প্রকৃতির লীলাভূমি আমাদের এই দেশ । স্রষ্টা যেন তার মনের সবটুকু সৌন্দর্য দিয়ে আমাদের এই দেশকে সাজিয়েছেন । আমাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলটি সবুজের এক অপূর্ব সমারোহ । সমুদ্রের ঢেউ , সাথে পাহাড়ের সেই সবুজ চুড়া যা এই অঞ্চলের রুপকে করে তুলেছে চির রঙিন । বান্দরবান , রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি এই তিনটি যেন পাহাড়ের তিনটি রূপবতী কন্যা যাদের রুপের আলো সবার মনকেই আলকিত করে । এই রুপ যেন অফুরন্ত , আপন মহিমায় মহীয়সী ।
বান্দরবান , সাঙ্গু নদীর তীরে অবস্থিত ছোট্ট একটি শহর ঠিক কবিতায় উল্লেখিত ছোট্ট শহর গুলোর মতো । এই জেলার নামটির মতো এর প্রকৃতিটাও বড়ই মনোমুগ্ধকর। গ্রীষ্ম কালে মনে হয় যেন পাহাড় তার সমস্ত রাগের তেজ তার তাপের মাধ্যমে সবাইকে জানাচ্ছে । আর বর্ষা কালে রবি ঠাকুরের সেই গানের লাইনটি এই পাহাড়ি কন্যা যেন কিছুতেই ভুলতে দেয়না , “আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে “ । বৃষ্টি যেন পরম সুখে ঝরতে থাকে পাহাড়ের চুড়াই , আর পাহাড় পরম যত্নে সেই জলকণা গুলো ছড়িয়ে দেয় ঝরনা আকারে । শীতকালে এই পাহাড়ি কন্যা হয়ে উঠে চাদর জড়ান কোন রাজকন্যা যে তার সবুজ রূপটি কুয়াশার চাদররে ঢেকে তাতে নিয়ে আসে নতুন এক আভা ।
আজকে যে জেলাটি আমরা “ বান্দরবান “ নামে জানি সেটি এক সময় পরিচিত ছিল “বোমং হাটাং “ নামে । সেই সময় আরাকান রাজত্বকাল ছিল , আর বান্দরবান ছিল সেই আরাকান রাজ্যের একটি অংশ । বান্দরবান যে রাজার শাসনের অধীন ছিল তাকে ডাকা হতো বোমাং রাজা নামে । আর সেই বোমাং রাজার রাজ্যকে বলা হতো “বোমং হাটাং “। রাজার রাজত্বকাল অনেক আগে শেষ হলেও এই জেলায় এখন সে পুরনো রাজ বাড়িটি রয়েছে । আর রাজ বাড়ির যে কর্তা এখনো তাকে সবাই বোমাং রাজা হিসেবেই অভিহিত করে থাকে । যারা বংশ পরম্পরায় বান্দরবানের অধিবাসী তারা এখনো তাদের এই রাজাকে বছরের শুরুতে তাদের সাধ্যমতো খাজনা প্রদান করে থাকে । আবার খাজনা বলতে কিন্তু সেই জমিদারী আমলের টাকা পয়সা অথবা তাদের ভাগের ফসল নয় । এই খাজনা তারা তাদের রাজাকে ভালোবেসে দিয়ে থাকে । সেটা হয়তোবা কারোর নিজ গাছের মূল , আবার কারোর নিজ জমির শাকসবজি । আরাকান রাজত্ব শেষ হওয়ার অনেককাল পরেও এই এলাকায় তেমন জনবসতি ছিলনা । যারা ছিল তারা পাহাড়ের কোন এক কোণায় নিজেদের বাড়িঘর নিজেরাই নির্মাণ করে নিতো যাতে তারা বন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় । জীবিকা নির্বাহের এক মাত্র বাহন ছিল জুমচাষ । পাহাড়ে চাষ করতে যাওয়ার সময় তাদের চোখে পড়ত এক অপরূপ দৃশ্য । একদল বানর দলবেঁধে কালো পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণা থেকে জলপান করতে আসতো । আর তারা একে অপরের হাত ধরে দলবদ্ধ ভাবে আবার ফিরে যেত । বানর থেকে “ বান্দর “ আর হাত ধরে দলবদ্ধ হয়ে থাকা তাদের ভাষায় ছিল “বান” ।সেই থেকে “বোমং হাটাং “ হয়ে উঠে “ বান্দরবান “ ।
পাহাড়ের মিতালীর মতো এই অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজনদের মধ্যেও রয়েছে এক অদ্ভুত বন্ধন । এই ছোট্ট শহরে রয়েছে ১৪ টি সম্প্রদায়ের লোক । ভিন্ন তাদের গড়ন ভিন্ন তাদের ভাষা । পোশাক আশাকের দিকেও তারা একে অপরের থেকে আলাদা । সব গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য গোষ্ঠীগত দিক দিয়ে যতই আলাদা হোকনা কেন যেকোনো আয়োজনে পুরো শহরকে মনে হয় একটি পরিবার আর শহরের লোক গুলো যেন এক পরিবারের সদস্য । পূর্ণিমায় যেমন সকলে একসাথে ফানুস উড়ায় তেমনি পূজাতেও তারা এক মণ্ডপে জমা হয়ে আনন্দ গুলো ভাগ করে নেই । একেই হয়তো বলা হয়ে থাকে “ সাম্প্রদায়িক বন্ধন “ যেটি এখানকার বাসিন্দারা নিজেরাই গড়ে তুলেছে । এই বন্ধন আর তার শান্তি নিয়ে সজ্জিত থাকুক এই পাহাড়ি কন্যা ।
লেখকঃ পূজা ধর, কন্টেন্ট ও ভয়েস ডেভেলপার, টিম বাংলাহাব