পৃথিবী গোল- এ কথা ছোট বেলায় শুনে আমাদের খুব অবাক লাগতো না? কারণ আমরাআ দেখি পৃথিবী সমান বা চ্যাপ্টা। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, পৃথিবী গোল। তবুও বহু মানুষ আছে যারা এটা মানে না।
১। “পৃথিবী সমান নাকি গোল” বিতর্ক ও একজন পাদ্রীর কান্ড
একজন ৫৬ বছর বয়সী খ্রিষ্টান পাদ্রি কে তার অসদাচরণের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল যিনি ক্যাম্পফায়ার এ বিভিন্ন জিনিসপত্র ছুঁড়ে মেরেছিলেন , যার মধ্যে প্রোপেন সিলিন্ডার ও অন্তর্ভূক্ত ছিল। এর কারণ , তিনি পৃথিবী গোল নাকি সমান্তরাল, এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্কতে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং একটা সময় ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তিনি এ কাজ করেছেন । পরবর্তীতে বিষয়টি এতটাই আয়ত্বের বাইরে চলে যায় যে শেষ পর্যন্ত ফায়ার ক্রু’দের কে ডাকতে হয়েছিল তার কারণে সৃষ্ট অগ্নি নির্বাপনের জন্য ।
পুলিশ প্রশাসন বলেছে, ঘটনার সময় তিনি, তার ছেলে ও তার ছেলের প্রেমিকা একসঙ্গে ক্যাম্পিং সাইট এ ছিলেন এবং ঘটনাস্থলে একজন মহিলা দাবী করে বসেন যে, পৃথিবী সমান্তরাল! সেই মুহুর্তে তিনি মহিলাটিকে বেশ জোর দিয়ে বুঝাতে লাগলেন যে তার দাবী করা তত্ত্বটি ভূল এবং বিষয়টি বুঝাতে গিয়ে তিনি মাত্রাতিরিক্ত ক্রোধের বশবর্তী হয়ে পড়েন এবং ক্যাম্পিং এর সরঞ্জাম আগুনে ছুঁড়ে মারতে শুরু করেন । পুলিশ অবশ্য লোকটিকে গ্রেপ্তার করলেও তার “পৃথিবী সমান্তরাল নয়” এ বিতর্কের সাথে একমত পোষন করেন ।
২। “পৃথিবী গোলাকার” তত্ত্বের প্রমাণের জন্য যে যাজক প্রকাশ্যে ৫০০০ ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করেছিলেন
উইলবুর গ্লেন ভলিভা নামক একজন যাজক ছিলেন, যিনি জিওন এ অবস্থিত ৬০০০ সদস্যবিশিষ্ট “Christian Catholic Apostolic Church” নামক একটি গির্জার পরিচালক ছিলেন এবং ১৯ শতকের সময়ের একজন যোদ্ধা ছিলেন, তিনি “পৃথিবী সমান্তরাল” তত্ত্বের বিশ্বাসী হিসেবে ব্যাপক দূর্নাম কুড়িয়েছিলেন । যে তার এই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করতে পারবে, তার জন্য তিনি ৫০০০ ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করেছিলেন। এমনকি ভলিভা অনেকগুলো অনুমান করেছিলেন যে, পৃথিবী নাকি ধ্বংস হবে ১৯২৩ সালে, কিংবা ১৯২৭ বা ১৯৩০ বা ১৯৩৪ বা ১৯৩৫ সালে যার বাস্তবতা আমাদের চোখের সামনে – এখন ২০১৬ সাল এবং পৃথিবী এখনো টিকে আছে ।
৩। সোশ্যাল মিডিয়ার তারকা যিনি মনে করেন পৃথিবী গোলাকার নয়
২০১৬ সালের জানুয়ারীতে, টিলা টাকিলা নামক একজন সামাজিক মাধ্যম তারকা ও অদ্ভুত-বিচিত্র মতবাদী, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটারে পৃথিবী সমান্তরাল কেন এ বিষয়ক কিছু মন্তব্য করে ব্যপক সমালোচনার ঝড়ের সৃষ্টি করেন। তার করা টুইটের কিছু অংশ-
এখন ২০১৬ সাল এবং এখন পর্যন্ত কেউ এসে আমাকে প্রমাণ করে দেখাতে পারে নি যে পৃথিবী গোল।
৪। যার বিশ্বাস ছিল রকেট অবতরণের কথা বলা ভাঁওতাবাজি
