Call Me Heena- হিজড়া সম্প্রদায় বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কিছু অদেখা ছবি

লাবণ্যর কথা মনে আছে? অবশ্য দেশের হাজার হাজার লাবণ্য রয়েছে। তবে যে লাবণ্যর কথা বলছি সে খুবই সাহসী। সেক্যুলার ব্লগার ওয়াসেকুর রহমানকে রাস্তায় সবার সামনে খুন করে যখন হত্যাকারীরা পালিয়ে যাচ্ছিলো, লাবণ্য তাদের ধরে ফেলেছিলো। লাবণ্যের কারণেই তারা পুলিশের কাছে ধরা পরেছিলো এবং খুনের দায় স্বীকার করেছে। এই অকুতোভয় লাবণ্য একজন বৃহন্নলা। প্রচলিত ভাষায়, সে “হিজড়া”।

 

বাংলাদেশে বৃহন্নলাদের তৃতীয় লিঙ্গের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আগে তাদের ভোট দেয়ার অধিকার ছিলো, এখন তারা পাসপোর্ট তৈরি করতে পারবে এবং লিঙ্গের স্থানে তারা “তৃতীয় লিঙ্গ” টার্ম ব্যবহার করতে পারবে। লাবণ্যর সাহসিকতাপূর্ণ এই পদক্ষেপে মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে তাদের ট্রাফিক পুলিশের চাকরী দেয়া হবে। যদিও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

 

লন্ডনে অধ্যায়নরত চিত্রগ্রাহক শাহরিয়া শারমিন একজন বাংলাদেশি নাগরিক যিনি বৃহন্নলাদের নিয়ে একটি পোট্রেট সিরিজ তৈরি করেছেন। ৫১ বছর বয়সী বৃহন্নলা হীনা নিজের জীবন তুলে ধরেছেন শারমিনের কাছে। এবং শারমিন নিজের তোলা ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন একঘরে করে দেয়া এই তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের জীবন। তিনি তার এই পোট্রেট সিরিজের নাম দিয়েছেন, “Call Me Heena”।

 

৫১ বছর বয়সী হীনা বলেছেন, “আমার নিজেকে মৎসকন্যার মতো মনে হয়। আমার শরীর আমাকে বলে আমি একজন পুরুষ কিন্তু মনে প্রাণে আমি একজন নারী। আমি একটা ফুল, কাগজের ফুল। যাকে দূর থেকে ভালোবাসা যায় কিন্তু স্পর্শ করা যায় না, এবং যার ঘ্রাণের প্রেমে পরা যায় না।”

blank

 

২৫ বছর বয়সী এক বৃহন্নলা জরিনা। জরিনা আশা করে, একদিন ঘুম থেকে উঠে সে দেখবে যে সে মেয়ে হয়ে গেছে।

blank

 

“আমি সবসময়  মা হতে চেয়েছি। তাই আমি বৈশাখীকে দত্তক নিয়েছি। কিন্তু আমি প্রায়ই ভাবি, যদি বৈশাখী বড় হয়ে আমাকে বাবা বলে ডাকে, তখন কি হবে?” বলেছেন ২৭ বছর বয়সী সালমা।

 

blank

অল্প কিছু সৌভাগ্যবানদের মধ্যে ২৪ বছর বয়সী নয়ন একজন। সে একজন গার্মেন্টস কর্মী যে সম্মানের সাথে টাকা রোজগার করে তার পরিবারের জন্য।

blank

২১ বছর বয়সী নিশি অপেক্ষা করে তার স্বপ্নের রাজকুমারের জন্য। সে স্বপ্ন দেখে, তার রাজকুমার তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে সেই সম্প্রদায়ের প্রাচীর পেরিয়ে, যে সম্প্রদায় গত দুই শতক ধরে অন্ধকারাচ্ছন্ন।

blank

প্রিয়াঙ্কার বয়স ২৩ বছর। আসে তার জীবন নতুন করে শুরু করার কথা ভাবছে তার নতুন প্রেমিককে সাথে নিয়ে।

