কেউ তার নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যৎবাণী চায় না। যদিও আমরা মানুষজাতি কৌতূহলী জীব, ভবিষ্যৎবাণী করতে ইচ্ছুক। আমরা সবকিছুতেই নিদর্শন এবং তার অর্থ খুঁজি। বিশেষ করে ধ্বংস এবং মৃত্যুর নিদর্শনগুলো কি হতে পারে?
আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে এখনও কিছু সমাজে এই অশুভ লক্ষণগুলো বিশ্বাস করা হয়।
কালো প্রজাপতি
কালো প্রজাপতির প্রতীকী ধারণা এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে পরিবর্তিত হয়। সাধারণত একে মৃতের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। ব্রাজিল, কলম্বিয়া, মধ্য আমেরিকা এমনকি চীনেও কালো প্রজাপতি যদি কোন ঘরে বসে তাহলে ধারণা করা হয় এই ঘরের কোন ব্যক্তি মারা যাবে। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের কোন সদস্য মারা যাওয়ার পরও সেখানে কালো প্রজাপতি আসে। মনে করা হয় কালো প্রজাপতি অসুস্থ মানুষের আত্মা। যখন কোন অসুস্থ লোক মৃত্যুর পর তার নিজের জায়গা চিনতে পারে না, তখন সে কালো প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হয় এবং অনেক সময় যেখানে সে বাস করতো সেখানে ফিরে যায়। অনেক রূপকথায় ডাইনিরা কালো প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হয় যাতে করে তারা সবার অলক্ষ্যে খাদ্য চুরি করতে পারে। ক্যারিবিয়ান জনগণ মনে করে কালো প্রজাপতি হলো ডাইনি যে কিনা অশুভ দৃষ্টি দেয়। মেক্সিকোতে এই প্রজাপতি ‘মৃতের প্রজাপতি’ বলা হয়। তারা বিশ্বাস করে যখন এটি অসুস্থ লোকের বাড়িতে ঢুকে তখন ব্যক্তিটি মারা যায়। দক্ষিণ টেক্সাসে বিশ্বাস করা হয় কোন অসুস্থ লোকের ঘরের চারদিকে প্রজাপতি ঊড়ে তখন মৃত্যু ঘটবে। হাইতিতে যদি প্রিয় কোন মানুষ মারা যায় তাহলে একমাসের মধ্যে ঐ ব্যক্তির আত্মা হয়ে দেখা করতে আসবে কালো প্রজাপতি চিরবিদায় জানাতে।
অভিশপ্ত ধুমকেতু
প্রাচীনকালে মানুষেরা ধূমকেতু পছন্দ করতো না। তারা ভাবতো ধূমকেতু সৃষ্টিকর্তার সংবাদ নিয়ে আসে। তারা তাদের নিজ নিজ চিন্তার ভাবনার আলোকেই এই সংবাদের ব্যাখ্যা করতো। যেমন যদি রাতের আকাশে উজ্জ্বল দীর্ঘ ধূমকেতু দেখা গেলে এর মানে যুদ্ধ ও মৃত্যু অনেকেই আবার এই ধূমকেতুকেই অসুখের কারণ হিসেবে ভাবতো। সুইজারল্যান্ডে হ্যালির ধূমকেতুকে ভূমিকম্প,অসুস্থতা,লাল বৃষ্টি এবং দুই মাথাওয়ালা পশুর জন্মের জন্য জন্য অশুভ প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ইংল্যান্ডে অশুভ মৃত্যুর জন্য ধূমকেতুকে দায়ী করা হতো। গুজব ছড়ায় যে, বহিষ্কৃত পোপ ৩য় ক্যালীক্সটাস হ্যালির ধূমকেতুকে পাঠায় শয়তানের শক্তি হিসেবে। যদিও এসবের কোন সত্যতা নেই তারপরও এখন পর্যন্ত এসব কাহিনী অনেকেই বিশ্বাস করে।
দোর গোড়ায় মৃত্যু
প্রাচীনকালের একটি কুসংস্কার ছিল যখন দরজায় তিনবার টোকা দেওয়া হয় এবং ঐখানে কেউ থাকেনা তখন ঐ বাড়ির কেউ মারা যাবে। আয়ারল্যান্ডে দরজা ও জানলার তিনবার টোকা দেওয়াকে মৃত্যুর অশুভ লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়। স্কটল্যান্ডে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে টোকা দেওয়াকে মৃত্যুর অশুভ সংকেত হিসেবে দেখা হয়। আমেরিকান অনেক উপজাতির মধ্যে ধারণা আছে তারা শুধু আত্মা হয়ে নীরব থাকে তা নয়, আওয়াজ করে বিভিন্নভাবে।ভারত এবং আরব দেশগুলোতেও এসব ধারণা চালু ছিল।আফ্রিকান ঊড়ূবা উপজাতি এই ধরনের টোকা দেওয়ার সংকেতকে অশুভ মনে করতেন।
রঙিন পাথর
