এ লেখার জন্য মডেল হয়েছেন- ফারজানা জামান এমি
চাকরি…..শব্দটা শুনলে অনেকের মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়। মনের ভিতরের স্বপ্নগুলো মাকড়শার জালের মতো জাল বোনা শুরু করে। আবার কেউ কেউ আছেন, এই শব্দটা শোনা মাত্র গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হন। জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষাকে একপাশে সরিয়ে রেখে, একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে থাকেন দূর গন্তব্যে। সেই গন্তব্যের শেষটা অজানা। প্রিয় পাঠক, কথাগুলো হয়তো আপনাদেরই অনেকের সাথে মিলে যাচ্ছে। দুটো কথাই। আনন্দের কথা, সেই সাথে দুঃখেরও। কখনো ভেবে দেখেছেন, জীবনটা কি শুধু “চাকরি হচ্ছে না”, “মামা নাই, চাকরি হবে না” বলে বলেই কাটিয়ে দিয়েছেন? নাকি একটু চেষ্টা করেও দেখেছেন? কখনো ভেবেছেন, আপনারই কোন বন্ধু যেকোন ইন্টারভিউ দিলেই চাকরি পেয়ে যায়। আর আপনার কোনখানেই হয় না। ভাইভায় গিয়ে বাদ পড়ে যান। তাহলে কি ধরেই নিয়েছেন, আপনার সেই বন্ধুটির সব খানেই একজন করে “মামা” ফিট করা আছে?
প্রিয় পাঠক, যদি এ ধারণা নিয়ে বসে থাকেন, তাহলে আপনি ভুলের রাজ্যে বাস করছেন। লিংক-লবিং, মামা-চাচা-খালু যুগে যুগে ছিল। এখনো আছে। হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। কারো কারো হয়তো এভাবে চাকরি হয়েও যাচ্ছে। কিন্তু এটা সবার ক্ষেত্রে সত্যি নয়! আপনার যোগ্যতা, দক্ষতা, সম্যক জ্ঞানকে মূল্য দেওয়ার মতো, গুরুত্ব দেওয়ার মতো অসংখ্য প্রতিষ্ঠানই কিন্তু রয়েছে। যারা আসলেই আপনার যোগ্যতার মূল্যায়ন করবেন। আপনি কার রেফারেন্স এ এসেছেন, দেখবেনও না।
তো, মনে কি প্রশ্ন আসছে না, ঠিক “কি” দেখে একটা বড় কোম্পানী একজন চাকরি প্রার্থীকে “ফেয়ার” রিক্রুটমেন্ট এর মাধ্যমে নিয়োগ দেন? কোন কোন যোগ্যতা, গুণাবলী থাকলে আপনিও আপনার সেই বন্ধুটির মত যেখানেই ভাইভা দিবেন, সেখানেই চাকরি পেয়ে যাবেন?
লিখছি। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুনঃ
১। জানুন
কি জানবেন? প্রথমেই কিন্তু এই প্রশ্ন আপনার মনে আসছে। আপনাকে জানতে হবে এই বিষয়গুলোঃ
*যে কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিবেন, তার খুঁটিনাটি সব কিছু বের করে ফেলবেন। এখন ইন্টারনেটের যুগ। গুগলে একটু ঢুঁ মেরেই দেখুন না! সেই কোম্পানীর ব্যবসা আসলে কিসের, প্রোডাক্ট কি, শুধুমাত্র সার্ভিস প্রোভাইডার কি না জানুন। ওয়েবসাইটটা ভালো করে পড়ুন। কারণ আপনাকে প্রশ্ন করা হতে পারে, আমাদের কোম্পানী সম্বন্ধে আপনি কি জানেন। তখন যদি পটাপট করে সব বলে ফেলতে পারেন, আপনার সম্বন্ধে তাঁদের ভালো একটা ধারণা হয়ে যাবে। তাঁরা ভাববে, আপনি যথেষ্ট আগ্রহী এবং প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন।
২। সঠিক পোশাক নির্বাচন
“আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী”—-এই বাংলা প্রবাদটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। চাকরীর বাজারে এর গুরুত্ব অনেক। আপনি যা ইচ্ছা তাই পড়ে ইন্টারভিউ বোর্ডে চলে যেতে পারেন না। আপনার পোশাক নির্ভর করবে আপনি ঠিক ‘কি’ ধরণের চাকুরীর জন্য ভাইভা দিতে যাচ্ছেন, তার উপর। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আপনি যদি সেলস প্রফেশনাল কিংবা অন্যান্য বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ডের চাকরীর জন্য ভাইভা দিতে যান, আপনাকে একটু বেশিই “ধারালো” হয়ে ইন্টারভিউ বোর্ডে ঢুকতে হবে। সেটা কিরকম? আপনার শার্ট, প্যান্ট, জুতো হতে হবে আকর্ষণীয়। বিশেষ করে জুতোর বিষয়টা আমরা অনেকেই গুরুত্ব দেই না। ভাবি, ওইটা আর কে দেখবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সবার দৃষ্টি সবার আগে পায়ের দিকেই যায়। কাজেই খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্মার্ট গেটআপ নিয়ে যদি ছেঁড়া অথবা ময়লা একটা জুতো পরে হুরমুর করে বোর্ডে ঢুকে যান, কোন লাভ হবে না। একটা টাই অবশ্যই পরবেন। তাহলে ভালো দেখাবে। আর যদি টেকনিক্যাল কোন পদের জন্য ভাইভা দিতে যান, যেমনঃ পাওয়ার প্ল্যান্ট এ অথবা মেশিন মেইন্টেন্যান্স সংক্রান্ত, খুব বেশি চোখে লাগার মতো কোন পোশাক না পরাই ভালো। এ ধরণের ইন্টারভিউ এর জন্য সবচেয়ে ভালো পোশাক হচ্ছে ধবধবে সাদা শার্ট এবং কালো ফরমাল প্যান্ট। জুতা অবশ্যই চকচকে হতে হবে যেকোন সময়ের মতোই। এখানে খুব বেশি ফ্যাশনেবল পোশাক পরতে নিরুৎসাহিত করছি এইজন্য, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান ভাবতে পারে আপনি ফ্যাক্টরির চার দেয়ালে বন্দী থেকে আদৌ কাজ করবেন কিনা! তাঁদের দরকার কর্মঠ, চৌকস লোক। দেখনদারী স্মার্ট অথবা ফ্যাশনেবল কেউ নয়। আর একটা কথা মাথায় রাখবেন। জিন্স এর অথবা মোবাইল প্যান্ট কখনো পরবেন না।
