নাগরিক জীবনে ব্যস্ততার সাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বই পড়ার অভ্যাস। বইয়ের দোকানকে হটিয়ে দিয়েছে খাবারের দোকান, সিনেমা হল অথবা জামা-কাপড়ের দোকান। ছাপা কারখানা বন্ধ হচ্ছে এক এক করে। সফটকপি পড়ার অভ্যাস সাহিত্যসংশ্লিষ্ট বইয়ের দোকানগুলোকে পুরোপুরি বিলপ্ত করে দিচ্ছে।
তারপরেও বইপ্রেমীদের তীর্থস্থান হয়ে বেশকিছু বইয়ের দোকান এখনও টিকে আছে। চলুন ঘুরে আসি তাকে তাকে সাজিয়ে রাখা সেইসব বইয়ের জগত থেকে।
১। চার্চ যখন বইঘর (হল্যান্ড)
বিখ্যাত ডাচ বইয়ের চেইনশপ Selexyz তাদের একটি শাখা তৈরি করেছে ১৩ শতকের ডমিনিকান চার্চের ভেতরে। হল্যান্ডে অবস্থিত এই চার্চটির ভেতরকার ডিজাইন, ফ্রেস্কো, কারুকাজ – কোনকিছু পরিবর্তন না করেই এর ভেতরে বইয়ের দোকানটি বানানো হয়েছে। ছোট পরিসরে একটা খাবারের দোকানও আছে একটি।
ভিতরের কোন কিছু পরিবর্তন করার উপায় ছিলো না। তাই উপরের দিকে বইয়ের তাকের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করে মেঝে ঢেকে দেওয়া হয়েছে দামী কার্পেটে, যেন কোন অযাচিত শব্দ গুরুগম্ভীর পরিবেশকে ব্যাহত না করে।
২। এল এন্টিনিউ গ্র্যান্ড স্পেনডিড (আর্জেন্টিনা)
ওয়ার্ল্ড সিটিস কালচার ফোরামের সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় আর্জেন্টিনার বিশাল কসমোপলিটন ক্যাপিটাল বুয়েনোস আইরেসে লাইব্রেরির সংখ্যা বেশী। হ্যাঁ, ম্যারাডোনা-মেসির দেশের মানুষ শুধু ফুটবল নিয়েই মেতে থাকে না, বইও পড়ে। আর তারা নিজেদের শতবর্ষী থিয়েটার হলকে বানিয়েছে বইয়ের দোকান।
একশ বছরের পুরনো সুবিশাল এল এন্টিনিউ গ্র্যান্ড স্পেনডিড থিয়েটার হল এখন একটি বইয়ের দোকান। থিয়েটার বক্সগুলোকে বানানো হয়েছে পড়ার ঘর। আর কোন টিকেট না কেটেই দর্শনার্থীরা ঘুরে জেতে পারেন মনোমুগ্ধকর এই স্থাপনা।
৩। লাইব্রেরিয়া অ্যাকুয়া আল্ট্রা (ভেনিস, ইটালি)
স্যাঁতস্যাঁতে কোন ঘর কি সুন্দর বইঘর হতে পারে? হতে পাএর, যদি সেটা ভেনিসের “লাইব্রেরিয়া অ্যাকুয়া আল্ট্রা” হয়। পুরনো নোনা ধরা দেওয়াল ঘেরা এই জায়গাতে লুকিয়ে আছে বইপ্রেমীদের গুপ্তধন – নানা স্বাদের, না বর্ণের বই।
চকচকে আসবাবকে দোকানে বেশী ঠাই দেওয়া হয় নি। সাধাসিধে কাঠের তাক, মেঝে, এমনকি নৌকাতে স্তুপ করে রাখা হয়েছে বই।
দরজার ভেতরে জ্ঞানের ভান্ডার, আর বাইরে ভেনিসের অনিন্দ্য সুন্দর পানির জগত। দুই আলাদা সৌন্দর্যের মিশেলে এই লাইব্রেরিয়া অ্যাকুয়া আল্ট্রা।
৪। দ্য লাস্ট বুক স্টোর (লস অ্যাঞ্জেলস, আ্মেরিকা)
২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করা এই বইয়ের দোকানের মালিক বুঝতে পেরেছিলেন যে বই ব্যবসা এখন এক ক্রান্তিকাল পার করছে। তাই দোকানের নামের মধ্যেই তিনি সেটি বলে দিয়েছেন। তবে “দ্য লাস্ট বুক স্টোর” নিজের অগ্রযাত্রা থামিয়ে রাখে নি, বরং এগিয়ে গেছে।
পুরনো একটি ব্যাংক ভবনের বিশাল পরিসরে নিজেকে সাজিয়েছে ২০০৯ সালে। পুরো ভবনটি ১৯১৪ সালে বানানো, তাই পুরনো আমেজ এখনও আছে।
এই দোকানের বৈচিত্র্য হলো, একেক বিষয়ের বই এর জন্য রয়েছে আলাদা জায়গা। আর প্রতিটা জায়গা সেই বিষয় সংক্রান্ত থীমে সাজানো। যেমন, ক্রাইম থ্রিলার আর রহস্য সংক্রান্ত বই রাখা আছে প্রাক্তন ব্যাংকের ভল্টে। স্থানীয় শিল্পীদের বিভিন্ন চিত্রকর্মও এই দোকানে রাখা হয় প্রদর্শনীর জন্য।
৫। প্যওয়েল বুক স্টোর (পোর্টল্যান্ড, আ্মেরিকা)
মানুষ যে এখনও বইয়ের প্রতি ভালোবাসা রাখে, এই দোকান হলো তার একটি প্রমান। বিশাল পরিসরে গড়ে উঠা এই প্যওয়েল বুক স্টোর এতটাই বড় যে আলাদা ম্যাপ ব্যবহার করে হয় আগত পাঠকদের।
দর্শনার্থীদের জন্য বিমানবন্দর এর আদলে ডিরেক্টরি বোর্ড বসানো হয়েছে। কোথায় কোন বই আছে, সেটা দেখানোর জন্য রয়েছে পথ নির্দেশক চিহ্ন। নতুন, পুরনো, হার্ডকভার, পেপারব্যাক – সব রকমের বই এখানে পাওয়া যায়। আর বইয়ের ধরন অনুযায়ী রয়েছে আলাদা রং করা ঘর।