একজন “পৃথিবী সমান্তরাল তত্ত্ব” বিশ্বাসী RussianVids নামক ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রতি একটি ভিডিও প্রকাশিত হয় এবং ভিডিওটি ১ মিলিয়ন বারের উপরে দেখা হয় এবং সেখানে এমন একটি বিষয়ের বিতর্কের সৃষ্টি হয় যা অনেক আগেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে গেছে । চ্যানেলটি , সম্প্রতিকালে অবতরণ হওয়া SpaceX নামক রকেটের অবতরণের দৃশ্য সংগ্রহ করে এবং দৃশ্যের ভিডিওটির প্রতি সেকেন্ড অত্যাধিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে দাবী করে ফুটেজটি সম্পূর্নরূপে ভূয়া ও বানোয়াট। তিনি দাবি করেন হাজারো রাজনিতিবিদ, বিজ্ঞানী, বিমান-চালক এবং নাবিক তার সাথে একমত পোষণ করে এ বিষয়টিকে “প্রকান্ড মিথ্যা” বলে অবিহিত করেছেন । তিনি এ বিষয়টিকে “ Ball Earth Conspiracy” বা “ গোলাকার পৃথিবী বিষয়ক চক্রান্ত” বলে আখ্যায়িত করেছেন। “প্রকান্ড মিথ্যা” বিষয়টির বরাত দিয়ে তিনি হিসেব করে বের করেছেন যে রকেট্টি অবতরণ ও অবতরণ পরবর্তী দৃশ্যের বিষয়টি আয়না ও ধোঁয়ার কারসাজি ছাড়া আর কিছুই না। তিনি তার ভিডিও তে বলেছেন, “ আমি বুঝতে পারছি যে মানুষ বিশ্বাস করতে চায় যে পৃথিবী গোলাকার” । … যা অবাস্তব ।
৫। বিশ্বাস যখন পর্যবেক্ষণে বদলে যায়
১৯০০ সালে Trasvaal Republic এর প্রেসিডেন্ট ও একজন “পৃথিবী সমান্তরাল তত্ত্ব বিশ্বাসী” , পল ক্রুগার, দ্বীপান্তরিত হবার পর একটি ওলন্দাজীয় যুদ্ধ-জাহাজে ভ্রমন করছিলেন এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন তাকে সে সময় নৌচালনার প্রক্রিয়া দেখবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । Dutch Reformed Church এর একজন অন্ধবিশ্বাসী হিসেবে তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন , পৃথিবীর প্রতিটি স্তম্ভ এবং কোণা সমান্তরাল, তথা পৃথিবী সমান্তরাল । কিন্তু তার এই বিশ্বাস একটা সময় নড়বড়ে হয়ে যায় যখন তিনি জানতে পারেন , জাহাজটির চালনাকার্য পৃথিবী গোলাকার হবার বিষয়ের উপর ভিত্তি করে । সেকসট্যান্ট ও অন্যান্য যন্ত্র পর্যবেক্ষণের পর তিনি তার বাইবেলটি সমুদ্রের মাঝে ছুড়ে ফেলে দেন । তিনি তারপর বলে, যদি পৃথিবী গোলাকার হয়ে থাকে, তাহলে এই ধর্মগ্রন্থ মিথ্যা এবং এগুলোর প্রতি তার আর কোন কৌতুহল নেই।
৬। সেই সংগঠন যারা এখনো বিশ্বাস করে পৃথিবী সমান্তরালঃ
স্যামুয়েল সেনটন নামক এক ইংরেজ ব্যাক্তি ১৯৫৬ সালে International Flat Earth Research Society বা Flat Earth Society নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন । শেলটোনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল শিশুদের কাছে “পৃথিবী গোলাকার” তত্ত্বটি পৌঁছাবার আগে তার সংগঠনের তত্ত্বটি যেন পৌছায় ও তা যেন সমাদৃত ও প্রচলিত হয় । তিনি একটা সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তাও লাভ করেছিল , কিন্তু তার এই বিজ্ঞান বিরোধী তত্ত্ব একটা সময় ব্যাপকহারে হারিয়ে যেতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে, তার মৃত্যুর পরে, ক্যালিফোর্নিয়ার একজন সমান্তরাল তত্ত্ব প্রবক্তা, চার্লস কে জনসন, তার জায়গায় নিযুক্ত হন এবং তিনি ধীরস্থিরভাবে সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ৩০০০ এর উপর নিতে সক্ষম হন । সমান্তরাল পৃথিবী তত্ত্বের বিরুদ্ধে করা চক্রান্তের বিপরীতে প্রমাণ পেশ করার জন্য সুদীর্ঘ এক বছরের মত সময়কাল