সুন্দরবন ভ্রমণ: চলুন এই শীতে ঘুরে আসি রয়েল বেঙ্গলের ডেরা থেকে

অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিশ্বের সেরা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, প্রকৃতির রহস্যঘেরা আমাদের সুন্দরবন। প্রায় ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বিশ্বের ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) এই সুন্দরবন।সুন্দরবনের সবকিছুই বিস্ময়ে ভরা।ক্ষণে ক্ষণে এর রূপ বদলায়।এই শীতকালে ঘরে বসে সময় না কাটিয়ে কয়েকদিনের জন্য বেড়িয়েই পড়ুন না সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে।

কেন এই নামকরণ:

সুন্দরী গাছের কারণেই সুন্দরবনের নামকরণ বলে অনেকের ধারণা।ভিন্নমতও আছে।অনেকে বলেন, বহুবছর আগে এই বনের নাম ছিল ‘সমুদ্রবন’। আর তার থেকেই পরে নামকরণ হয়েছে ‘সুন্দরবন’।

সুন্দরবনের যেসব জায়গায় ঘুরতে পারেন:

(১) কটকা

সুন্দরবনের আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে কটকা অন্যতম।সুন্দরবন পূর্ব অভয়ারণ্যের প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে এই কটকা।এখানে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় খাল। এসব খালের পাশেই দেখা যায় চিত্রল হরিণ, বানর, উদবিড়াল, সাপ, বনমোরগ। মাঝে মধ্যে শুনতে পারেন বাঘের গর্জন।আশপাশের হরিণের পাল দেখে সত্যিই বিহ্ববল হয়ে যেতে হয়। এ জায়গা না ঘুরলে সহজে তা বোঝানো যাবে না।

(২) কটকা বিচ:

কটকার সমুদ্র সৈকত এক কথায় অনবদ্য। সুন্দরবনের আকর্ষণীয় বিচগুলোর মধ্যে কটকা অন্যতম। বিচের পাশেই রয়েছে ৪০ ফুট উচু একটি টাওয়ার।এখান থেকে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। আপনি চাইলে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হতে ফেরার সময় হেঁটে বীচের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারেন।

(৩) জামতলা সৈকত:

কটকা ওয়াচ টাওয়ার থেকে  উত্তর দিকে তিন কিলোমিটার হেঁটে গেলে দেখতে পাবেন জামতলা সমুদ্র সৈকত। পথ চলতে চলতে চোখে পড়বে বিভিন্ন আকারের জামগাছ, যার থেকে সৈকতটির নামকরণের সার্থকতা  খুঁজে পাওয়া যায়।  সৈকতটি নির্জন এবং পরিচ্ছন্ন। বেলাভূমিজুড়ে শুধুই দেখা যায় কাঁকড়াদের শিল্পকর্ম।কোথাও কোথাও দেখা যায়, জোয়ারের ঢেউয়ে ধুয়ে যাওয়া গাছের শেকড়।জামতলার সৈকত ধরে একটু এগুলেই দেখতে পাবেন একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।  বিস্তীর্ণ এলাবা জুড়ে ছনক্ষেতে, অগণিত বানর ও হরিণের ছোটাছুটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে আপনি সহজেই দেখতে পারেন। হঠাৎ চোখে পড়তে পারে বাঘের পায়ের ছাপ অথবা তার ফেলে যাওয়া কোন চিহ্ন।

(৪) কচিখালী

মংলা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কচিখালী, সুন্দরবনের আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান। জামতলা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে কচিখালী সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত রয়েছে দৃষ্টিনন্দন হাঁটার পথ। পথের চারপাশে ছড়িয়ে আছে গেওয়া, সুন্দরী থেকে শুরু করে নাম না জানা কত ধরণের গাছ। চারপাশটা ঘন অরণ্যে ঢাকা বলে চারদিকে ছমছম পরিবেশ বিরাজ করে যা অনেককে পর্যটককে শিহরিত করে। হরিণ, শূকর, বিষধর সাপ ইত্যাদি নানাধরণের বন্য প্রাণীর দেখা মিলতে পারে। এমনকি আপনি বাঘের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারেন এখানে।

(৫) করমজল

সুন্দরবন ভ্রমণ এবং সুন্দরবন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেওয়ার জন্য করমজল হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত ও আকর্ষণীয় স্থান। করমজল বন্যপ্রাণীর প্রজনন কেন্দ্র। এই প্রজনন কেন্দ্রে রয়েছে কুমির, হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন প্রাণীর প্রজনন এখানে একটি সংগ্রহশালা আছে। এতে সুন্দরবনের বাঘের কংকাল, হরিণের কংকাল, কুমিরের নমুনা ডিম, কুমিরের মাথাসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রাণীর নমুনা রয়েছে।

(৬) হার বাড়িয়া

পশর নদীর তীরে মংলা থেকে ২০ কিঃমিঃ দূরে হার বাড়িয়া অবস্থিত। যার নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয়। এখানে উন্নয়নের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে এ স্থানটি করমজলের মতন আকর্ষনীয় হয়ে উঠবে বলে এখনকার বন্য সংরক্ষণ অধিকর্তাদের বিশ্বাস।

