অনেকদিন পর ফিরে এলাম প্লেন ক্র্যাশ সিরিজ নিয়ে। সিরিজের আজকের আর্টিকেলে বিশ্বের সবথেকে ভয়াবহ পাঁচটি বিমান দুর্ঘটনার ব্যাপারে আমরা জানবো। তবে প্রথমেই জানিয়ে রাখি, ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০০১ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে ঘটে যাওয়া American /United Airlines এর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের হামলাকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের সবথেকে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। তবে এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি থাকায় আমরা এই আর্টিকেলে এই ঘটনাকে বাদ দিয়ে রাখব। তবে সাধারনের জন্য জানিয়ে রাখি, বোস্টনের লোগান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে উড্ডয়নের পর বিমানটিকে হাইজ্যাক করা হয়েছিল। হাইজ্যাকাররা বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দক্ষিণ টাওয়ারে প্রায় ৭৮ তম এবং ৮৪তম ফ্লোরের মধ্যে ঘন্টায় প্রায় ৫৫০ মাইল গতিতে আঘাত হানে। ৫৬ মিনিট পরে ভবনটি সম্পুর্ণ ধ্বসে পড়ে। একই দিনে হাইজ্যাক করা আরো চারটি প্লেনের মধ্যে একটি ছিল একটি। ধারনা করা হয় এই দুর্ঘটনায় মোট প্রায় ২৯০৭ জন মানুষ মারা যান।
১. Pan Am/KLM (B747 / B747) বিমান দুর্ঘটনা – টেনেরিফ, ক্যানারি আইল্যান্ডঃ ১৯৭৭ সালের ২৭শে মার্চ লাস প্যামাস বিমান বন্দরে একটি বোমা হামলার কারণে প্যান অ্যাম ও কেএলএম উভয় উড়োজাহাজকে টেনেরিফে পাঠানো হয়েছিল। এখানে একটি দীর্ঘ বিরতির পরে লাস প্যামাসের আবহাওয়া ঠান্ডা হলে, উভয় বিমানকেই রানওয়েতে আপ ট্র্যাকের নির্দেশ দেওয়া হয়। রানওয়েতে যখন কেএলএম বিমানটি তার টেক-অফ পয়েন্টে পৌছায়, প্যান অ্যাম বিমানটি তখনও রানওয়েতেই ছিল। আসলে প্যান অ্যাম বিমানটি রানওয়েতে কেবলই ট্যাক্সিওয়ের টিকিট পেয়েছিল। আর রানওয়েতেও সেদিন ছিল ভারী কুয়াশা। এদিকে কেএলএম বিমানটি প্যানএম প্লেনের স্ট্যাটাস ছাড়াই টেকঅফ করতে শুরু করে। ATC কন্ট্রোলার এবং প্যান এম পাইলট প্রত্যেকে কেএলএম বিমানকে সতর্ক বার্তা প্রেরন করেন, কিন্তু দুইজনের রেডিও ত্রান্সমিশন একযোগে হবার ফলে কেএলএম কারোটাই শুনতে পারেন নি। কেএলএল বিমানটি টেক অফ করার সাথে সাথেই প্যান অ্যামে সাথে ধাক্কা লাগে। এতে করে উভয় প্লেনেই আগুন ধরে বিস্ফোরিত হয়। কেএলএম এর ২৩৪ যাত্রী ও ১৪ জন ক্রু এবং প্যান অ্যাম এর ৩২৬ জন যাত্রী ও ৯ জন ক্রু’র সবাই নিহত হয়। কেএলএম এর ক্যাপ্টেন ছিলেন তাদের নিরাপত্তার কর্মকর্তা এবং অন্য পাইলটদের একটি সিমুলেটর ব্যবহার করে কয়েক মাস ধরে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন, যেখানে টেকঅফ অনুমোদনের অনুমতি ব্যাপারটি দেওয়া হয়নি। প্যান আম বিমানটিকে ক্লিপার ভিক্টর নামে ডাকা হত। কেএলএম বিমানটি রাইন রিভার নামে পরিচিত ছিল। সব পরিস্থিতিতে সত্ত্বেও কেএলএম বিমানকে NTSB এর অনুমতি ছাড়াই টেক অফ করার জন্য দায়ী করা হয়।
২. Japan Air Lines(B747) বিমান দুর্ঘটনা – মাউন্ট ওসুতাকা, জাপানঃ ১৯৮৫ সালের ১২ই অগাস্ট জাপানী এই বিমানটির ২৩,৯০০ ফিট উচ্চতায় এয়ারপ্রেশার ফেইলিয়র দেখা দেয়। এতে করে বিমানটি সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অবশেষে ৪০ মিনিট পরে পাহাড়ের সাথে সংঘর্ষে পতিত হয়। ১৯৭৮ সালে নির্মিত এই বিমানটির অনুপযুক্ত মেরামত হয়েছিল অনভিজ্ঞ বোয়িং ইঞ্জিনিয়ারদের তত্ত্বাবধানে। আর এটি বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ একক দুর্যোগ। এই দুর্ঘটনায় মোট ৫২০ জন নিহত হন। বিখ্যাত জাপানি গান “সুকাইকী” এর গায়ক ৪৩ বছর বয়সী কিউ সাকামোতো-ও এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন।
