আজ বাংলানিউজ২৪.কম এর একটি সংবাদের শিরোনাম দেখে চোখ আটকে গেল, মন খারাপ হয়ে গেল। চাকরি না পেয়ে সুইসাইড নোট লিখে যুবকের আত্মহত্যা! ছেলেটির নাম সৈকত রঞ্জন মন্ডল। তিনি ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজির ছাত্র ছিলেন।
সৈকতের বাবার নাম কৃষ্ণ মন্ডল, মায়ের নাম রানী মন্ডল। গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার রমজান নগর ইউনিয়নে।
ডায়েরির সুইসাইড নোট থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আরো দু’বছর আগে পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করলেও চাকরি না পাওয়ার হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করেছেন সৈকত। তার রুমে বিসিএস প্রস্তুতির বিভিন্ন বই পাওয়া গেছে।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানা যায়, সৈকত দু’বার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে পাওয়া প্রেসক্রিপশন থেকে জানা যায়, সম্প্রতি হতাশা থেকে বাঁচতে ডাক্তারের শরণাপন্নও হয়েছিলেন।
সম্প্রতি সৈকত নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরিতে হতাশার কথা লেখা শুরু করেন। তার রুম থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরির একটি পাতায় লেখা রয়েছে- ‘অনেক স্বপ্ন ছিল চাকরি করবো, মার মুখে হাসি ফোটাবো। কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেলো। মার শরীর খুব খারাপ। তবুও আমি খুলনা থেকে পড়ার কথা ভাবছি। বাড়িতে যেতে গেলে সবকিছু নিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই। না আছে টিউশনি, যার উপর নির্ভর করে খুলনায় চলছিলাম। কোনো চাকরিতেও ভয় পাচ্ছি। আজ এতো কঠিন অবস্থা তৈরি হয়ে গেলো। আমি শুধু বন্ধুদের কে কি করছে সেই দিকে খেয়াল করে চলছি। আমরা এক মেসে চার বন্ধু থাকতাম। এর মধ্যে আমার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেছে। অন্য তিনজন চাকরি পেয়েছে। আসলে প্রত্যেকটি কাজ করতে করতে সেটা ছেড়ে দিয়ে BCS এর দিকে যাওয়ায় হঠাৎ চাপ বেড়ে যায়। সে জন্য আমি আরও Abnormal Behaviour প্রদর্শন করছি। প্রজেক্টের কাজে চাপ থাকায় শরীরটা গড়তে পারিনি। সে জন্য অতিরিক্ত চাপ সহ্য হয়নি।’
এ মৃত্যুর দায় কার? বিসিএস কিংবা সরকারি চাকরি নিয়ে এই উন্মাদনা কেন? এর শেষ কোথায়?
বিসিএস নিয়ে এই উন্মাদনার শুরুটা খুব বেশিদিন আগে নয়। ২০১০-১১ এর দিকে ফেসবুকে ২-১ জন ব্যক্তি বিসিএস বা সরকারি চাকরির পড়াশোনা নিয়ে লেখা শুরু করেন, খোলা হয় বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে পড়াশোনার এ ট্রেন্ড চালু হওয়াটা ইতিবাচকভাবেই দেখছিল সবাই। অনেকের পক্ষেই উচ্চ মূল্যের গাইড কিনে চাকরির পড়াশোনা করা সম্ভব ছিল না। তাই বিসিএসকেন্দ্রিক ফেসবুক গ্রুপগুলো পড়াশোনার বেশ দারুণ একটা জায়গা ছিল অনেকের কাছেই।
সমস্যাটা শুরু হয় অন্য জায়গায়। ফেসবুকমূলত লাইক-ভিত্তিক একটি প্ল্যাটফর্ম। যত বেশি আমরা লাইক পাই, তত বেশি আমাদের ভাল লাগে। সোশ্যাল মিডিয়া এভাবে একটা “অস্থায়ী আনন্দ” পাওয়ার অনুভূতি আমাদের ব্রেইনে তৈরি করে এ লাইক পাবার মাধ্যমে। ফেসবুক ব্যবহারকারী সবাই কম-বেশি এ লাইক পাওয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও কিছু ক্যারিয়ার বিশেষজ্ঞ তাদের ব্যক্তিগত লাইক পাবার আকাঙ্খাকে মোটিভেশনের মোড়কে দুর্দান্ত লেখনী নিয়ে আবির্ভুত হলেন ফেসবুকে। তাদের সরকারি চাকরি পাবার আগের ও প্রাপ্তির মূহুর্তগুলোকে রীতিমত ফ্যান্টাসির পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। মানুষ মোটিভেটেড বা উৎসাহিত হতে পছন্দ করে, কেউ আশার কথা শোনালে তার ভাল লাগে। ফলে, সবাই হন্যে হয়ে ছুটলো বিসিএস এর দিকে। সায়েন্স, কমার্স, আর্টস- সেই দৌঁড়ে শামিল হলো সবাই।
এদিকে হুট করে সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধা এক লাফে দ্বিগুণ হলো, বেসরকারি চাকরিজীবিরা রইলো আগের জায়গাতেই। ক্যারিয়ার সেলিব্রিটিরা আমাদের বোঝালেন, “তুমি সফল হবেই, যদি তুমি চেষ্টা কর।” তাদের মতে সফলতার সংজ্ঞা হচ্ছে, সরকারি চাকরি, বিশেষভাবে বিসিএস এর বৈতরণী পার হওয়া। কিন্তু যুক্তির বিচারে বা বাস্তবতার খাতিরে এটা সম্ভব নয়। কারণ, তাদের কথায় “মোটিভেটেড” হয়ে লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে মাত্র কয়েক হাজার সরকারি চাকরির পদের জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ফলাফল, বাস্তবিকভাবেই সবার জায়গা সেই সোনার তরীতে হয় না।। তারা চেষ্টা করে যেতেই থাকে, যেতেই থাকে, এক সময় সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সও পার হয়ে যায়।
এদিকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার ৪-৫ বছর তাদের পক্ষে অন্য কোন বেসরকারি চাকরিতে আবেদন করাও কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, তাদের সরকারি চাকরির জন্য যে পড়াটা সেটা আবার বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য খুব একটা দরকার হয় না। সেই জগৎটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এদিকে ফেসবুকের এক ভার্চুয়াল জগত, যেখানে আমরা শুধু আমাদের আনন্দ ও সাফল্য শেয়ার করি, দুঃখ নয়- সেটা দেখে আমরা নিজেরাই অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করতে থাকি। ফলে, হতাশা বাড়তে থাকে।
এই ৩০ বছর স্পর্শ করে ছেলে-মেয়েগুলো তখন কোথায় যাবে? কে তাদের মোটিভেশন দেবে? তারা তো পরাজিতদের দলে, কারণ, ক্যারিয়ার সেলিব্রিটিদের দেখানো পথে তারা জয়ী হতে পারে নি। আর পরাজিতদের গল্প শোনার কেউ নেই।
ফলাফল? সৈকত আত্মহত্যা করে, আর যারা পারে না, তারা নিজেদের ব্যর্থ ভেবে জীবন পার করে দেয়। অথচ হয়তো তারা অন্য কিছু হতে পারতো। শিক্ষক, বিজ্ঞানী, গবেষক, উদ্যোক্তা, শিল্পী, লেখ্ক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ- আরো কত কিছু!
তা হয় না। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সেই বাঁশির পেছনে ছুটে চলা ছেলে-মেয়ে আমরা, যারা একদিন নিজেদের হারিয়ে ফেলবো! যেভাবে সৈকত হারিয়ে গেছে!