 

blank

২১ বছরের স্বপ্না তার ভালোবাসার মানুষকে পায়নি। তাই সে মনের যন্ত্রণা মেটায় নিজের গায়ে সিগারেটের ছ্যাকা দিয়ে।

blank

যৌনকর্মী পান্নার বয়স ৫২ বছর। কোন এক শীতের সন্ধ্যায় সে অপেক্ষা করছে তার খদ্দেরের। হিজড়া সম্প্রদায়ের আরো অনেকেই যৌনবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে।

blank

২২ বছর বয়সী সুমি (বাঁ দিকে) এবং ২৬ বছরের প্রিয়া (ডান দিকে) অর্ধনগ্ন হয়ে ক্যামেরার সামনে এসেছে। তারা আর কখনো তাদের পরিবারে ফিরে যেতে পারবে না। তাই তারা হিজড়াদের সাথেই নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে।

blank

“আমাদের কলম আছে, কিন্তু সেই কলমে কোন কালি নেই।” বলেছেন ২৪ বছর বয়সী সজীব।

blank

পিঙ্কি গুরু একটি হিজড়া দলের প্রধান। সে তার দলের সদস্যদের নাচ গান শেখায়। ছবিটি তখন তোলা হয়েছে যখন তারা একটি পূজার মন্ডপে নাচছিলো।

blank

পুরুষ হয়েও নারী সেজে থাকার অপরাধে ৩৩ বছরের সোনিয়াকে তার গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সে এখন ঢাকার একটি পার্কে প্লাস্টিকের ছাউনি দেয়া ঘরে থাকে। মাঝেমাঝে সোনিয়া তার অন্য একটি বন্ধু, যে নিজেও বৃহন্নলা, তার সাথে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে।

blank

 

৩১ বছর বয়সী সোনালীর প্রশ্ন, কেন বাঙালি সমাজ তাদের একঘরে করে রেখেছে যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোতে তৃতীয় লিঙ্গরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।

blank

“আমার খুব ভালো লাগে যখন দেখি একজন পুরুষ আমার দিকে সেভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে, যেভাবে সে একজন সাধারণ নারীর দিকে হচ্ছে।” বলেছেন ২৪ বছর বয়সী বৃহন্নলা জেসমিন।

blank

২১ বছরের টিনা বলেন, “আমি এমন একটি পরীক্ষা দিচ্ছি, যার ফলাফল আমার জানা নেই।”

blank

চিত্রগ্রাহক শাহরিয়া শারমিন বলেছেন, “সমাজের অন্য দশজন মানুষের মতো আমিও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোকে তাচ্ছিল্য করতাম। তাদের অস্পৃশ্য ভাবতাম। কিন্তু যখন আমার হীনার সাথে পরিচয় হয়, আমি আমার ভুল বুঝতে পারি। যখন সে তার জীবন তুলে ধরলো আমার সামনে, আমাকে তার জীবনের অংশ করে নিলো, আমি দেখলাম যে তাদের জীবন ‘হিজড়া’ শব্দটার অনেক ওপরে। তারা মা, বাবা, পুত্র, কন্যা। তারা প্রেমিকা, তারা প্রেমিক।”

blank

তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশে হিজড়াদের অবস্থা খুবই করুণ। তাদের কোন কর্মসংস্থান নেই। বেশিরভাগ জায়গায় তাদের মানুষ বলেই বিবেচনা করা হয়না। তাদের পড়ালেখার জন্য কোন স্কুল নেই, প্রার্থনার জন্য কোন উপাসনালয় নেই, কোন কর্মনিয়োগদাতা তাদের কাজে রাখতে চায়না। তারা কোন আইনি লড়াই করতে পারেনা, এমনকি তাদের কোন স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা নেই।”

blank

আমরা তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের মানুষ বলে জ্ঞান করিনা, তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেইনা। অনেকেরই অভিযোগ তারা চাঁদাবাজি করে, জোর করে মানুষের কাছ থেকে নানান উপায়ে টাকা আদায় করে। কখনো কি ভেবে দেখেছে যে কেন তারা এমন করে? কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো যে তারা জোর করে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে? কখনো কি এই সমস্যার গভীরে যেতে আমরা চেষ্টা করেছি? কখনো কি তাদের একটি সুস্থ জীবন দেয়ার কথা ভেবেছি? যদি প্রশ্নের উত্তর গুলো ‘না’ হয়, তাহলে, দায়ী কারা?

লেখকঃ তাসনিয়া আজমী। শখ বই পড়া, বই সংগ্রহ করা। লেখালেখি শুরু করেছি বেশীদিন হয়নি, কিন্তু এরই মধ্যে লেখালেখি ভালবেসে ফেলেছি। ইচ্ছে ছিল সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ার, বিভিন্ন কারণে হয়নি। ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে নিজের বই নিজের বুকশেলফে তুলে রাখার। ইচ্ছে আছে লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার।