পুরো বাংলাদেশ হয়তো ”ডুব” এর ভেতর ডুবে আছে। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত একটি রহস্যময় ঘটনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে পরিচালক মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর “ডুব” সিনেমাটি । গত বছরের শেষ দিকে ভারতের একটি প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম ‘আনন্দ বাজার’ এর মাধ্যমে প্রথম ডুব ছবিটি মুল অবয়ব সম্পর্কে জানা যায় । ‘আনন্দ বাজার’ পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, সম্ভবত ডুব সিনেমাটি কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এর জীবনী থেকে নেয়া। সবকিছুই একটা ঘোলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো । যদিও বলা হচ্ছে, মূলত ডুব ছবিটি একটি কাল্পনিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এ গল্পের মুল কাহিনীর সাথে কারো কোন ব্যক্তি জীবনের ছায়া থাকবেনা।কিন্তু মুল বিতর্কের জন্ম দেয় হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের করা ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে একটি চিঠি সেন্সরবোর্ডে জমা দেয়ার মাধ্যমে। এ নিয়ে মেহের আফরোজ শাওন তার ফেসবুক প্রোফাইলে একটি স্ট্যাটাস দেন।
প্রসঙ্গ ‘ডুব’
গত বছরের শেষ দিকে ভারতের একটি প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম ‘আনন্দ বাজার’ এর কাছ থেকে প্রথম ডুব ছবিটির পটভূমি সম্পর্কে জানতে পারি। আমাকে জানানো হয় ছবিটি হুমায়ূন আহমেদ এর জীবনকে ঘিরে। এবং হুমায়ূন পরিবারের কিছু সদস্যের চরিত্রও ছবিটিতে উঠে এসেছে যার মধ্যে আমিও আছি। খবরটি আমাকে বিস্মিত করে। তারপর পরই বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট থেকে জানতে পারি যে আলোচ্য ছবিটি কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জীবনের কিছু স্পর্শকাতর ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় ছবির মূল চরিত্রের অভিনয়শিল্পী, ইরফান খান শ্যুটিংয়ের আগে হুমায়ূন আহমেদের প্রচুর ভিডিও দেখেছিলেন। এবং সেগুলো দেখেই হুমায়ূন আহমেদের কথাবার্তা বলার ধরন — এ সব নিয়ে হোমওয়ার্ক করেছিলেন। ছবির আরেক অভিনয়শিল্পী পার্নো মিত্র তাঁর ফেসবুক পেজে দেয়া স্ট্যাটাস এ উল্লেখ করেন যে তাঁর অভিনীত চরিত্রের নাম ‘মেহের আফরোজ শাওন’। (যদিও কিছুক্ষণ পর তা সম্পাদনা করে বাদ দেন।) সঙ্গত কারণেই আমি আশঙ্কা বোধ করি। কেননা ছবিটির পরিচালক তাঁর কোনও মন্তব্যেই ছবিটির সাথে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের সম্পৃক্ততার কথা স্পষ্ট ভাবে অস্বীকার করেননি।
আমার আশঙ্কা আরও প্রবল হয় যখন ডুব ছবির অভিনয় শিল্পী রোকেয়া প্রাচী তার সাক্ষাতকারে স্পষ্ট করে বলেন যে ‘ডুব’ হুমায়ূন আহমেদরই জীবন কাহিনী। তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে ছবির কাহিনীর যে সার সংক্ষেপ জানা যায় তা হুমায়ূন আহমেদের জীবনের কিছু বিতর্কিত অংশ যার সত্যতা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে।
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের তথা বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তি লেখক। তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার মানে কি এই যে তাকে নিয়ে একটি মনগড়া কাহিনীচিত্র বানিয়ে ফেলা যাবে! ‘হুমায়ূন আহমেদ’ নাম বদলে চরিত্রের অন্য যে নামই দেয়া হোক, সেই চরিত্র যদি হয় বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় লেখকের যিনি চলচ্চিত্র নির্মাণও করেন, সংসার জীবনে যার দু’টি অধ্যায় আছে এবং ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েই যার জীবনাবসান হয়েছে, সেটি কার জীবন এটি বুঝতে কোনও দর্শকের গবেষণা করার প্রয়োজন পড়েনা।
তাঁর জীবনের অনেক গল্পই পাঠক দর্শকের জানা। সেই সত্য গল্পের সাথে কিছু বিভ্রান্তিমূলক তথ্য এবং তাঁকে নিয়ে ট্যাবলয়েড পত্রিকার কিছু চটকদার গুজব জুড়ে দিয়ে যদি কোনও ছবি বানানো হয় সেটা কি নৈতিক?
চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী মাধ্যম। দর্শকদের মধ্যে অনেক হুমায়ূন ভক্ত আছেন। নতুন প্রজন্মের এমন অনেক দর্শক আছেন যারা হুমায়ূন আহমেদ পড়া শুরু করেছেন মাত্র। তারা ছবিটি দেখে ভুল তথ্য পাবেন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। এবং এই বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরা কাহিনীচিত্রটি পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদের জীবনী হিসেবে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে উপস্থাপিত হবে। হুমায়ূন এবং আমার দু’টি ছোট সন্তান আছে। তাদেরও ভবিষ্যত আছে। বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের মধ্যে তারা কেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বে! এসব বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদ-এর জীবন নিয়ে নির্মিত সিনেমার ব্যপারে আমার আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ আছে।
সেই আশঙ্কা থেকেই ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে আমি একটি চিঠি সেন্সরবোর্ডে দেই। চিঠিতে অনুরোধ করা হয়, আমি যেই আশঙ্কাগুলো করছি, ছবিটি দেখার সময় সেই বিষয় গুলো যাচাই বাছাই করে যেন তাঁরা সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এ ছবিতে যদি কোনো আপত্তিকর বিষয় থাকে, সেগুলো যেন যথাযথভাবে পরিবর্তন এবং পরিশোধন করে মুক্তি দেয়া হয়।
আমি নিজেও একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। কোন নির্মাতা বা তাঁর নির্মাণের সাথে আমার কোনও বিরোধ নেই। আমি কোন চলচ্চিত্র নিষিদ্ধের কথাও বলিনি। কিন্তু হুমায়ূনের স্ত্রী হিসাবে এবং তাঁর একজন ভক্ত পাঠক হিসাবে হুমায়ূন আহমেদকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে বানিজ্যিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে নির্মিত কোনও চলচ্চিত্রের পক্ষে আমার অবস্থান থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।
মূলত শাওনের করা চিঠির আবেদনেই সেন্সরবোর্ড ডুব সিনেমাটি সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়।
মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী একটি অনলাইন পোর্টালকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,” ভালো কথা। কিন্তু উনি ডুবের ব্যাপারে আপত্তি জানানোর কে? এটা উনার লেখা বা অন্য কারো মৌলিক সাহিত্য কর্ম থেকে বিনা অনুমতিতে বানানো হয়েছে? এটা একটা মৌলিক চিত্রনাট্য— যেখানে জাভেদ হাসান নামে একজনের একটা গল্প বলা হয়েছে। এখানে উনার চিঠি লেখার এখতিয়ার কোথা থেকে আসল? বা এই চিঠির কী আইনগত মূল্য আছে তা তো আমি জানি না।”
যদিও মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর মুল বক্তব্যের সাথে এখনও ‘ ডাল মে কুছ কালা হে ‘ টাইপের কথা বার্তা শোনা যাচ্ছে। কারন হিসেবে বলা যায়, গত বছরের শেষের দিকে আনন্দ বাজারকে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “এটা হুমায়ূনের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করা হয়েছে, যেমনটা বায়োপিকে হয়। তবে ছবির শুরুতে লেখা থাকবে, এটি জীবিত বা মৃত কোনও ব্যক্তির জীবন থেকে নেওয়া নয়।” মূলত বিতর্ক টি শুরু হয় এখান থেকেই।
আনন্দ বাজার পত্রিকার ইন্দ্রনীল রায় প্রথম প্রতিবেদন করেছিলেন ডুব ছবিটি নিয়ে। এখানে উল্লেখ করা হয়েছিলো , হুমায়ূন আহমেদের জীবনী নিয়েই ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটি তৈরি হয়েছে! কিন্তু পরিচালক ফারুকী দাবি করে আসছেন, তিনি কোথাও বলেননি হুমায়ূন আহমেদের জীবন থেকে ছবিটি করা হয়েছে। ফারুকী সম্পর্কে ইন্দ্রনীলের মন্তব্য ‘ফারুকী মানুষটা ক্লিয়ার নন। এতদিন মিডিয়াকে ব্যবহার করে এখন নিজেই ভয় পেয়ে গেছেন।’
‘ডুব’-এর প্রধান কয়েকটি চরিত্রে অভিনয় করছেন বলিউডের ইরফান খান, কলকাতার পার্নো মিত্র, ঢাকার নুসরাত ইমরোজ তিশা, রোকেয়া প্রাচীসহ অনেকে। প্রযোজনা করছে বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়া ও কলকাতার এসকে মুভিজ। সহ-প্রযোজক হিসেবে আছেন ইরফান খান।
তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো , ডুব সিনেমাটি আগামী ১লা বৈশাখে মুক্তি পাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন ছবিটির বাংলাদেশী প্রযোজক আব্দুল আজিজ। তবে হ্যাঁ, ২০১৬ তে মুক্তি প্রাপ্ত আয়নাবাজি ছবির পর ২০১৭ সালের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের তালিকায় ” ডুব” থাকবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তাহলে চলুন, ডুবে “ডুব ” দেই।