মোট কথা, কাজের ধরণ বুঝে পোশাক নির্বাচন করতে হবে।
৩। প্রস্তুতি নিন
ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার আগে পোশাকের পাশাপাশি আরো দুটি প্রস্তুতি খুব জরুরী। সেগুলো হলো- মানসিক প্রস্তুতি এবং বৈষয়িক প্রস্তুতি। অনেকে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার আগে ঘাবড়ে যান। ভাবেন, ঠিকমত দিতে পারবো তো? অথবা এই চাকরী আমার হবে তো? মাথায় রাখবেন, রিজিকের মালিক উপরওয়ালা। তিনি যদি চান, চাকরী আপনার হবেই। না চাইলে হবে না। কাজেই এই চিন্তা তাঁকেই করতে দিন না! আপনি শুধু বোর্ডে আপনার “নিজেকে” প্রকাশ করুন পরিশীলিতভাবে, আত্মবিশ্বাসের সাথে। অবশ্যই কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর, যেমন- নিজের সম্বন্ধে বলা, নিজের শক্তিশালী এবং দুর্বল দিক ইত্যাদি অতি-অবশ্যই গুছিয়ে রাখবেন। যাতে জিজ্ঞাসা করলেই আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিতে পারেন। সেই সাথে আপনি যে বিষয়ের উপর স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন, সেগুলোর কিছু সাধারণ বেসিক প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই জেনে রাখবেন। যেকোন মুহূর্তে এসব আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হতে পারে।
৪। সঠিক সময়ে যান
অনেকে আছেন, সব সময় সব কাজ শেষ মুহূর্তে করে অভ্যস্ত। আল্লাহর ওয়াস্তে এইবেলা সময় সচেতন হোন! না হলে চাকরী পাবেন না। কমপক্ষে ৩০ মিনিট আগে গিয়ে উপস্থিত হোন। যাতে আপনি পৌঁছে কিছুটা সময় জিরিয়ে নিতে পারেন। এর দরকার আছে। অফিসের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোরও একটা ব্যাপার থাকে। আপনার বাসা থেকে সেই অফিসের দূরত্ব, পরিবহন এবং যানজটের কথা মাথায় রেখে সেইভাবেই সময় ব্যবস্থাপনা করুন ।
৫। শুনুন
ইন্টারভিউ এ প্রশ্নকর্তা আপনাকে ঠিক কি জিজ্ঞাসা করছেন, আগে কান খুলে ভালো করে শুনুন। তারপর উত্তর দিন। অনেকে আছেন, প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করার মাঝখানেই হড়বড় করে উত্তর দেওয়া শুরু করেন। আর মনে মনে ভাবেন, যেভাবে উত্তর দিলাম তাতে চাকরী কে ঠেকায়? লেবু বেশি চিপলে যেমন তিতা হয়ে যায়, এটাও ঠিক এমনি। আগে শুনুন মন দিয়ে, তারপর মনে মনে উত্তর গুছিয়ে সুন্দরভাবে বলুন। উত্তর না পারলে তর্কে যাবেন না। ভদ্রভাবে বলে দিন যে এই প্রশ্নের উত্তর আপনার জানা নেই। কোন অসুবিধা নেই। সব প্রশ্নের উত্তর সবাই জানবেই এমন কোন কথা নেই। কিন্তু যেটা জানেন না, সেটা নিয়ে ত্যানা পেঁচাতে যাবেন না। চাকরী হবে না।
৬। উদাহরণ দিন
যেকোন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময়ই যদি সম্ভব হয়, উপযুক্ত উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিন। ম্যাজিকের মতো কাজ হবে। ইন্টারভিউ বোর্ডে যারা আছেন, তাঁরা বুঝে নেবেন যে আপনি অনেক বেশি ব্যাবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে জানেন। এতে আপনার চাকরীটি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে বহুগুণ।
৭। প্রশ্ন করুন
আপনাকে তাঁদের প্রশ্ন করা শেষ। ঠিক এর পর পরই অনেক কোম্পানী আছে, যারা আপনার কাছ থেকেও প্রশ্ন শুনতে চান। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশ্ন করবেন। তবে সেই প্রশ্নগুলো হতে হবে এমন যে তাঁরা বুঝতে পারেন যে আপনি ওখানে চাকরী করতে কতটা আগ্রহী। ভুলেও জিজ্ঞাসা করতে যাবেন না, স্যালারি কত হবে। তাহলে চাকরীটি পেয়েও হারাবেন।
লেখক সম্পর্কেঃ ইশফাক জামান। পেশায় প্রকৌশলী, নেশায় কবি ও লেখক। শখ কবিতা লেখা, ফিচার লেখা, অনুবাদ করা। বিভিন্ন অনলাইন (অফলাইন ও) ম্যাগাজিনে লেখালেখি করছি বেশ কয়েক বছর। পেশাগত জীবনে Linde Bangladesh Ltd. এ Territory Manager হিসেবে কর্মরত আছি।