যেসব মানুষের কথাবার্তা বা নীরবতা সভ্যসমাজের দৃষ্টিতে অসমীচীন, নিরর্থক, অযৌক্তিক বা হাস্যকর এবং যাদের বাহ্যিক আচরণ স্বভাবসিদ্ধ নয় বা সভ্যসমাজের দৃষ্টিতে বিকৃতমস্তিষ্কের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় অথবা সমাজ ও সভ্যতা যাদের মনের মধ্যে ‘অন্যরকম এক অবস্থা’ সৃষ্টি করেছে কিংবা যাদের প্রকৃতিগত প্রবৃত্তি সমাজের কাছে যুক্তিহীন, কান্ডজ্ঞানহীন, উজবুকটাইপ বা ননসেন্সদের মতো, তাদের এসব আচরণ, আত্মভাব ও অঙ্গস্বভাব সম্পর্কে সভ্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কি হতে পারে, তা আমরা সবাই জানি। কারও দৃষ্টিতে এরা মানসিক রোগী, কারও দৃষ্টিতে এরা উন্মাদ, বদ্ধউম্মাদ, পাগল, বা অবাঞ্ছিত। অপেক্ষাকৃত এরা বেশ বিনয়ী বা ক্ষিপ্ত বলে এদের অযৌক্তিক কথোপকথন বা নীরবতা কিংবা আচরণ শুনতে বা বুঝতে কিংবা গ্রহণ করতে সভ্য মানুষ রাজী নয়। এদের স্থান কোথায় সেটাও আমরা জানি।
সাধারণ মানুষ এমনিতেই মেন্টাল অ্যাসাইলাম/মানসিক আশ্রম/উন্মাদাগার, প্রচলিত ভাষায় বললে পাগলা গারদ সম্পর্কে ভয়ভীত থাকে। কিন্তু পাগলা গারদের চেয়েও গা ছমছমে ব্যাপার হলো, যদি সেটা হয় পরিত্যক্ত পাগলা গারদ। পরিত্যক্ত পাগলা গারদগুলো হলো একদম নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ জায়গা। এতটা নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ যে এরা নিস্তব্ধতার গল্প বলা শুরু করে উচ্চস্বরে। গল্পগুলো কোনো সাধারণ গল্প নয়, গল্পগুলো ভৌতিক গল্প।
অনেক পরিত্যক্ত পাগলা গারদ আছে, যেগুলো আবার খুবই বিখ্যাত। জনশ্রুতি অনুযায়ী এই স্থানগুলোর ভেতরে যেসব অস্বাভাবিক কার্যকলাপ চলে আর এই স্থানগুলো নিয়ে যেসব ভয়ঙ্কর গল্পগুলো প্রচলিত আছে, তা জানলে মেরুদন্ডের মধ্য দিয়ে খুব সুক্ষ্ম হিমপ্রবাহ ছুটে যাবে।
এখানে তিনটি ভয়ঙ্কর পরিত্যক্ত পাগলা গারদ সম্পর্কে বলা হলো :
১। টপেকা স্টেট হসপিটাল, কানসাস (আমেরিকা)
এই হাসপাতালটি ১৮২৭ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত মানসিক হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত ছিলো। হাসপাতালটির বেশিরভাগ অংশই বর্তমানে ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালে দালানটির সামনের অচিহ্নিত সমাধিক্ষেত্রে ৭৫ বছর সময় ধরে থাকা রোগীর সমাধি রয়েছে। কোনো চিহ্ন, সমাধিপ্রস্তর, অথবা পথচিহ্ন নেই যে, যা থেকে বুঝা যাবে এটা সমাধিক্ষেত্র। এই হাসপাতালটিতে ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে আমেরিকার অন্যান্য মানসিক হাসপাতালগুলোর মতোই মানসিকভাবে পর্যুদস্ত রোগী দিয়ে জনাকীর্ণ ছিলো। সেই সময় কিছু গল্প রটে গিয়েছিলোো যে, সেখানে রোগীদের যৌন নির্যাতন করা হতো, নপুংসক বানিয়ে দেওয়া হতো আর কখনও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শিকল দিয়ে আটকে রাখা হতো।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা হলো, এক রোগীকে একবার দীর্ঘ সময়ের জন্যে স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিলো। সেই সময় এমন অবস্থা হয়েছিলো যে, সেই বাঁধনের উপর দিয়ে রোগীর নতুন চামড়া ওঠা শুরু হয়েছিলো।
ছবিঃ টপেকা স্টেট হসপিটাল
২। পোভেলিয়া, ইতালি
