা সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলেছেন অস্ট্রেলিয়ারই অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। তিনি একটানা ৯৬ টি টেস্ট খেলেন তাঁর অভিষেক টেস্ট থেকেই।
৫। ম্যাচের তারিখ, সময় ও প্রয়োজনীয় রান যখন একই
১১/১১/১১ তারিখের কোন এক ম্যাচে, সকাল ১১.১১ মিনিটে ম্যাচ জয়ের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ঠিক ১১১ রান!
৬। ইশান্ত শর্মা
ইশান্ত শর্মার একটা অদ্ভুত রেকর্ড আছে। এই রেকর্ডটা জানার পরে হয়তো অনেকেই অবাক হয়ে যাবেন। তো কি সেই রেকর্ড?
প্রিয় পাঠক, আমি “বোলার” ইশান্ত শর্মার কথা বলছি না। বলছি “ফিল্ডার” ইশান্ত শর্মার কথা। অ্যালিস্টার কুক-২৯৪ রান, মাইকেল ক্লারক-৩২৯ রান এবং ব্রেন্ডন ম্যাককালাম-৩০৪ রান এই তিনটি ইনিংসের সময়ই ইশান্ত শর্মা এদের তিনজনের ক্যাচ ফেলেছিলেন। সেটাও আবার তাঁরা উইকেটে সেট হবার আগেই!
৭। রান বনাম উইকেট
নিউজিল্যান্ড এর ক্রিস মার্টিন এবং ভারতের ভগবত চন্দ্রশেখর এই দুইজনের মোট টেস্ট রান তাঁদের মোট টেস্ট উইকেটের চেয়ে কম! ৭১ টি টেস্ট খেলে মার্টিন উইকেট নেন ২৩৮ টি। আর রান করেছেন কত শুনবেন? মাত্র ১২৩! চন্দ্রশেখরই হয়তো তাঁর চেয়ে ভালো (!) ব্যাটসম্যান ছিলেন বলে দাবি করতে পারেন। ২৪২ টি উইকেট নেবার পাশাপাশি চন্দ্রশেখর ১৬৭ রান করেছিলেন যে “মাত্র” ৫৮ টেস্টে!
৮। টানা ম্যান অব দ্য ম্যাচ
ক্রিকেট ম্যাচে “ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ” হওয়া নিঃসন্দেহে অনেক সম্মানজনক একটি কীর্তি। কিন্তু একটানা কতগুলো ম্যাচে ম্যাচসেরা হওয়া সম্ভব? ১ টি? ২ টি? নাকি ৩ টি?
প্রিয় পাঠক একটানা ৪ টি ওয়ানডেতে একজন ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়েছিলেন। বলুন তো কে তিনি? শচীন টেন্ডুলকার? রিকি পন্টিং? নাকি জয়াসুরিয়া?
তিনি “বাংলার রসগোল্লা” সৌরভ গাঙ্গুলী।
৯। ইনজামাম উল হক
ইনজামাম উল হকের নাম শুনতেই আমাদের মনের আয়নায় ভেসে ওঠে একজন নাদুস নুদুস ব্যাটসম্যানের ছবি। ক্রিকেটের এক অলস সৌন্দর্যের ছবি। যিনি অহেতুক দৌড়ে রান নেওয়া পছন্দ করতেন না। পিচে দাঁড়িয়েই বিশাল সব ছক্কা হাকাতেন অবলীলায়। স্পিনে দারুণ দক্ষ এই ব্যাটসম্যানের কিন্তু বোলার হিসেবেও একটা মজার রেকর্ড আছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি তাঁর প্রথম বলেই উইকেট পেয়েছিলেন!
