চিকুনগুনিয়া- সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন।

বর্ষা এসেছে, বেড়েছে মশার প্রকোপ। সঙ্গে বেড়েছে মশাবাহি রোগব্যাধি। ডেঙ্গু ম্যালেরিয়ার পাশাপাশি চিকুনগুনিয়া বর্তমানে আরেকটি আতংকের নাম যা মূলত একটি মশাবাহিত রোগ। আসুন জেনে নেই চিকুনগুনিয়া সম্পর্কিত কিছু তথ্য।

চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ইলেকট্রন মাইক্রোস্কপে

চিকুনগুনিয়া কি?

চিকুনগুনিয়া হচ্ছে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস দ্বারা সৃষ্টি একটি রোগ।চিকুনগুনিয়া ভাইরাস টোগাভাইরিডি পরিবারের আলফাভাইরাস গণের অন্তর্ভুক্ত একটি RNA ভাইরাস। এই ভাইরাসটি মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। মূলত এডিস মশার দুটি প্রজাতি এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবপ্টিকাস এই ভাইরাসের বাহক হিসেবে পরিচিত। মানুষ ছাড়াও বানর, পাখি ও ইঁদুরের দেহে এই ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এখানে ডেঙ্গু ভাইরাসের সঙ্গে এর পার্থক্য, কারণ ডেঙ্গু শুধুমাত্র স্তন্যপায়ী প্রানীর শরীরে সংক্রমণ ঘটায়।

এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৩-৭ দিনের মধ্যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। এই রোগের প্রথম এবং প্রধান লক্ষণ হল হঠাৎ করে তীব্র জ্বর আসা এবং অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যাথা অনুভূত হয় যা কয়েক সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই রোগে মৃত্যুর হার খুবই কম ( প্রতি দশ হাজারে একজন বা এর চেয়েও কম) তবে প্রচন্ড জ্বর এবং অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশির ব্যথা পাশাপাশি শারীরিক দুর্বলতা আপনাকে দীর্ঘদিন ভোগাতে পারে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকিটা আরো বেশী হয়। চিকুনগুনিয়ার লক্ষণগুলো ডেংগু বা জিকা ভাইরাসের লক্ষনের সাথে কিছুটা মিলে যায়। যার ফলে অনেকেই একে ডেঙ্গু জ্বর ভেবে ভুল করে।  চলুন জেনে নেই চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ গুলো কেমন।

১. হঠাৎ করে তীব্র জ্বর, তবে এই জ্বরে কাঁপুনি  বা ঘাম হয় না। জ্বর ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। জ্বর ২-৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

২. জ্বরের সাথে সাথে শরীরের বিভিন্ন গাঁটে এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যাথা শুরু হয় এবং ব্যাথা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সাধারণত পায়ের দিক থেকে ব্যথা শুরু হয় এবং ক্রমে তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে।
৩. এই জ্বরে ফলে মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা শুরু হয়। অনেক সময় মাংসপেশি শক্ত হয়ে গিয়ে রোগীর চলাফেরায় ব্যাঘাত ঘটায়।

৪. জ্বর কমে গেলেও শরীরে ব্যথা থেকে যায় যা কয়েক সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

৫. জ্বরের সাথে সাথে শরীরে লালচে র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়।

৬. জ্বরের সংগে তীব্র মাথাব্যথা হতে পারে।

৭. শরীর ভীষণ দুর্বল ও ক্লান্ত লাগে।

৮. ফটোফোবিয়া বা আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা হয়।

৯. কনজাংটিভাইটিস হতে পারে।

১০. বড়দের ক্ষেত্রে আর্থাইট্রিস বা জয়েন্টে প্রদাহ হতে পারে।

১১. চিকুনগুনিয়া জ্বরে ডেঙ্গুর মত রক্তক্ষরণ হয় না এবং শরীরের প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায় না।

সনাক্তকরণঃ ভাইরাস পৃথকীকরণ, RT-PCR, সেরোলজীর মাধ্যমে পরীক্ষাগারে এই ভাইরাস সনাক্ত করা যায়।

blank

চিকিৎসাঃ

এই রোগের এখন পর্যন্ত কোন টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ নিয়ম হিসাবে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণে পানি বা তরল জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। জ্বরের জন্য সাধারণ প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ দেয়া যেতে পারে তবে অন্য কোন ব্যথার ঔষধ যেমন ক্লোফেনাক বা আইব্রুপ্রফেন জাতীয় ঔষধ নিজে নিজে খাওয়া যাবেনা।

প্রতিরোধঃ
সচেতনতাই এই রোগ থেকে বাচবার একমাত্র উপায়। চিকুনগুনিয়া যেহেতু এডিস মশা বাহিত রোগ তাই এডিস মশার বিস্তার রোধ করা জরুরি। এডিস মশা স্থির পানিতে ডিম পাড়ে তাই বাসার আশেপাশে পানি জমে থাকার স্থানগুলো নষ্ট করে দিতে হবে। বালতি, ফ্রিজের নিচে, ফুলের টব, গাড়ির টায়ার প্রভৃতি স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।। এডিস মশার ডিম স্থির পানিতে একবছর পর্যন্ত ভাল থাকতে পারে, তাই সামান্য পানি ও যেন জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।এডিস মশা দিনে কামড়ায় তাই দিনের বেলা মশারী টানানোর অভ্যাস করতে হবে। লম্বা হাতা যুক্ত শার্ট/গেঞ্জি ও ট্রাউজার্স পড়ার অভ্যাস করতে হবে। চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিকে মশা কামড়ানোর পর অন্য ব্যক্তিকে কামড়ালে তারও এই রোগ হতে পারে। তাই রোগীকে যেন মশা না কামড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সাধারণত ডেঙ্গু জ্বর একের অধিকবার হতে পারে কিন্তু চিকুনগুনিয়া একবার হলে পরবর্তীতে আর হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সবশেষে, আতংক নয় সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন।

তথ্যসুত্রঃ

Wikipedia

WHO