এমন ভুল আর হবেনা মাফ করে দাও….
আজ ছুটির দিন। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। মোটা লেন্সের চশমাটা পড়ে, হাতে কফির মগটা নিয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেমন মোচর দিয়ে উঠল ! বুকের খাঁচায় বন্দী অজস্র বোবা কান্নাগুলো নীরবে হুহু করে কেঁদে উঠল ! ঝুম বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে নয় আজ নিজেকে শুনিয়েই কাঁদতে ইচ্ছে করছে। শিশুর মত কেঁদে কেঁদে বাবার গানটি বেসুরো গলায় গাইতে ইচ্ছে করছে… আয় খোকা আয়…!
বাড়ি ফিরতে দুদিন দেরী হলেই বাবা মন খারাপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গানটি গাইতেন আর ভেজা চোখ দুটো কেউ দেখার আগে মুছে ফেলতেন। মা দূর থেকে দেখে নানা ছলছুতোয় ঝগড়া বাঁধিয়ে ভুলিয়ে দিতেন বাবার আমায় ভেবে ভেবে কান্না। আজ প্রায় একটি বছর ঠিক কি কারণে যে বাড়ি যাই না নিজেরই মনে আসছে না। ব্যস্ত জীবনে পাষাণ এক যন্ত্র হয়ে গেছি ? নাকি তাদের আদেশ উপদেশ শুনতে বা নিজেকে তাদের নিয়ম নীতিতে আবদ্ধ রাখতে বিরক্ত আমি বুঝতে পারছি না ! ভাবতে আজ অবাক লাগছে , চোখের পলকে কত বড় হয়ে গেছি ! নিজের পাঁয়ে দাঁড়িয়ে গেছি এখন। তাঁদের নীতিবাক্য শুনতে ভালো লাগেনা !
কিন্তু এইতো সেদিন, রাগ করে শুয়ে থাকলে বাবা মা শাষন আদরে ব্যস্ত হয়ে যেতেন ! বাবা আমার পাঁ দুটো জড়িয়ে আমার মান ভাঙাতে বলতেন, গলা ধরেছি ! গলা ধরেছি !
আর আমি হেসে কুটি কুটি হয়ে যেতাম।
মাঝরাতে যখন অবিরত শ্রাবণ ঝরত, মেঘের গম্ভীর আওয়াজে টিনের ঘর কাঁপত, মা এসে আমার পাশে শুয়ে যেতেন। আমি যাতে ভয় না পাই আমি যেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যাই।
কিন্তু আজ সফল আমি আমার শৈশব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। বোকা ছেলের মতন অনেক কেঁদেছি আজ বৃষ্টিতে ভিজে… চোখে চশমা, মুখে হাত চেঁপে ! কেউ শোনেনি, কেউ দেখেনি কান্না…!
আমি বাড়ি যাবো। আজই বাড়ি যাবো। ঈদে আমি আমার অপেক্ষারত সোনা মায়ের কাছে যাবো। আমার বুড়ো শিশু বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো..।
আমার মন ছুটে গেছে ! কোনরকম ক’টা কাপড় ভরে ব্যাগটা নিয়ে ছুটলাম।
হাপাতে হাপাতে বহু সময় বাদে , বড় কষ্টের পরে , তবু আনন্দের হাসি যেন সারা পথ ঠোঁটেই লেগে ছিলো আর অবশেষে আমি বাড়ির শান্ত চৌকাঠে নগ্ন পাঁ দুখানি রাখলাম। আহ্ ! জীবনের সব শান্তি সব সুখ সব মায়ার মহুয়া গন্ধ যেন এখানেই অনাদরে পড়ে ছিলো… আর আমি হন্যে হয়ে মিথ্যে সফলতার কলম চিবাতাম অবসরে বসে..।
মা ঠিক চুলোর পাশে আগের মতনই রান্না করছেন আর বাবার সাথে বকর বকর করছেন। আর বাবা আনমনে জানালার বাইরে একদৃষ্টিতে তাঁকিয়ে ঝিমানো সন্ধ্যা দেখছেন লাঠি ভর করে দাঁড়িয়ে… ঠিকভাবে হাঁটতেও পারেন না বোঝা যাচ্ছে ! মায়েরও প্রায় সব চুল সাদা হয়ে গেছে এই ক’দিনেই ! এত তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে গেছে ওরা আর আমি অপদার্থ সন্তান মিথ্যে অভিমানে দূরেই পড়ে রইলাম ! আর অক্ষম বাবাকে নিজের কাঁধ ঝুকিয়ে বলতে পারলাম না, বাবা লাঠিতে তোমায় মানায় না ! আমার কাঁধে ভর করে হাঁটো তো দেখি !
এই ক’দিনেই কেমন বুড়ো হয়ে গেছো, বড্ড শিশু হয়ে গেছো অল্পেই হাসো অল্পেই রাগো..! আচ্ছা এ নিষ্পাপ মুখগুলোর উপর রাগ অভিমান মানায়? সাহস করে মুখে বলতে পারিনি চুপকথায় বলেছি মাগো , আর কখনও এমন করব না মা মাফ করে দাও!
আজও বাবার সাথে কোন কথা বলিনি সোজা তাঁর স্নেহের শান্ত বুকে নিজেকে লেপ্টে কতক্ষণ যে কেঁদেছি বাচ্চা ছেলের মত খেয়ালই হয়নি যে মা কখন যেন এসে আমার পিঠে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন। আর আদরে হাত বুলাতে লাগলেন আমার পিঠে আমার মাথায়…।
সারা জীবনের সব রং বিসর্জন দিলে মা ! সব সুখ আমার নামে দলিল করে দিলে বাবা ! আর তোমরা নিজেরা নিঃস্ব হয়ে যাবার দিন গুনছো কত সরল হিসেবে ?
অথচ তোমাদের অযোগ্য সন্তান আমি মিথ্যে রাগ অভিমানে শুধুশুধু কত কাঁদিয়েছি তোমাদের তাই না ? আর এমন ভুল হবেনা মা , মাফ করে দাও! আর অন্যায় হবে না বাবা মাফ করে দাও !
………..কিন্তু ক’জন সন্তান এমন সুযোগ পায় যে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে পারে হায় !