ধরে তিনি সমান্তরাল ও গোলাকার পৃথিবী উভয় তত্ত্ব পরীক্ষা করেন, “ যদি এটা গোল হয়, সঞ্চিত পানির পৃষ্ঠতল অবশ্যই অসমতল হবে।” জনসন’রা Lake Tahoe এবং Salton Sea এর পৃষ্ঠতল পরীক্ষা করেছে যার বক্রতা নেই অর্থাৎ পৃথিবী সমতল”। ১৯৯০ এর দিকের সমাজগোষ্ঠী এই বিষয়টির কঠোর বিরোধীতা পোষণ করে সংগঠনটির মূল ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং ২০০১ সালে জনসন মারা যান । ২০০৪ সাল পর্যন্তও বিষয়টি ড্যানিয়েল শেনটন এর নামে পুনর্জীবিত করা হতো, যে কিনা বিশ্বাস করত পৃথিবী গোল এ তত্ত্বের কোন প্রমাণ নেই।
৭। র্যাপার বনাম জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানী
২০১৬ সালের শুরুর দিকে বিশিষ্ট জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী নীল ডি’গ্রাসসি টাইসন ও র্যাপার বি.ও.বি. , সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে একে অন্যের সাথে প্রবল তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন সমান্তরাল-পৃথিবী তত্ত্ব নিয়ে । “Airplanes” , “Nothin’ On You’ এবং “Strange Clouds” খ্যাত শিল্পী B.O.B বলেন,
I’m going up against the greatest liars in history … you’ve been tremendously deceived
পরমুহুর্তে টাইসনের উত্তর ছিল এমন
Earth’s curve indeed blocks 150 (not 170) ft of Manhattan. But most buildings in midtown are waaay taller than that.
Polaris is gone by 1.5 deg S. Latitude. You’ve never been south of Earth’s Equator, or if so, you’ve never looked up.
Flat Earth is a problem only when people in charge think that way. No law stops you from regressively basking in it.
বি.ও.বি. এর জবাবে “Flatline” নামক একটি গান রচনা করেন যা তার তত্ত্বকে আরো সম্প্রসারিত করে। তিনি তার গানটিতে টাইসন এবং ডেভিড ইরভিং নামক একজন প্রখ্যাত “হলোকাস্ট” অস্বীকারকারীর নাম অন্তর্ভূক্ত করেন । কালক্ষেপন না করে টাইসন “Flat To Fact” নামক একটি গান প্রকাশ করেন যা তার ভাতিজা স্টিফেন টাইসন রচনা করেছেন ও তা র্যাoপ সংগীতে গেয়েছেন ।
৮। সন্ত্রাসবাদী সংস্থা যারা সেইসব শিক্ষকদের লক্ষ্যবস্তুতে রুপান্তরিত করছে যারা তাদের সমান্তরাল পৃথিবী তত্ত্বের বিরোধী
Boko Haram ( বকো হারাম) নামক নকল ইসলামিক চরমপন্থীগোষ্ঠী তাদের সন্ত্রাসীমূলক অভিযান হিসেবে নাইজেরিয়ার পশ্চিমা শিক্ষার আওতাভূক্ত শিক্ষকের উপর আলদা নজরদারী রাখছে। কারণ? শিক্ষকদের পাঠদান নিয়ে তাদের সংস্থার অভিমত , পৃথিবী সমান্তরাল এবং বৃষ্টিপাত বিশ্ববিধাতার কারণে হয় , বাষ্পীভবনের কারণে নয় – এই তত্ত্ব দুটির বিরুদ্ধে যাচ্ছে। বোকো হারাম গোষ্ঠিটির “হিটলিস্টে” নাইজেরিয়ার প্রশাসনিক নেতাবৃন্দ এবং প্রবীন নেতামন্ডলীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও ক্রমানুসারে সাজানো আছে। বোকো হারাম ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৬০০ স্কুল কর্মীদের হত্যা করেছে এবং ১৯ হাজার কর্মী তাদের এই হুমকি ও আক্রমণের ভয়ে চাকরী ছেড়ে দিয়েছে ।
লেখকঃ রিয়াসাদ জাহান রিমন। শখ বলতে বই পড়া, ছবি তোলা, লেখালেখি – এই তিনেই সীমাবদ্ধ। পেশায় ফ্রিল্যান্সার, বর্তমানে বিবিএ নিয়ে পড়াশুনা করছি।