৩. Saudi / Kazastan (B747 / IL76) বিমান দুর্ঘটনা – নয়াদিল্লী, ভারতঃ ১৯৯৬ সালের ১২ই নভেম্বর নয়াদিল্লী থেকে ১৭ কিলোমিটার পশ্চিমে মিডএয়ারের এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। দ্য সৌদি বি-747 বিমানটি নয়াদিল্লী বিমানবন্দর থেকে কেবলই উড়ে ১৪০০০ ফুট উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছে। আর অপরদিকে IL-76 এয়ারপোর্টে অবতরণের জন্য নিচের দিকে নামছিল। এই দুর্ঘটনায় বি-747 এ তিনশো বারো এবং IL-76 এ থাকা ৩৭ জনের সবাই মারা যায়। এ দুটি উড়োজাহাজের কোনটিতেই এয়ারবর্ন কলিনেশন অ্যাভয়েডেন্স সিস্টেম ছিল না। 747 টি দিল্লির FL140 নং রানওয়ে ধরে টেক-অফ করে যেই যাত্রাপথে ছিল, ঠিক ওই যাত্রাপথেই IL-76 নিচে নামছিল। যদিও তার জন্য FL150 নং রানওয়ে সাফ করা হয়েছিল। যাইহোক, পাইলট এবং IL-76 এর ককপিট ক্রুদের বেশিরভাগই বিশ্বাস করেন যে প্লেনটি ভুল বোঝাবুঝির কারণে FL140 এর দিকে নিচে নামতে থাকে। ভারতীয় দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে বলে হয়েছিল, ইংরেজিতে কথোপকথনের কার্যকর জ্ঞানহীনতার কারণে পরিস্থিতি সঠিকভাবে বুঝতে অক্ষম অধিকাংশ IL-76 ক্রু’ই এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। এছাড়াও ককপিট রিসোর্স ম্যানেজমেন্টে সীমাবদ্ধতা, ক্যাপ্টেন কর্তৃক সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব, ক্রুদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব এবং অন্য ফ্লাইটের প্রতি বিরূপ মনোভাবকেও এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে।
৪. Turkish Airlines (DC10) বিমান দুর্ঘটনা – বইস ডি’ এরমেনোভিল, ফ্রান্সঃ ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে ৩ তারিখে প্যারিসের অরলির বিমানবন্দর থেকে টেক-অফ করার কিছুক্ষন পরেই তুর্কিশ এয়ারলাইন্সের এই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। FL110 তে করে উড়তে শুরু করা বিমানটিতে হঠাৎ করেই পিছনের কার্গো দরজা ভেঙ্গে যায়। ফলে একটি ডিস্ক্প্রেসশনের ফলে একটি বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণে কেবিনের নিচের অংশ এবং নিয়ন্ত্রণ তারগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে, উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এবং ভয়াবহ গতিতে মাটিতে আছড়ে পড়ে। এই দুর্ঘটনার কারন হিসেবে বলা হয়, সার্ভিস সাবকন্ট্রাক্টর এবং ফ্লাইট প্রকৌশলী লক ম্যাকানিজম সঠিকভাবে চেক করতে অবহেলা করেছিলেন। যদিও এর আগে একটি সার্ভিস বুলেটিনে বলা হয়েছিল যে লকিং পিনটি প্রসারিত করা উচিত, এটি ভুলে এটি ছোট করা হয়েছিল। যার ফলে উচ্চচাপের ফলে ওটা ভেঙ্গে যায়। ১৯৭২ সালের ১২ জুন মিশিগানের ডেট্রয়েট থেকে তৈরী হবার পরই আমেরিকান এয়ারলাইন্সের আরও একটি ডিসি-10 বিমান তার মালবাহী কার্গোটি খুলে গিয়েছিল। যদিও মেইন ইঞ্জিন থ্রাস্ট ব্যবহার করে অভিজ্ঞ একজন পাইলট ওটাকে নিরাপদে মাটিতে নামাতে সক্ষম হয়েছিলেন। দরজার ল্যাচিং ম্যাকানিজমের এই ত্রুটির কারনে তুর্কিশ এয়ারলাইন্সের এই দুর্ঘটনায় প্রান হারান প্রায় ৩৪৬ জন মানুষ।
৫. Air India (B747) বিমান দুর্ঘটনা – আয়ারল্যান্ডের পশ্চিমে আটলান্টিক সাগরঃ ১৯৮৫ সালের ২৩শে জুন এরা ইন্ডিয়ার এই বিমানটি সমুদ্রে বিধ্বস্ত হয়। ফরোয়ার্ড কার্গো হোল্ডে একটি বিস্ফোরক ডিভাইসের বিস্ফোরণ ছিল এই দুর্ঘটনার কারন। কানাডায় ভ্যানকুভারের একদল সন্ত্রাসী, দুটি ফ্লাইটে ব্যাগে করে বোমা নিয়ে যাচ্ছিল। একটি ফ্লাইট-182 তে করে টরন্টোতে যায়। অন্যটি এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটে করে টোকিওতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বোমাটি মাঝ সমুদ্রে বিমানেই বিস্ফোরিত হয়। বিমানটি সম্রাট কনিষ্ক এর নামে নামকরণ করা হয়েছিল। এই দুর্ঘটনায় ৩২৯ জন নিহত হন।