আমাদের দৃশ্যমান এই সুন্দর মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি কি হতে পারে। মোটামুটিভাবে আমরা সকলেই জানি যে আমাদের এই মহাবিশ্ব ক্রমপ্রসারনশীল। অর্থাৎ সৃষ্টির শুরু থেকেই আমাদের মহাবিশ্ব লাগাতার প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু এই প্রসারন কি চিরকালের জন্য? নাকি কখনো থেমে যাবে? জ্যোতির্বিজ্ঞানে মহাবিশ্বের সম্ভাব্য পরিণতিকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। রিকলাপ্সিং, ক্রিটিক্যাল, কোস্টিং, এক্সেলারিটিং। প্রথম তিনটির ক্ষেত্রে প্রথম তিনটির জন্য মহাকর্ষকেই একমাত্র প্রভাবক হিসেবে ধরা হয় যা মহাবিশ্বের ক্রমপ্রসারনে ভূমিকা রাখে। চলুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেয়া যাক।
রিকলাপ্সিং সংকোচনশীল মহাবিশ্বঃ মহাবিশ্বে অবস্থিত সকল বস্তুর ঘনত্ব যদি ক্রান্তিক ঘনত্বের চাইতে বেশি হয় তবে মহাবিশ্বের এই প্রসারণ এক সময় থেমে যাবে। ক্রান্তিক ঘনত্বটা আবার কি? ক্রান্তিক ঘনত্ব হল মহাবিশ্বের বস্তুমালার ঘনত্ব যদি প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে এক গ্রামের দশ কোটি কোটি কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ হয় সেই ঘনত্ব। আরও ভালো ভাবে বুঝার জন্য উদাহরণটি মনোযোগ সকারে পড়ুন। ধরা যাক, কোন একটা পাথরকে সজোরে ভূপৃষ্ঠ থেকে নিক্ষেপ করা হল। তাহলে কি ঘটবে? এর দুটি সম্বাভনা রয়েছে। এক, এটি মুক্তি বেগে ছোড়া হয় তাহলে সেটি পৃথিবীর মহাকর্ষ কে খুব সহজেই নাকচ করে দিয়ে পৃথিবীর বাইরে চলে যেতে সক্ষম হবে। দুই, যদি মুক্তি বেগে ছোড়া না হয় তবে সেটি একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠার পর মহাকর্ষের প্রভাবে আবার ভূপৃষ্ঠে পতিত হতে শুরু করবে। অনুরুপ রিকলাপ্সিং মহাবিশ্ব মতবাদ অনুসারে এক সময় এই মহাবিশ্বের প্রসারন থমে যাবে ও সংকোচন শুরু হবে। অর্থাৎ প্রসারনের বলের চেয়ে সংকোচন ঘটানোর বেগের মান বেশি থাকবে। আর গ্যালাক্সিসমুহ তখন ধীরে ধীরে কাছে আস্তে শুরু করবে। একপর্যায়ে এত কাছে চলে আসবে যে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকবে। শুরু হবে মহাধস। তবে এর জন্য আমাদের মহাবিশ্বের আকৃতি অবশ্যই বদ্ধ গোলকপৃষ্ঠের মত হতে হবে। কিন্তু যেহেতু আমরা আমাদের মহাবিশ্বের জ্যামিতিক আকৃতি সম্পর্কে নিশ্চিত নই তাই এখনি এই মতবাদকে শতভাগ অনুমোদন দেওয়া যাবে না।
ক্রিটিক্যাল বা অসংকোচনশীল মহাবিশ্বঃ আবার আমরা যদি মহাবিশ্বের বস্তুমালার ঘনত্ব ক্রান্তিক ঘনত্বের চাইতে বেশি না ধরে কম ধরি তা হলে কি হবে? মোট ঘনত্ব যদি ক্রান্তিক ঘনত্বর চাইতে প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে এক গ্রামের দশ কোটি কোটি কোটি কোটি ভগের এক ভাগ হয় তাহলে মহাকর্ষের ফলে যে প্রসারন ঘটছে তার সাথে মোট বস্তুমালার ভারসাম্য বজায় থাকবে। তখন এই মহাবিশ্বের যে প্রসারন ঘটছে তা এক সময় থেমে যাবে। তবে থেমে গেলেও রিকলাপ্সিং মহাবিশ্বর মত সংকোচন শুরু হবে না। অর্থাৎ মহাবিশ্ব স্থির বা মন্থর হয়র যাবে। আর এই প্রসারণ থামার হার হবে খুবই ধীর একটি প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে আমাদের মহাবিশ্বের আকৃতি অনেকটা সমতল বা টেবিল পৃষ্ঠের মতো হতে হবে।