পোভেলিয়া হলো ভেনিসীয় উপহ্রদের দ্বীপগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি উপহ্রদ। রোমানীয় যুগের সময় প্লেগ রোগে আক্রান্ত জনগণকে সুস্থ জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যে পোভেলিয়া দ্বীপটিকে ব্যবহার করা হতো। ১৭০০ সালে, যখন ইউরোপে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ এর আবির্ভাব ঘটলো, পোভেলিয়া দ্বীপকে আবার সেই একই কারণে ব্যবহার করা হলো। হাজারে হাজারে লাশগুলো সেই দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হতো পুড়িয়ে ফেলার জন্য অথবা গণকবর দেওয়ার জন্যে। পোভেলিয়া হয়ে গেল এক নিঃসঙ্গ দ্বীপ। যদি কারও সন্দেহ হতো যে, এই লোক আক্রান্ত, সে আক্রান্ত না হলেও তাকে ভেনিস থেকে দূরে নিয়ে এসে মেরে ফেলা হতো। পুরুষ, মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ সবাই ধীরে ধীরে এই রোগের কারণে মারা যেতে লাগলো। এই মৃত্যুযন্ত্রণার সাক্ষী হলো পোভেলিয়া দ্বীপ, যেখানে স্থির শান্ত আঙুরখেতের নিচে এখনও হাজার হাজার লাশের চিহ্ন মেলে।
১৯৯২ সালে এই দ্বীপটিতে গড়ে উঠে উন্মাদাগার। সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি জিনিসটি ছিলোো, এখনো আছে, সেটা হলো ‘বেল টাওয়ার’। রোগীরা অভিযোগ জানাতে শুরু করল যে তারা প্লেগে আক্রান্ত রোগীদের ভূত দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু তাদেরকে পাগল মনে করা হতো, তাই তাদের অভিযোগগুলো আমলে নেয়া হয়নি।
ছবিঃ পোভোলিয়া আইল্যান্ডের মেন্টাল অ্যাসাইলাম এর বর্তমান চিত্র
তখন একজন ডাক্তারকে নিয়ে কিংবদন্তি প্রচলিত হয়েছিলোো যে, সে ছিলো একজন স্যাডিস্ট, যে কিনা তার রোগীদের উপর পুরাতন পদ্ধতিতে অপারেশন করতো। সেই অপারেশনে ব্যবহার করতো অসূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি যেমন হ্যান্ড ড্রিল, হাতুড়ি। তার মৃত্যুর সাথে সাথে সেই কিংবদন্তিও বিলীন হয়ে যায়। সে পোভেলিয়ার মৃত আত্মাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে পাগল হয়ে যায়, আর দ্বীপের সেই বেল টাওয়ার থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। বর্তমানে পোভেলিয়া বসবাসের অযোগ্য একটি জায়গা।
৩। নর্থ ওয়েলস হসপিটাল, ইউকে
নর্থ ওয়েলসের ছোট্ট গ্রাম ডেনবিতে, দুই স্তম্ভবিশিষ্ট বিশাল গেটের পেছনে ১০০ একরেরও বেশি জায়গার উপর বাগান দিয়ে ঘেরা ডেনবি’র প্রাচীন মানসিক হাসপাতালটি ভুতুড়ে ছায়ার মতো রাজকীয় বেশে দাঁড়িয়ে আছে।
ছবিঃ নর্থ ওয়েলস হসপিটাল
বজ্রধ্বনিতুল্য নীরবতা হাসপাতালটির কক্ষগুলোকে ঘিরে রয়েছে। আসবাবপত্র, সামগ্রী, চিকিৎসাবিদ্যার যন্ত্রাংশ সবকিছুই নষ্ট হয়ে যাওয়া মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে, আর দিনের পর দিন এর নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে হুইলচেয়ারগুলো, যা এই প্রাচীন উন্মাদাগারের দেয়ালগুলোর মাঝেই ম্লান হয়ে পড়ে থাকে। এই মানসিক হাসপাতালটিতে যা হয়েছিলোো, তা শুধু কল্পনাতেই চিন্তা করা যায়। লবোটমি আর ইলেক্ট্রিক শক ছিলো এখানকার সাধারণ চিকিৎসাপদ্ধতি, মানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার আর কি। চ্যাপেল, মর্গ, নার্স বিল্ডিং আর সাইকিয়াট্রিক ওয়ার্ডে হাজারও গল্প ঘুমিয়ে আছে। ১৯৯৫ সালে অ্যাসাইলামটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
তথ্যসূত্র : abandoned-mental-asylums