অনেক পাথর আছে সেগুলাকে মানুষ তাদের সৌভাগ্যের চিহ্ন বলে থাকে। আবার অনেক পাথর আছে সেগুলাকে মানুষ শয়তানের অন্তর্ভুক্ত মনে করে। উপল এমন একটি উজ্জ্বল পাথর। যাদুকর ও ডাইনিরা একে ব্যাবহার করত জাদুবিদ্যা মধ্যযুগে ইউরোপে উপলকে তারা বর্জন করতো। যারা এটা ব্যাবহার করত তারা পঙ্গু এমনকি মারাও যেত। প্লেগ রোগে যখন বিপুল সংখ্যক লোক মারা গেল তখনো অনেকে এই উপলকে দায়ী করেছিল। তারা লক্ষ্য করেছিল মৃত্যুর আগে পাথরটি উজ্জ্বল হয়ে যেত। যদি সত্যি ঘটনা হল জ্বরের উত্তাপের কারণে এটি পরিবর্তিত হয়য়েছিল। কিন্তু মানুষ তা মানতে নারাজ। তারা ভাবে এই উজ্জ্বল বর্ণিল পাথর অশুভ লক্ষণ যা মৃত্যুকে বয়ে আনে।
মৃত্যুর মুকুট
এপালেশিয়াতে পালকের স্তূপকে মৃত্যুর অশুভ সংকেত হিসাবে দেখা হতো। এগুলো লম্বায় ৩-৫ সেমি আর ১.৫ সেমি পাতলা হয়। তারা একে ‘মৃত্যুর’ মুকুট নামে অভিহিত করে। এগুলা এপেলেশিয়াতে দেখা গেলেও এই কুসংস্কার মিসোরি ও ইন্ডিয়ানোতে আছে। যখন কোন অসুস্থ মানুষের বালিশে এই মুকুট পাওয়া যেত তখন তারা মনে করতো মানুষটি মারা যাবে। আবার মৃত্যুর পর যদি তার বালিশে পাওয়া যেত তাহলে ভাবা হত সে স্বর্গে আছে। বর্তমানে ‘মিউজিয়াম অব এপালেশিয়াতে’ এই পালকের মুকুটের বিশাল সংগ্রহ আছে।
সূর্যগ্রহণ
অতীতে সূর্যগ্রহণকে অলৌকিক বিষয় হিসাবে ভাবা হতো এটিকে অশুভ হিসেবেই ধরা হতো। ভিয়েতনামের লোকেরা বিশ্বাস করতো বড় একটি ব্যাঙ সূর্যকে খেত। প্রাচীন গ্রিসে দেবতারা রেগে গেলে দুর্যোগের লক্ষণ হিসাবে এটি করতো। প্রাচীন চীনে বিশ্বাস করতো স্বর্গের ড্রাগন সূর্যের মধ্যে বসে মধ্যাহ্নভোজন করতো। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে সূর্যগ্রহণকে বলা হত মৃত্যু, ধ্বংস ও যুদ্ধের প্রতীক হিসাবে। অনেক বেদনাদায়ক ঐতিহাসিক ঘটনা সূর্যগ্রহণের সাথে সম্পর্কিত। ৮৪০ সালে মহান শাসক লুইস অফ ব্যাভেরিয়া মারা জান সূর্যগ্রহণ এর সময়। ইংল্যান্ডের রাজা হ্যারির মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয় সূর্যগ্রহণকে।জার্মানিতে ডিউক কর্তৃক অগাসবারগের হত্যাকাণ্ডের জন্য সূর্যগ্রহণকে দায়ী করা হয়।বর্তমান সময়েও পৃথিবীর অনেক অংশেই একে মৃত্যু ও ধ্বংসের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়। অনেক সমাজে ধারণা করা হয় সূর্যগ্রহণের সময় গর্ভবতী মা ও তার সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। ভারতের অনেক অংশে লোকেরা বিশ্বাস করে সূর্যগ্রহণের সময় যা রান্না করা হয় তার সবই বিষাক্ত।
মৃতদেহের উপর অদ্ভুত আলো
কর্পস ক্যান্ডল হল এক ধরনের অলৌকিক আলো মৃতদেহের সাথে বা উপরে দেখা যায় এরকম কল্পিত আলো,যা অভিশপ্ত বলে ধরা হয়। যার আকার লাল,নীল ও হলুদ বলের মত। এই আলো মাটির উপর ভাসতে থাকে এবং এটি ‘ইগনিসফেটুস’ নামে পরিচিত। এদের সাধারনত দেখা যায় জলাভূমিতে।এর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হল জলাভূমির মিথেন গ্যাস এর কারণে এই আলো দেখা যায়। যাহোক প্রাচীন কালে বেশিরভাগ মানুষ এই আলোকে মৃত্যুর প্রতীক হিসাবে দেখতো। এটা বিশ্বাস করা হতো যে এই কারপ্সি ক্যান্ডল এর ধোঁয়া যে ঘরে ঢুকে সে ঘরের লোক মারা যাবে। এই ধোঁয়া যদি কোন নৌকার জেলের উপর দিয়ে যায় তাহলে ঐ জেলে দ্রুত পানিতে ডুবে যাবে। আরও বিশ্বাস করা হতো এই আলো যে দেখবে সে অথবা তার কোন নিকট আত্মীয় মারা যাবে। আয়ারল্যান্ডে বিশ্বাস করা হতো এই আলো অশরীরী আত্মার সাথেও সম্পর্কিত।
লেখিকা সম্পর্কেঃ ফাহমিদা নাসরিন। পেশায় শিক্ষক। ভাল লাগে বই পড়তে আর ঘুরে বেড়াতে।অবসর সময় কাটে ক্রাফটিং করে।