ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে হত্যা করতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সি আই এ’র ১০ ব্যর্থ ষড়যন্ত্র

final.pngদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়ায় যে সব প্রভাবশালী রাষ্ট্রনেতা বিশ্ব রাজনীতিতে প্রবলভাবে আলোচিত ফিদেল কাস্ত্রো তাঁদের অগ্রগণ্য। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একাধারে ৪৯ বছর শাসন করে যাওয়া মহান এই বিপ্লবী নেতা ৯০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। জানা যায়, স্থানি সময় শুক্রবার (২৫ নভেম্বর ) রাত ১০ টা ২৯ মিনিটে রাজধানী হাভানায় তিনি মারা যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাকের ডগায় বসে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে কিউবায় কমিউনিস্ট শাসন ধরে রেখেছিলেন ফিদেল। কিউবার এক ব্যবসায়ী পরিবারে ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট ফিদেলের জন্ম। তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন মাত্র ২১ বছর বয়সেই । ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে দীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ‘আমেরিকার পুতুল’ বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটিয়ে কিউবার ক্ষমতায় আসে ফিদেলের দল। এই বিপ্লবে ফিদেলের প্রধান সহযোগী ছিলেন আর এক কিংবদন্তী চে গুয়েভারা। বিপ্লবের সংগ্রামে আরও ছিলেন ফিদেলের ভাই এবং কিউবার বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো। ৯০ বছরের জীবনকালে ফিদেল কাস্ত্রো কে ৬০০ বারের ও অধিক সংখ্যক বার মেরে ফেলার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর চরেরা। ফিদেল কাস্ত্রো কে মেরে ফেলার যারা চেষ্টা করেন তাদের নাম তালিকা তিনি তুলে ধরেন কিউবান সিক্রেট সার্ভিসের সাবেক প্রধান ফেবিয়ান এসকালান্তে ।

তাতে রয়েছে আইজেনহাওয়ার প্রশাসন ৩৮ বার, কেনেডি ৪ বার, জনসন ৭২ বার, নিক্সন ১৮৪ বার, কার্টার ৬৪ বার, রিগ্যান ১৯৭ বার, বুশ সিনিয়র ১৬বার, ক্লিনটন ২১ বার (Escalante পরিসংখ্যান অনুসারে)। সিআইএ গৃহীত কিছু হত্যা প্রচেষ্টা ছিল মারাত্মক বন্য প্রকৃতির যার কিয়দংশ তুলে ধরা হল।

(১)  বিষ ভরা ক্যাপসুলঃ

সিআইএর ষড়যন্ত্র ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর সাবেক স্ত্রী মিরতা লরেঞ্জকে হাত করে হত্যার চেষ্টা করা। বিষযুক্ত ক্যাপসুল দিয়ে তাকে হত্যা করার ফন্দি আটকানো হয়। কোল্ড ক্রিমের কৌটায় রাখা হয় সে ক্যাপসুল। কিন্তু তা জেনে ফেলেন ফিদেল। তখন তিনি মিরতার হাতে পিস্তল তুলে দিয়ে সরাসরি গুলি করে হত্যা করতে বলেন। মিরতা তা পারেন নি।

(২) বিষমাখা ডাইভিং স্যুটঃ

একবার এমন ষড়যন্ত্র করা হয় যে তাকে বিষমাখা স্পোর এবং ব্যকটেরিয়া মিশ্রিত ডাইভিং স্যুট পরিয়ে হত্যার চেষ্টা চালানো হয় যা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পরবর্তীতে জানা যায় এই প্ল্যান এ জড়িত ছিলেন আমেরিকান আইনজীবী জেমস বি ডোনোভান।

(৩) ‌ স্লো পয়েজনিংয়ের মাধ্যমে:

কাস্ত্রোর নিরাপত্তারক্ষী ফ্যাবিয়ান এসকালান্তে তাঁর এক লেখায় জানান যে, স্লো পয়েজনিং ব্যবহার করে কাস্ত্রোকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। এসব ষড়যন্ত্রের মধ্যে জটিল ছিল কাস্ত্রোর চুরুটের মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা। নিউইয়র্কের এক পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে এ ফন্দি নেয় সিআইএ। ওই চুরুটের মধ্যে যে পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা হয়, তা তার মাথা উড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। কাস্ত্রোকে দুর্বল করতে একবার তার জুতো ও চুরুটের মধ্যে রাসায়নিক দ্রব্য রাখা হয়। এর প্রভাবে তার শরীরের সব চুল পড়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। বিভিন্ন সময়ে তার খাবারে বিষ রেখে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তার ব্যবহৃত কলমে বিষযুক্ত সূঁচ রেখেও তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে সি আই এ।

 (৪)মাফিয়া পয়েজনিং:

