অাজ থেকে প্রায় ৬/৭ বছর অাগে শিশু বিজয় ( ছদ্মনাম) এসেছিল ঢাকায়। তখন তার বয়স ০৯ বছর। বাবা চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে একটি ক্লাবে দারোয়ানের চাকরি করতেন।বাবা-মা ও তিনভাইসহ ০৫ জনের সংসারে অভাব যেন ফুরায়না।তাই মা এর পরিচিত একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সরকারি বাসায় ( ঢাকায়) শিশু বিজয়ের ঠাঁই হয়।সেখানে ছোট্ট বিজয় সারাদিন ছুটোছুটি করে অনেক কাজ করে। কিন্তু মনে শান্তি নেই।পান থেকে চুন খসলেই গৃহকর্তৃ তাকে শাস্তি দিত।কখনো রুটি ভাজার খুনতি দিয়ে ছ্যাঁকা দিত,কখনো পেয়ারা গাছের ডাল দিয়ে পেটাতো,কখনো মশার কয়েলের ষ্ট্যান্ড দিয়ে শরীরে পোচ দিত। শিশু বিজয়ের শরীরে অসংখ্য অাঘাতের চিহ্ন দৃশ্যমান।
যা তাকে অাজীবন মনে করিয়ে দেবে দুঃসহ ঐ জীবনের কথা।শিশু বিজয়কে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে দেওয়া হতোনা। এরমধ্যে তাঁরা বাসাও পরিবর্তন করে ফেলে।এমনিকরে ০২টি বছর চলে যায়। অবশেষে এই অসহনীয় কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে শিশু বিজয় ঐ বাসা থেকে পালায়। কিন্তু সে পালিয়ে যাবে কোথায়? সে কিছুই চেনেনা।তার কাছে কোন টাকা-পয়সাও নেই। বিজয় চন্দ্রিমা উদ্যানের পাশে বসে কান্না করছিল। এক দারোয়ান তাকে দেখে তার করুণ কাহিনী শুনে তিনি বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান।সেখানে হাজির হয় মানবাধিকারকর্মীও। তাঁরা বিজয়ের পক্ষে ঐ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন।
ভিকটিম হিসাবে ছোট্ট বিজয়ের অাশ্রয় হয় সমাজসেবা অধিদফতরাধীন মিরপুর সেফহোমে।এরপর ৩১/১২/১২ তারিখে বিজয়কে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র, টঙ্গী, গাজীপুরে প্রেরন করা হয়। এখান থেকে সংশ্লিষ্ট অাদালতে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে অাসছিল বিজয়। ইতোমধ্যে অনেক খোঁজা-খুঁজি করে বিজয়ের বাবার সন্ধান মেলে।কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসারের মাধ্যমে বিজয়ের জামিনের জন্য যোগাযোগ করা হয় অাদালতে। জানা যায় বিবাদী পক্ষের মহামান্য হাইকোর্ট হতে মামলার উপরে স্থগিতাদেশ নেওয়ায় সংশ্লিষ্ট অাদালতে কোন কার্যক্রম নেই।এরপরও থেমে নেই বিজয়ের মুক্তির প্রচেষ্টা।
প্রতিষ্ঠান (কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র, টঙ্গী, গাজীপুর) পরিদর্শনে অাসেন বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ, গাজীপুর মহোদয়।বিজয়ের মামলার নথিপত্র বিজ্ঞ বিচারক মহোদয়ের নজরে অানি ( যদিও মামলাটি ঢাকা কোর্টে বিচারাধীন)। তিনি নথিপত্র দেখে সাথে সাথেই ঢাকা জেলার বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ মহোদয়ের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন এবং স্পেশাল ম্যাজিষ্ট্রেট ( যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), কিশোর অাদালত, টঙ্গী, গাজীপুর জনাব শাহানা হক সিদ্দিকা ও অামাকে (মোছাঃ তাসনিম ফেরদৌসী) বিজয়ের মুক্তির লক্ষে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন। সে অনুযায়ী দীর্ঘ প্রচেষ্টায় অাবারো বিজয়ের বাবাকে অত্র কেন্দ্রে নিয়ে অাসার ব্যবস্থা করি এবং তাঁকেসহ সংশ্লিষ্ট কেস ওয়ার্কার জনাব মোঃ শরিফুল ইসলামকে (এই লেখার লেখকদের একজন) ( cspb project) অাদালতে প্রেরণ করি।
অবশেষে ০৭/১২/১৬ খ্রিঃ তারিখ জনাব মোঃ শরিফুল ইসলাম ও ঢাকা জেলার প্রবেশন অফিসার জনাব মোঃ বজলুর রশীদ এর সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট, কিশোর অাদালত, টঙ্গী, গাজীপুর জনাব শাহানা হক সিদ্দিকা মহোদয়ের প্রত্যক্ষ তৎপরতায় অবকাশকালীন বিশেষ অাদালত, ঢাকা হতে বিজয়ের মুক্তির অাদেশ পাওয়া সম্ভব হয়। অাজ দীর্ঘ ০৭ বছর পর বিজয়কে তার বাবার কাছে, তার পরিবারে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হই।
এজন্য কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানাই বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ, গাজীপুর মহোদয়কে, ধন্যবাদ জানাই জনাব শাহানা হক সিদ্দিকা, স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট, কিশোর অাদালত, টঙ্গী, গাজীপুর মহোদয়কে।অারো ধন্যবাদ জানাই ঢাকা জেলার প্রবেশন অফিসারসহ অত্র কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার ও সংশ্লিষ্ট কেস ওয়ার্কারকে।
এ সফলতার পিছনে অনেক শ্রম, অনেক কষ্ট জড়িয়ে থাকলেও প্রাপ্তিও কম নয়। মনটা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠল যখন বিজয় বলল ” স্যার অাপনাদের সহযোগিতা না পেলে অামি অামার বাবা-মার কাছে কখনো ফিরে যেতে পারতাম না।”
ভালো থাকুক বিজয়। অনেক অনেক শুভকামনা বিজয়ের জন্য।
লেখকদের সম্পর্কেঃ
শরিফুল ইসলাম ও মোছাঃ তাসনিম ফেরদৌসী,
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র, টঙ্গী, গাজীপুর।