(৬) নীলকমল (হিরণপয়েন্ট)

নীলকমলকে সবাই হিরণ পয়েন্ট নামেই বেশি চেনে। নীলকমল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্র সুন্দরবনের আরেকটি দর্শনীয় স্থান।হরিণের আদর্শ বিচরণক্ষেত্র এই হিরণ পয়েন্ট। আরও আছে বাঘ, বন্য শূকর, বানর, উদবিড়াল, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ এবং পাখি। নীলকমলের জনমানব ও নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দেখে মন উৎফুল হয়ে উঠে। অভয়ারণ্য কেন্দ্রের অফিস গৃহ, বনকর্মীদের বাসগৃহ, পিকনিক স্পট সবই নীল রঙ্গে শোভিত করা হয়েছে। যাতে নীলকমল নামটির সার্থকতা খুজে পাওয়া য়ায়।

 (৭) দুবলার চর: 

দুবলার চর সুন্দরবনের অন্তর্গত একটি ছোট্ট চর। সমগ্র সুন্দরবন ঘুরে মানুষের দেখা না মিললেও এখানে দেখা মিলবে হাজার হাজার মৎস্য শিকারির। নির্ধারিত ট্যুর স্পটের বাইরে জেলেদের মৌসুমী বসতি দুবলার চরেও ঘুরতে যান অনেক পর্যটক। জেলেদের জীবনযাত্রা, তাদের সংগ্রামমুখর জীবন, মাছ ধরার দৃশ্য এবং আহরিত মাছ শুঁটকী করার দৃশ্য দেখতে পাবেন সহজেই। প্রতিবছর এখানে রাস পূর্ণিমায় বসে রাসমেলা। লাখো মানুষের আগমন ঘটে এই রাসমেলায়। তীর্থযাত্রীর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিপুলসংখ্যক পর্যটকও ভিড় করেন এইসময়।পরিণত হয় লাখো মানুষের মিলনমেলায়।

(৮) মান্দারবাড়িয়া সৈকত: 

মান্দারবাড়িয়ার একদিকে সুন্দরবন অপরদিকে বঙ্গোপসাগরের মায়াবী জলরাশির অবিশ্রান্ত গর্জন, সৈকতের অপরূপ সৌন্দর্য্য ও উত্তাল বঙ্গোপসাগরের রূপ আপনাকে করে তুলবে বিমোহিত। এই সৈকত থেকে দেখতে পাবেন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। এখানকার ঘন বনে রয়েছে অতি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র প্রাণী থেকে শুরু করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর উদ বিড়াল কচ্ছপ কুমির, সাপ, কাকড়া ইত্যাদির সমারোহ। এখানে সমুদ্র সৈকতে বাতাসের প্রবাহে সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ার দৃশ্য ভারি মজার।

(৯) শেখেরটেক

শেখেরটেকে রয়েছে ৪০০ বছরের পুরাতন এক মন্দির। শিবসা নদীর তীরে শেখেরটেক মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরটির ইতিহাস জানা না গেলেও গভীর জঙ্গলের মধ্যে এ ধরণের পুরাকীর্তি পর্যটকদের মনে নানা কৌতূহল উদ্রেক করে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মন্দিরটি প্রায় ভগ্ন অবস্থায় রয়েছে। তবে এর চারপাশের দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ আপনাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুগ্ধ করে রাখবে।

(১০) তিনকোনা  আইল্যান্ড

সুন্দরবনের তিনকোনা আইল্যান্ড সুন্দবনের আরেকটি টুরিস্ট স্পট। এই দ্বীপটি অনেকটা দেখতে তিনকোন সদৃশ্য বলে এটি তিনকোনা আইল্যান্ড নামে পরিচিত। এই দ্বীপের চারপাশে ঘন বন থাকায় বাঘ, হরিণ, সাপ নানা বন্য প্রাণীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

প্রকৃতির এক অনন্য আশীর্বাদ এই সুন্দরবন। প্রকৃতি যেন তার আপন মহিমায় সাজিয়ে নিয়েছে এই সুন্দবনকে। তাইতো সিডর, ঝড়, জলোচ্ছাস এর উপর দিয়ে প্রতনিয়ত বয়ে গেলো সে তার যৌবন কিছুতেই হারাতে রাজি নয়। কথিত আছে, সুন্দরবন ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৬ বার তার রূপ বদলায়।খুব ভোরে, দুপুরে, পড়ন্ত বিকালে, এবং সন্ধ্যায় বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন সাজে দেখা দেয় এই সুন্দরবন। মধ্য ও গভীর রাতে সৌন্দর্য আরেক রকম। আর যদি জ্যোৎস্না রাত হয়, তবে তো কথাই নেই। এর সবকয়টি রূপ দেখতে হলে আপনাকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এখানে আসতে হবে। তবে পরিবারসহ নিরাপদে ভ্রমণের জন্য শীতকালই শ্রেয়।