১০। যারা ব্যাটিং এর ১০ টি পজিশনেই ব্যাট করেছিলেন
ক্রিকেটে ব্যাটিং অর্ডার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ভিন্ন ভিন্ন ব্যাটসম্যান ভিন্ন একেক পজিশনে সফল হন। অস্ট্রেলিয়ার রিকি পন্টিং যেমন ৩ নম্বরে ব্যাট করে সফলতা পেয়েছেন। বাংলাদেশের মুশফিকুর রহিম যেমন ৪ এ ভালো খেলেন। এখন যেমন সাব্বির রহমান টি-টোয়েন্টিতে ৩ এ ধারাবাহিকভাবে ভালো ব্যাটিং করছেন। কিন্তু পাঠক হয়তো জানলে অবাক হবেন, ক্রিকেট ইতিহাসে এমন ৪ জন খেলোয়াড় আছেন, যারা বিভিন্ন সময় দলের প্রয়োজনে ১০ টি ভিন্ন পজিশনে ব্যাট করেছেন। তাঁরা হলেন- ল্যান্স ক্লুজনার, আব্দুর রাজ্জাক, শোয়েব মালিক এবং হাশান তিলকারত্নে।
১১। গ্রায়েম স্মিথ- সফলতম ক্যাপ্টেন
ক্রিকেট বিশ্ব এখন পর্যন্ত অনেক অধিনায়ক দেখেছে। দেখেছে অনেক সফল এবং ব্যর্থ অধিনায়কও। এদের ভিতরে দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথের নাম অন্যতম সফল একজন অধিনায়ক হিসেবে মনে রাখতেই হবে। তিনি একমাত্র অধিনায়ক, যিনি ১০০ এর বেশি টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর কোন অধিনায়কেরই এই অসামান্য রেকর্ড নেই।
১২। থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে রান আউট হওয়া প্রথম ব্যাটসম্যান
ক্রিকেট ইতিহাসে অনেকগুলো প্রথম ঘটনার সাথেই শচীন টেন্ডুলকারের নাম জড়িয়ে আছে। এর অনেকগুলোই আমরা জানি। আবার অনেকগুলো জানিও না। তিনিই যে টেস্ট ক্রিকেটে থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে রান আউট হওয়া প্রথম ব্যাটসম্যান, এটা আমরা কয়জন জানি? ১৯৯২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে একটি টেস্ট ম্যাচে তিনি থার্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে রান আউট হন। ফিল্ডার ছিলেন জন্টি রোডস। মজার ব্যাপার হলো, ঠিক তার পরের দিনই দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং এর সময় জন্টি রোডসকেও তিনি একই কায়দায় রান আউট করেন!
১৩। ভারতের তিন কীর্তি
ভারত ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি দুই ধরণের ক্রিকেটেই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে, এটা আমরা সবাই জানি। মজার ব্যাপার হলো, ভারতই ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র দল, যারা ৬০ ওভার, ৫০ ওভার এবং ২০ ওভারের ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জিতেছে।
পাঠক, ঘাবড়ে গেলেন? ঘাবড়ানোর কিছু নেই! ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপের সময় ওয়ানডে ক্রিকেট ৬০ ওভারের খেলা ছিল। যা পরে পরিবর্তিত হয়ে ৫০ ওভারে নেমে আসে। সেই হিসাবে ভারত ৬০, ৫০ এবং ২০ ওভারের বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র দল। মজার না?
১৪। যিনি ক্রিকেটার, তিনিই টেনিস খেলোয়াড়
কেনিয়ার সাবেক অধিনায়ক আসিফ করিমকে আমরা সবাই চিনি। একসময় কেনিয়ার সাথে আমাদের চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত মাঠে। সে সময় তিনিই ছিলেন কেনিয়ার অধিনায়ক। মজার ব্যাপার হলো, তিনি ক্রিকেটের পাশাপাশি কেনিয়ার হয়ে টেনিসও খেলেছেন। সেটিও ডেভিস কাপে!
১৫। হ্যাট্রিক ও জন্মদিনের উপহার
টেস্ট ক্রিকেটে হ্যাট্রিক একজন বোলারের আজন্ম আরাধ্য স্বপ্ন। এই স্বপ্ন যদি পূরণ হয় নিজ জন্মদিনের দিন, তাহলে কেমন হয়? হ্যাঁ প্রিয় পাঠক, অস্ট্রেলিয়ার পেসার পিটার সিডলের জীবনেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। ২০১০ সালের ২৫ নভেম্বর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রিসবেন টেস্টে তিনি হ্যাট্রিক এর গৌরব অর্জন করেন। মজার ব্যাপার হলো, ২৫ নভেম্বর তাঁর জন্মদিনও! নিজের জন্মদিনে নিজেকে এর থেকে ভালো উপহার আর কি ই বা হতে পারতো?
লেখক সম্পর্কেঃ ইশফাক জামান। পেশায় প্রকৌশলী, নেশায় কবি ও লেখক। শখ কবিতা লেখা, ফিচার লেখা, অনুবাদ করা। বিভিন্ন অনলাইন (অফলাইন ও) ম্যাগাজিনে লেখালেখি করছি বেশ কয়েক বছর। পেশাগত জীবনে Linde Bangladesh Ltd. এ Territory Manager হিসেবে কর্মরত আছি।
গ্রাফিক্স- মনোয়ার হোসেন রনি, থার্ড ব্র্যাকেট