“গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।”
– শামসুর রাহমান (আসাদের শার্ট)
শ্যামলী কলেজ গেট পার হয়ে পরের বাসস্ট্যান্ডের নাম আসাদ গেট। নিত্যদিন এই রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার মানুষের পারাপার। আচ্ছা, আমরা কি জানি যে এই গেটের নাম কেন আসাদ গেট? এই আসাদই বা কোন আসাদ? হে কুল ড্যুড শ্রেনীভুক্ত তরুণ-তরুণীরা, আসেননা একটু রক্তটাকে গরম করি, শোধন করি মস্তিস্ক। যদি না জেনে থাকেন, তবে আসুন, চিনে নেই এই আসাদকে।
শহিদ আসাদের পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। ১০ জুন ১৯৪২ সাল নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলাধীন ধানুয়া নামের ছোট্ট সবুজ গ্রামে জন্ম এই ক্ষণজন্মা বিপ্লবীর। তার বড় ভাইয়ের নাম ইঞ্জিনিয়ার রশিদুজ্জামান। শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ও মুরারী চাঁদ মহাবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৬৬ সালে বি.এ এবং ১৯৬৭ সালে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। এই বৎসরেই আসাদ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এবং কৃষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষাণী’র নির্দেশনায় কৃষক সমিতিকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে শিবপুর, মনোহরদী, রায়পুরা এবং নরসিংদী এলাকায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন।
ঢাকা’র সিটি ল কলেজে তিনি ১৯৬৮ সালে আরো ভালো ফলাফলের জন্যে দ্বিতীয়বারের মতো এম.এ বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের জন্য চেষ্টা করছিলেন। ১৯৬৯ সালে মৃত্যুকালীন সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এম.এ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। শহিদ আসাদ তৎকালীন ঢাকা হল (বতর্মান শহীদুল্লাহ হল) শাখার পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে এবং পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপসু-মেনন গ্রুপ), ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত প্রাণ আসাদুজ্জামান গরিব ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার বিষয়ে সর্বদাই সজাগ ছিলেন। তিনি শিবপুর নৈশ বিদ্যালয় নামে একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিবপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদেরকে সাথে নিয়ে আর্থিক তহবিল গড়ে তোলেন।
ঘটনা সংক্ষেপঃ
৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষাণী’র ডাকে হরতাল আহ্বানের ফলে ব্যবসায়ীরা তাতে পূর্ণ সমর্থন জানায়। এ প্রেক্ষাপটে গভর্নর হাউজ ঘেরাওয়ের ফলে ছাত্র সংগঠনগুলো পূর্ব থেকেই নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়েছিল।
৪ জানুয়ারি, ১৯৬৯ইং তারিখে ছাত্রদের ১১ দফা এবং বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবীর সাথে একাত্মতা পোষণ করে ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, যাতে প্রধান ভূমিকা রাখেন শহিদ আসাদ। ১৭ জানুয়ারি, ১৯৬৯ইং সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুষ্ঠিত বৈঠকে ছাত্ররা দেশব্যাপী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ডাক দেয়। ফলে গভর্নর হিসেবে মোনেম খান ১৪৪ ধারা আইন জারী করেন যাতে করে চার জনের বেশি লোক একত্রিত হতে না পারে। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশ থেকে এগারো দফার বাস্তবায়ন এবং ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও ই.পি.আর বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ২০ জানুয়ারি গোটা পূর্ব পাকিস্তানের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালনের আহবান জানিয়েছিল। এ ধর্মঘট মোকাবিলার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। তথাপি বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সমবেত হয় এবং বেলা ১২টার দিকে বটতলায় এক সংক্ষিপ্ত সভা শেষে প্রায় দশহাজার ছাত্রের একটি বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে পা বাড়ায়। মিছিলটি চাঁনখা’র পুলের নিকটে তখনকার পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে এর ওপর পুলিশ হামলা চালায়।
প্রায় ঘন্টাখানেক সংঘর্ষ চলার পর আসাদসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা মিছিলটিকে ঢাকা হলের পাশ দিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে রিভলবারের গুলি ছুঁড়ে আসাদকে হত্যা করে। এই আন্দোলনে শহিদ রুস্তম ও শহিদ মতিউর নামে আরো দুজন নিহত হন।
হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী মেডিক্যাল কলেজের দিকে ছুটে আসে। বেলা তিনটায় কোনো রকম প্রস্ত্ততি ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয় একটি বিরাট শোক মিছিল। মেয়েদের নেতৃত্বে এ মিছিল অগ্রসর হতে থাকলে সাধারণ জনগণও এতে যোগ দেয়। আসাদের মুত্যুর প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে বের হওয়া প্রায় দুমাইল দীর্ঘ মিছিলটি শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে শহিদ মিনারে এসে শেষ হয়।
শোকাতুর ও আবেগে আপ্লুত অগণিত ছাত্র-জনতার মিছিলে শহিদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট দেখে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি শামসুর রাহমান তাঁর অমর কবিতা “আসাদের শার্ট” লিখেন। এছাড়াও, বাংলাদেশের অন্যতম কবি হেলাল হাফিজ এ ঘটনায় ক্রোধে ফেঁটে পড়েন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে কালজয়ী “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়” কবিতাটি লিখেন –
“এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ।”
ছাত্র আন্দোলনে আসাদের মৃত্যুতে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় আলোকচিত্র শিল্পী রশীদ তালুকদার তার ক্যামেরায় স্থিরচিত্র হিসেবে ছাত্র-জনতার দীর্ঘ মিছিলসহ আসাদের শার্টের ছবি ওঠান।
আসাদের মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গোটা পূর্ব পাকিস্তানে তিনদিনব্যাপী শোক ঘোষণা করে। এ ছাড়া কমিটি ঢাকা শহরে হরতাল এবং পরবর্তী চার দিন প্রতিবাদ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। ২৪ তারিখে হরতালে গুলি চললে ঢাকার পরিস্থিতি গভর্নর মোনেম খানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সরকারের দমন নীতি জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারে নি এবং শেষাবধি প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পতন ঘটে।
২৩ জানুয়ারি, ২০১০ইং তারিখে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহিদ আসাদ, শহিদ রুস্তম ও শহিদ মতিউর স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন অণুষ্ঠানে শহিদ আসাদের ভাই অধ্যাপক এইচ এম মনিরুজ্জামান আসাদের শার্ট হস্তান্তর করবেন বলে জানান। উল্লেখ্য বেগমগঞ্জ, নোয়াখালীর কালু মিয়া শেখের পুত্র শহিদ রুস্তমের রক্তমাখা শার্ট জাদুঘরে জমা দিয়েছিলেন তাঁর সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আহাদ।
বস্ত্তত, আসাদের মৃত্যুতে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। অনেক জায়গায় জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইয়ুবের নামফলক নামিয়ে আসাদের নাম উৎকীর্ণ করে। এভাবে জাতীয় সংসদ ভবনের ডান পার্শ্বে অবস্থিত আইয়ুব গেটের পরিবর্তে আসাদ গেট রাখা হয়। আইয়ুব এভিনিউ নামান্তরিত হয়ে হয় আসাদ এভিনিউ এবং আইয়ুব পার্কের পরিবর্তে আসাদ পার্ক নামকরণ করা হয়। তখন থেকে আসাদের নাম হয়ে ওঠে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক।
১৯৭০ সালে ১ম শহিদ আসাদ দিবসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটকে জনগণ “ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের স্মারক ও অমর আসাদ” শিরোনামে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে যেখানে আসাদ গুলিতে নিহত হয়েছিলেন।
শিবপুর ও ধানুয়া এলাকার স্থানীয় লোকজন ১৯৭০ সালে শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজ নামে একটি মহাবিদ্যালয় এবং ১৯৯১ সালে আসাদের নিজের গ্রাম ধানুয়ায় স্থানীয় অধিবাসীরা শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করে।
আসাদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য হচ্ছে গণজাগরণ। ১৯৯২ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের গেটের উত্তর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের বা ডাকসু’র উদ্যোগে আসাদের স্মৃতিকে অমর ও অক্ষয় করে তুলতে এবং গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে জাগ্রত রাখতে গণজাগরণ নামে নির্মিত হয় আসাদের স্মৃতিস্তম্ভ। শিল্পী প্রদ্যোত দাস এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছিলেন।
১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়া ও আসাদ স্মৃতি পরিষদের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী’র উপস্থিতিতে এ ভাস্কর্য উদ্বোধন করেন শহিদ আসাদের বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার রশিদুজ্জামান। নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যেই কর্তৃপক্ষীয় অবহেলায় স্থানীয় টোকাই ও দুর্বৃত্তদের দ্বারা ভাস্কর্যটি কাঁত হয়ে পড়ে। এরপর সেখান থেকে কোন একসময় এটি উধাও হয়ে যায়।
শুধু ছাত্র ও কৃষক সংগঠনে অথবা গণশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যেই আসাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতা সীমিত ছিল না। তিনি উন্নত রাজনৈতিকে আদর্শ বহনকারী একটি পার্টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ১৯৬৮ সালে লিখিত তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে সর্বহারা শ্রেণির রাজনীতি পরিচালনার জন্য সংক্ষিপ্তভাবে Study Circle গঠন করার কথা লেখা আছে। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটির একজন অগ্রণী সংগঠক, যারা ১৯৬৮ সাল থেকেই সার্বভৌম ও শ্রেণিশোষণমুক্ত একটি দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছিলেন।
প্রতি বছরই জানুয়ারির ২০ তারিখে শহিদ আসাদের দেশমাতৃকার সেবায় মুক্তি এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে তার মহান আত্মত্যাগ ও অবদানকে বাঙ্গালী জাতি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গভীর শ্রদ্ধায় শহিদ আসাদ দিবস পালন করে থাকে। আমরা কি পারলাম আসাদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে?
সোর্সঃ
১. বাংলাপিডিয়া- শহীদ, আসাদ;
২. উইকিপিডিয়া – আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান;
৩. মেসবাহ কামাল, আসাদ ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ঢাকা, ১৯৮৬;
৪. লেনিন আজাদ, ঊনসত্তরে গণঅভ্যুত্থান: রাষ্ট্র সমাজ ও রাজনীতি, ঢাকা, ১৯৯৭;