প্রতিদিন এখানে আসে প্রায় ৮০০০ জন বইপ্রেমী। আর ক্লান্ত পাঠকদের জন্য রয়েছে একটি কফি
৬। জন কে কিং বুকস (ডেট্রয়েট, আ্মেরিকা)
যে কোন ভালো বইয়ের প্রথম সংস্করণ পাওয়া পাঠকের জন্য খুব আনন্দের ব্যপার। আর “জন কে কিং বুকস” এই বিষয়ে অনন্য। বিভিন্ন বিখ্যাত এবং পুরনো বইয়ের প্রথম সংস্করণ পাওয়া যায় এই দোকানে। আছে অনেক কিংবদন্তীর অটোগ্রাফ সম্বলিত বই। কিছু দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপি আর সাহিত্য সংক্রান্ত জিনিস রয়েছে প্রদর্শনীর জন্য।
১৯৭১ সালে শুরু হওয়া এই দোকানের বর্তমানে তিনটি শাখা রয়েছে। আর রয়েছে প্রায় দশ লক্ষ বইয়ের ভান্ডার।
৭। শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি (প্যারিস, ফ্রান্স)
প্যারিসের ওপর দিয়ে যত দূর পর্যন্ত স্যান নদী বয়ে চলেছে তত দূর পর্যন্ত নদীর পাড়ে রয়েছে ঐতিহাসিক নিদর্শন। এর মধ্যে বইয়ের এক অন্যরকম দোকান শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি অন্যতম। শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানিকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বইয়ের দোকান।
এই বইয়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে আর ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে অনেকেই খ্যাতি পেয়েছেন বিশ্ব জুড়ে। প্রকাশক যাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলো একসময়, এই বইয়ের দোকানের আড্ডা তাদের টেনে নিয়েছে আপন করে। এর মধ্যে অ্যাজরা পাউন্ড, গ্যারট্রুড স্টেইন, হেনরি মিলার, জেমস জয়েস, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, সিনক্লেয়ার লুইস, স্কট ফিটজেরাল্ড, স্যামুয়েল বেকেট, পল ভ্যালরি ছিলেন অন্যতম। এই শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানির সাহচর্যে থেকে সাহিত্য জগতে ছড়িয়েছে যশ, খ্যাতি ও সম্মান। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হন বেশ কয়েকজন। এই দোকানটি অস্কার প্রাপ্ত সিনেমা “মিডনাইট ইন প্যারিস” এও দেখানো হয়।
শেকস্পিয়ার অ্যান্ড কোম্পানিকে বলা হয় একমাত্র লেখকদের হোটেল অর্থাৎ বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের লেখক এখানে এসে বিনা মূল্যে রাত্রি যাপন করতে পারবেন। এই দোকানের দোতলায় রয়েছে গ্রন্থাগার আর সাহিত্যবিষয়ক নানা রকমের ওয়ার্কশপ চালানোর স্থান।
১৯১৯ সালে যাত্রা শুরুর পর এই দোকানকে কেন্দ্র করে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য গল্প। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪১ সালে দোকানের প্রতিষ্ঠাতা সিল্ভিয়া বীচ বাধ্য হয়ে এটি বন্ধ করে দেন। যুদ্ধের ডামাডোল শেষ হওয়ার পর পঞ্চাশের দশকে আবার এর যাত্রা শুরু হয়। সেই যাত্রা চলছে এখনও।
৮। পপুলার কিডস রিপাবলিক (বেইজিং, চীন)
পপুলার কিডস রিপাবলিক , যেন রূপকথার স্বপ্নপুরী। ছোটবেলা থেকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য এর চেয়ে অনন্য আর কিছু হতে পারে না। বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা হলেও বড়দের প্রবেশাধিকার রয়েছে এই দোকানে।
এই রঙিন বইয়ের দোকানে রয়েছে গোলগাল, আঁকানো বাঁকানো বিভিন্ন আকৃতির নানা রংয়ের বুকশেলফ। আর বইয়ের এসব তাক বেয়ে ওঠা মানা নয়, ছোটদের জন্য। গোলাকৃতির অথবা বিশেষভাবে বানানো শেলফগুলোতে বসে বাচ্চারা বই পড়তে পারে।
৯। দ্য ল্যালো বুক স্টোর (প্যোরতো, পর্তুগাল)
পর্তুগালের প্রাচীন এই বইয়ের দোকান চলছে ১৯০৬ সাল থেকে। বেশ কয়েকবার এর অন্দরমহলের সাজ পরিবর্তন করা হয়েছে। আর এখন এটি ট্যুরিস্টদের জন্য সাজানো এক অনবদ্য জগত। কাঠের কারুকাজ করা স্থাপত্যশৈলী, পুরো রঙ্গিন কাঁচ দিয়ে বানানো ছাদ, লাল বিশালাকার সিঁড়ি – সব মিলিয়ে আশ্চর্য এক জগত। ১০০ বছরের বেশী সময় ধরে “দ্য ল্যালো বুক স্টোর” পাঠকদের সামনে নিয়ে আসছে একের পর এক বেস্ট সেলার।