কোস্টিং বা খোলা মহাবিশ্বঃ মহাবিশ্বের মোট বস্তুর ঘনত্ব যদি ক্রান্তিক ঘনত্বের চাইতে খুব বেশি কম হয় তাহলে মহাবিশ্বের সব বস্তুর সামস্টিক মহাকরশ তার প্রসারন থামাতে পারবে না। আর ক্রমাগত প্রসারনের ক্ষেত্রে যদি সামান্য পরিমান ভরও বাদ দেয়া হয় তবে অনন্তকাল ধরে এই মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে থাকবে। আর মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ যদি এমন হয় তবে আমরা হব একটি কোস্টিং মহাবিশ্বের অধিবাসী। কোস্টিং মহাবিশ্বকে খোলা মহাবিশ্ব ও বলা হয়ে থাকে।
এক্সেলারিটিং বা গতিশীল মহাবিশ্বঃ যদি মহাবিশ্বের বিকর্ষী শক্তি মহাবিশ্বের প্রসারণকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করতে থাকে তবে এটি হবে এক্সেলারিটিং মহাবিশ্ব। মহাবিশ্বে এক ধরণের শক্তি আছে যার উৎস এখনও অজানা। এটার উৎস হতে পারে স্রেফ ভ্যাকুয়াম শক্তি, কিংবা হতে পারে কুইন্টেসেন্সের মত কিছু। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটা বড় কাজ এই মুহূর্তে এই গুপ্ত শক্তির সঠিক প্রকৃতি কি রকমের তা নির্ণয় করা – এটা কি কুইন্টেসেন্স এর মত ‘গতিময়’ নাকি ভ্যাকুয়াম শক্তির মত ‘স্থির’? এ ব্যাপারটা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। কিন্তু যেটা তারা জানেন তা হল – এই শক্তি বিকর্ষণমূলক । ফলে এই শক্তি মহাবিশ্বকে সীমিত রাখতে সহায়তা করছে না, বরং প্রসারণের হার ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে । প্রসারণের হার যদি এমনভাবে বাড়তে থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্বের পরিণতি কি হবে?সেই মহাবিশ্বের গালাক্সি সমূহ পরস্পর থেকে একটি নির্দিষ্ট ধ্রুব গতিতে দূরে সরতে থাকবে। এবং মহাবিশ্বের প্রতিটি স্থানে খুব শীঘ্রই শীতলতা ও অন্ধকার নেমে আসবে। এই পরিণতি সত্য হলে, আজ থেকে এক থেকে দুই ট্রিলিয়ন বছরের মধ্যে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ ছাড়া আর কোন ছায়াপথ পর্যবেক্ষণ করতে পারব না। সেই অন্ধকার ও শীতল বিশ্বে আমাদের কি অবস্থা হবে তা একবার ভেবে দেখুন। তবে সান্তনার বিষয় হল এই যে কোন এক অদৃশ্য শক্তি গ্যালাক্সিগুলকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দিচ্ছে না। আমাদের আজকের যে মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণ তা এ ধরণের পরিণতির দিকেই রায় দেয়।
এই মতবাদগুলোতে যে সম্ভাব্য পরিনতির কথা বলা হয়েছে তা ভবিষ্যতে হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। হতে পারে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে বিজ্ঞানিদের হয়তোবা নতুন কোন তত্ত্ব নিয়ে ভাবতে হবে। মহাবিশ্বের প্রকৃত ভবিষ্যৎ কি হবে তা নির্ধারণে মানুষকে আরও পর্যবেক্ষণ ও পরিক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অনেকদূর অগ্রসর হতে হবে। আপাতত মহাবিশ্বের পরিণতি কি হবে সেই বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কোন কথা বলা যাচ্ছে না। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যে চারটি সম্ভাব্য পরিনতির কথা বলেছেন তার যে কোন একটি সত্য হতে পারে।
মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ আসলে কি হবে তা নির্ভর করছে ডার্ক ম্যাটার বা অদৃশ্য শক্তির উপর। এমন হতে পারে যে ভবিষ্যতে অদৃশ্য বস্তুমালার বিশাল জগতকে আরও সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের পরিণতি সম্পর্কে নতুন তত্ত্ব বের হয়ে আসবে। তাই এই সব পরিণতির কথা ভেবে আপনার দুশ্চিন্তা না করাটাই শ্রেয়।