২০০৭ সালে সিআইএ কর্তৃক প্রকাশিত কিউবা সংক্রান্ত ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট হতে জানা যায়, সিআইএ কিউবা হতে বিতাড়িত মাফিয়াদের গ্রুপ থেকে  কয়েকজন ত্যাগী সদস্য ভাড়া করে কাস্ত্রোকে হত্যার জন্য। তাদের মাধ্যমে কাস্ত্রোর পানীয়তে বিষাক্ত বিষ প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

(৫)  প্রাণঘাতী রুমাল:

শীতল যুদ্ধের সময় কিউবার সাথে তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নের সাথে বেশ হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠে। তৎকালীন কেনেডি প্রশাসনের যা একবারেই সহ্য হচ্ছিল না। যুক্তরাষ্টের গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট মতে, কাস্ত্রো এসময় সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে পরমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র পাওয়ার চেষ্টায় ছিল। সিআইএ তখন শুরু করে কাস্ত্রোকে হত্যার এক অভিনব চেষ্টা। কাস্ত্রোর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত রুমালে মত দেখতে এ্কধরনের রুমালে বিষাক্ত ব্যকটেরিয়া প্রয়োগের চিন্তা করে । কেস্ত্রোর মুখ থেকে সারা অঙ্গে যার বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু এ চেষ্টা সফল হয়নি।

 (৬) কৃত্রিম ঝিনুক

আরেকবার সমুদ্র সৈকতে কৃত্রিম এক ধরনের ঝিনুক ছড়িয়ে রাখা হয়েছিল যেন কাস্ত্রো সেখানে গেলেই সেগুলো বিস্ফোরিত হয়। সেই ঝিনুক বিস্ফোরিত হয়েছিল কাস্ত্রো সৈকত থেকে চলে আসার ৪০ মিনিট পর। কাস্ত্রো না মরলেও সেই হাভানা শহরের ট্রাফিক লাইট নাকি বিস্ফোরণের ফলে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

(৭) নেশাজাতীয় দ্রব্য এল এস ডি প্রয়োগঃ

শুধু হত্যার চেষ্টাই নয়, কাস্ত্রোর ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টাও কম করেনি সিআইএ। একবার এক বেতার কেন্দ্রে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন ফিদেল। এ সময় স্টুডিওতে নেশাজাতীয় দ্রব্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এর প্রভাবে অদ্ভুত আচরণ করেন ফিদেল। বিচলিত হয়ে পড়ে পুরো কিউবা। তবে এবারও ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হয় সিআইএর।

(৮) থেলিয়াম প্রয়োগঃ

কতভাবেই না মারার চেষ্টা করা হয়েছে ভদ্র লোককে ! আরেকবার থেলিয়াম প্রয়োগের চেষ্টা চালানো হয়েছিল যাতে তাঁর দাঁড়ী খসে যায় ও শেষে মারা যায়। দেশ ত্যাগী কিউবান সহ নানা অপরাধী চক্র ও এতে জড়িত ছিল।

(৯)বিস্ফোরক দ্রব্য

২০০০ সালে পানামা সফরে যান কাস্ত্রো। সেখানেও তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। একটি মঞ্চে বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। সেই মঞ্চে ভাষণ ডেস্কে ৯০ কেজি বিস্ফোরকদ্রব্য রাখা হয়। কাস্ত্রোর নিরাপত্তাকর্মীরা এই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন।

(১০) বিষ মিশ্রিত মিল্কশেকঃ

এসকালান্তের মতে, ১৯৬৩ সালে  মারাত্মক এক বিষ মেশানো মিল্কশেক খাইয়ে ফিদেল কে মেরে ফেলার চেষ্টা করে সিআইএ । কিন্তু গুপ্তচরের অনুসন্ধানে সেই বার ও তিনি বেঁচে যান।

এইসব ঘটনার সবগুলোর সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। তবে দেশে-বিদেশে তাঁর মৃত্যু কামনা ব্যক্তির যে অভাব ছিল না তাতে কারো সন্দেহ নেই। তাঁকে কেন্দ্র করে আততায়ীর অস্বস্তিকর আগ্রহ লক্ষ্য করে ফিদেল কাস্ত্রো একবার মজা করে বলেছিলেন, ‘আততায়ীদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যদি অলিম্পিকের কোনো ইভেন্ট হতো তাহলে তাতে আমি নিশ্চিত স্বর্ণপদক পেতাম।’

কাস্ত্রোকে হত্যার ষড়যন্ত্র নিয়ে পরবর্তী সময়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চ্যানেল ফোর। ‘৬৩৮ ওয়েজ টু কিল কাস্ত্রো’ নামের ওই প্রামাণ্যচিত্রে দেখানো হয়—কত কৌশলে তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যে সম্প্রচার করা হয় এটি।